বৈশাখ সংখ্যা

ষড়ঋতুর আবর্তন শেষে নতুন বছর

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘উৎসব’ প্রবন্ধে বলেছেন, ‘উৎসবের দিনে আমরা যে সত্যের নামে বৃহত্তরলোকে সম্মিলিত হই, তাহা আনন্দ, তাহা প্রেম।... উৎসবের দিন সৌন্দর্যের দিন। এই দিনকে আমরা ফুলপাতার দ্বারা সাজাই, দীপমালার দ্বারা উজ্জ্বল করি। সঙ্গীতের দ্বারা মধুর করিয়া তুলি। এই রূপে মিলনের দ্বরা, প্রাচুর্যের দ্বারা, সৌন্দর্যের দ্বারা আমরা উৎসবের দিনকে বৎসরের সাধারণ দিনগুলির মুকুটমণিস্বরূপ করিয়া তুলি।’ বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষের উৎসব বাঙালির জীবনেও মুকুটমণিস্বরূপ। আমরা এই উৎসবকে ফুলপাতা, দীপমালা দিয়ে সাজিয়ে তুলি এবং সঙ্গীত দিয়ে মধুর করে তুলি। নববর্ষ বাঙালির প্রাণের উৎসব।

বাংলা নববর্ষ বাঙালির আদিতম উৎসব। এ প্রসঙ্গে ড. মুহাম্মদ এনামুল হক বলেন, ‘খ্রিষ্টাব্দ, হিজরী অব্দ, শতাব্দ, বিক্রমাব্দ, বুদ্ধাব্দ, বঙ্গাব্দ প্রভৃতি কোনো নির্দিষ্ট বছরের সাথে নববর্ষের কোনো যোগ নেই। অর্থাৎ কোনো প্রকারের বৎসরের গণনার প্রারম্ভ থেকে কোনো দেশের অথবা জাতির নববর্ষ শুরু হয়নি। এ হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে চলে আসা একটা বাৎসরিক উৎসব। কোনো ধর্মের সঙ্গেও নববর্ষের কোনো সম্পর্ক নেই। বিশিষ্ট বৎসরগুলো যেমন পরে এসে এতে যুক্ত হয়েছে, বিশিষ্ট ধর্মও তেমনি উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। প্রকৃতপক্ষে বয়সের তুলনায় অব্দই বলুন আর ধর্মই বলুন নববর্ষের উৎসবের কাছে নেহাত সেদিনের খোকা। আধুনিক নববর্ষের উৎসবের মধ্যে আদিম নববর্ষের পরিবর্তিত রূপ লুকিয়ে আছে। তাই, তার প্রাচীন অনুষ্ঠানাদিকে আধুনিক অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে থেকে খুঁজে বের করতে হবে।’

ড. মুহাম্মদ এনামুল হকের এই বক্তব্য আমাদের গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। আবহমান বাংলার এই প্রাচীন রূপ থেকেই আমরা বুঝতে পারি, কৃষিভিত্তিক সমাজের জীবন ব্যবস্থায় ফসলকেন্দ্রিক উৎসব বড় আকারের সামাজিক উৎসবের সূচনা করে। নববর্ষ এই অর্থে আমাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব যেখানে মানুষে মানুষে ভেদ নেই। এই উৎসবে আছে মাটির গন্ধ এবং মানুষে মানুষে মিলিত হয়ে আনন্দ করার সবচেয়ে বড় মেলা। এই দিক থেকে নববর্ষ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক উৎসব। দীর্ঘ সময় আগে আমাদের কবি বলেছিলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। নববর্ষ তার মিলনমেলায় মানুষের এই সত্যকে ধারণ করে।

সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন ৯২৩ হিজরী মোতাবেক ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দে। ২৯ বছর রাজত্ব করার পর তিনি পঞ্জিকা ও বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। হিজরী সন ও সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছরকে যুক্ত করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়।

বলা হয়ে থাকে, ফসল কাটার মৌসুমে খাজনা আদায়ের সুবিধার জন্য এই সন চালু করা হয়েছিল। সম্রাট আকবরের উপদেষ্টা আমীর ফাতেউল্লাহ সিরাজী বাংলা মাসের নামগুলো নক্ষত্রের নাম থেকে নিয়ে সৌরমাসের দিন মিলিয়ে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। এই ব্যাপারে ১৫৮৫ সনের ১০ মার্চ সম্রাটের নির্দেশনামা জারি হয়। তবে এর কার্যকারিতা দেখানো হয় ১৫৫৬ সনের ১১ মার্চ থেকে। কারণ ঐ দিনটি ছিল সম্রাট আকবরের সিংহাসনে বসার তারিখ। সেই থেকে বাংলা বর্ষপঞ্জির সূচনা হয়। এবং এখন এটি বাঙালি সংস্কৃতির একটি বৃহৎ এবং মৌল উপাদান বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব এবং বৈশাখী মেলা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। কৃষি, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদিকে প্রভাবিত করে বাংলা নববর্ষ। নববর্ষের চেতনা আমাদের উৎপাদন পদ্ধতির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পৃক্ত। বিশেষ করে বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক জীবনের কাছে বাংলা নববর্ষ প্রেরণার উৎস।

পাকিস্তান আমলে পাকিস্তান সরকার নববর্ষ উদ্যাপন করার ব্যাপারে বাধা দিয়েছিল। পহেলা বৈশাখ সরকারি ছুটির দিন ছিল। সেই ছুটিও সরকার বাতিল করে দিয়েছিল। নববর্ষকে কেন্দ্র করে বাঙালির ঐক্যবদ্ধশক্তির যে অমোঘ দিক তারা অনুধাবন করেছিল, সেটি তাদের কাছে ভীতির কারণ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু এমন দমননীতি চালিয়ে পাকিস্তান সরকার বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। ১৯৭১-এ জাতির পিতা সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি এক হয়েছিল প্রবল শক্তি নিয়ে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে স্বাধীন করেছিল নিজ মাতৃভূমি। এ কথা সত্যি বাঙালি প্রয়োজনে বারবার মিলিত হবে, এক শক্তি হিসেবে জেগে উঠবে। রক্ষা করবে নিজের জাতিগত ঐতিহ্য।

২০২১ সালে উদযাপিত হচ্ছে বাঙালির প্রাণের নেতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ। একই সঙ্গে বাঙালির চেতনায় প্রস্ফুটিত হয়েছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এই অসাধারণ দুটো ঘটনার সঙ্গে বাংলা নববর্ষ বাঙালির চেতনার জাগ্রত বোধ। তবে দুঃখজনক ঘটনা বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারি মানুষের উৎসবকে আক্রান্ত করেছে। এ বছর ভার্চুয়ালি নববর্ষ উৎসব আয়োজন করেছে ছায়ানট। ঢাকা চারুকলা থেকে যে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়, এ বছর সেটিও হবে প্রতীকী অর্থে। তারপরও করোনাকালে উদযাপিত হবে নববর্ষ। সোনালি সূর্যের আলো ভরে দেবে মানুষের উদ্দীপনা।

ষড়ঋতুর আবর্তন শেষে নতুন বছর আসে আমাদের কাছে। সারা বছরের খতিয়ান করা হয় ব্যক্তি জীবনে এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে। দেখা যায় অনেক প্রিয় স্বপ্ন হয়তো বাস্তবায়িত হয়নি। তাই বলে হতাশ হওয়ার কিছু নেই, সবাই স্বপ্ন দেখে। কখনো ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে সেই স্বপ্ন অসংখ্য মানুষের স্বপ্ন হয়। স্বপ্ন একটি জাতিকে বাঁচিয়ে রাখে।  সেজন্য প্রার্থনার মতো উচ্চারণ করতে চাই- বাংলার মাটি হোক শস্যবতী, নদী হোক জলবতী, বাঙালির উদ্যম হোক কল্যাণমুখী, মানুষ যেনো পশু না হয়, মানুষের হৃদয়ে যেনো মানুষেরই ছায়া বিরাজমান থাকে।   

আরও পড়ুন : *নববর্ষ: হালখাতা ও রবীন্দ্রনাথ *বাঙালির খাসলত *বাঙালির সংস্কৃতি: অপরাজেয় লেনদেন *বৈশাখ নিজেই যখন পঙ্‌ক্তিমালা *কারাগারে বঙ্গবন্ধুর ‘নববর্ষ’ উদ্‌যাপন *বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় নববর্ষ উদ্‌যাপনের ঐতিহ্য *চৈত্র সংক্রান্তি: সামাজিক আচার ও ক্রিয়া