‘দেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না’-প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই প্রত্যয়ে তার আবেগের প্রকল্প ‘আশ্রয়ণের’ মাধ্যমে দুই ধাপে ঘর পেয়েছেন এক লাখ ২৩ হাজার ২৪৪টি গৃহহীন ও ভূমিহীন পরিবার। তৃতীয় ধাপে ঘর পাবে আরও ৬৫ হাজার ৪৭৪টি পরিবার। এতে দুই শতক জমির মালিকানাসহ সেমিপাকা ঘর করে দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মতো সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্যও রয়েছে ঘর দেওয়ার প্রকল্প। এতে বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনযাত্রার মান। উঠে আসছে সমাজের মূলস্রোতে।
রুপকল্প-২০৪১ কে সামনে রেখে প্রধানমন্ত্রীর সুদুরপ্রসারী ও অভূতপূর্ব এসব কর্মসূচির মাধ্যমে কীভাবে উপকারভোগী হচ্ছেন নিঃস্ব এই মানুষগুলো, বদলে যাচ্ছে তাদের জীবন তা সরেজমিনে দেখেছেন রাইজিংবিডির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এসকে রেজা পারভেজ। রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, সাভারের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে এসে পরিবর্তনের সেসব গল্পের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে চতুর্থ পর্ব।
গৃহহীন-ভূমিহীনদের বসতবাড়ি দিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ণ প্রকল্পে টেকসই সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করছে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। এই প্রকল্পে নিঃস্ব এসব মানুষদের সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসতে শুধু তাদের ঘর আর জমির নিশ্চয়তাই দেওয়া হচ্ছে না, সেই সঙ্গে সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধাও নিশ্চিত করা হচ্ছে। এসব আশ্রয়ণ প্রকল্প হয়ে উঠছে যেন একেকটি আধুনিক গ্রাম। সেখানে গড়ে তোলা হচ্ছে কবরস্থান, খেলার মাঠ, গণ শৌচাগার, প্রাত্যহিক কেনাকাটা, দোকান, বাজার, প্রাথমিক ও ধর্মীয় শিক্ষা, কমিউনিটি সেন্টার, মসজিদ।
সম্প্রতি রাজশাহীর পুটিয়ায় ‘তালুকদার গ্রাম আশ্রয়ণ প্রকল্প’ এবং সিরাজগঞ্জ সদরের ‘খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের আশ্রয়ন প্রকল্প’- ঘুরে এসব দেখা গেছে। এখানকার বাড়ি পাওয়া মানুষগুলো নিজের অতীত পেছনে ফেলে ছুটছেন সমৃদ্ধ আগামীর দিকে।
পুটিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নুরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ বলেন, ‘সামাজিক চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে এখানে কবরস্থানও রয়েছে। কেউ মারা গেলে তাদের লাশ দাফন হবে কোথায়? এই প্রকল্পই তো তাদের সব। তাদের তো এর বাইরে একখণ্ডও জমি নাই। যারা মুসলমান তাদের নামাজের জায়গা রেখেছি।
‘এখানকার বাচ্চারা আগে পড়াশোনা করতো না। পড়শোনার সাথে তারা পরিচিত ছিলো না। যেখানে তারা আগে থাকতো হয়তো অন্ধকারে থাকতো। এখন তারা বিদ্যুতের আলোয় পড়াশোনা করবে। সন্ধ্যার পর তারা মসজিদে এসে যাতে পড়তে পারে, সেজন্য শিক্ষক রেখে দিয়েছি। যাতে করে এখানকার কোনো বাচ্চা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়। নৈতিকতায় সমৃদ্ধ যে শিক্ষা সেটি তাদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছি। খেলার মাঠ ও খেলার সামগ্রী দিয়েছি। তারা এই মাঠে খেলবে।’
আশ্রয়ণের উপকারভোগীদের জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে মানসিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে তারা একে অপরের সাথে ঝগড়া করতো। কিন্তু গত এক বছরের আমি তাদের মধ্য এই ঝগড়া দেখিনি। এই যে একটা মানসিক অবস্থার পরিবর্তন সেট শিক্ষা ও তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের কারণে হয়েছে। এই সামজিক পরিবর্তনগুলো আমরা এখানে করতে পেরেছি।’
পুটিয়া উপজেলার পূর্ব বারইপাড়া নদীর তীর ঘেষে গড়ে ওঠা এই ‘তালুকদার গ্রাম আশ্রয়ণ’। ১১০টি ভূমি ও গৃহহীন পরিরবার ঘর উপহার পেয়েছেন এখানে। প্রথম পর্যায়ে ২৪টি, দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৪টি ঘর বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ে ৭২টি ঘর নির্মাণকাজ এগিয়ে চলছে।
জমিজমা না থাকায় শশুর বাড়ি থাকতেন রহিম মিয়া। এখানে এখন ঘর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার জীবনে করুণ কাহিনি। আমি শশুর বাড়ি থাকতাম। এই সরকার আমাকে একটি বাড়ি দিয়েছে। জমিও পেলাম। আমরা এখন অনেক সুখী। এখানে মাদ্রাসা-মসজিদ দিছে। ছেলে-মেয়েদের খেলার জায়গা আছে। ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখতে পারছে। কর্ম করে খেতে পারছি। কোনো চিন্তা নাই।’
সারাজীবন পরের জমিতে ছাপরা দিয়ে ছিলেন। এখন নিজের একটি ঘর হয়েছে। সেই দিনের স্মৃতিচারণ করে রহিমা বেগম বলেন, ‘আগে কষ্ট করছি ব্যাটা। এখন আল্লাহ সুখ দিছে। শেখ হাসিনা আমাদের জমি দিছে, বাড়ি দিছে। আমরা সুখ পাইছি। ঘরে শান্তি মতোন থাকতিছি। আগে ভাত কাপড় পাইনি, বাড়ি পাইনি ঘর পাইনি, এমন কষ্ঠ করিছি। আগান-বাগানে থাকিছি। শেখ হাসিনা বেটি আমাদের ঘর দিছে।’
পুটিয়ার মতো আরেকটি নান্দনিক আশ্রয়ণ প্রকল্প সিরাজগঞ্জ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও জেলার হর্টিকালচার সেন্টারের মাঝে ‘খোকশাবাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্প’। স্থানীয় প্রভাবশালীদের থেকে দখলমুক্ত করে সরকারি খাস জমিতে গড়া এই গ্রামে পয়ঃনিষ্কাশনের জন্য পাকা ড্রেন করে দেওয়া হচ্ছে। রাখা হয়েছে-খেলার মাঠ ও মসজিদ। মাঝখানে পরিকল্পিত সড়কও করে দেওয়া হয়েছে। সবার জন্য আছে একটি বড় পুকুর।
সিরাজগঞ্জ সদরের খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের ‘আদর্শগ্রাম’ ঘুরে এ চিত্র চোখে পড়েছে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায় ১৫ একর জমিতে ২৬৬ পরিবারকে সেমিপাকা ঘরসহ বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে। জেলা-উপজেলার মূল্যবান এ যায়গাটিতে আশ্রয়ণ করার পাশাপাশি তাদের জন্য নানা নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করছে জেলা প্রশাসন।
এই আশ্রয়ণে ঘর পেয়ে জীবনের আশা পূরণ হয়েছে নুরু মোহাম্মদের। তিনি বলেন, ‘ঘর ছিলো না। নদীতে ভেঙে গেছিম। তাম্বু টানায় অনেক কষ্ট ভোগ করছি। এই ঘর হাসিনার উছিলায় আল্লাহ তায়ালা আমাকে মিলায় দিছে। ওনার জন্য আমরা দোয়া করি। বাকি জীবন যাতে এখানেই কাটিয়ে দিতে পারি। খুব কষ্টে ছিলাম এই ঘরটা পাইয়া একটু আসান পাইছি। আল্লায় খুব শান্তিকে রাখছে।’
নুরুর মতো আরেক উপকারভোগী আবদুল শেখ। তিনিও নদী ভাঙনের শিকার। নদী ভাঙনে সব হারিয়ে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এখন জায়গা হয়েছে এই আশ্রয়ণে। যেখানে নিজের একটি ঘর হয়েছে। হয়েছে জমিও। সেটি ভেবেই আনন্দ পান তিনি। নিজে রিকশা চালান আর স্ত্রী কাপড়-লুঙ্গি-মেয়েদের কসমেটিকের ছোট্ট ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সাজানো সংসার।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তিনি যে আমাদের ঘর দিয়েছেন তাতে ওনার জন্য, ওনার বাবার জন্য দোয়া করি। অনেক জায়গায় প্রধানমন্ত্রী অনেক কাজ করছেন টিভিতে দেখি, শুনি। তিনি আরও কাজ করুক। আমরা খুশি। যেন মানুষের জন্য আরও করতে পরে সেই দোয়া করি।’
সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফারুক আহমেদ বলেন, প্রথম পর্যায়ে যখন আমরা ঘর তৈরি করি তখন খেয়াল রেখেছি যেন প্রকল্পটি আধুনিক পরিকল্পনার ছাপ থাকে। যাতায়াতের জন্য রাস্তা করে দিয়েছি। কার্পেটিং রাস্তা হয়ে যাবে।
‘যেহেতু এখানে অনেকগুলো ঘর হবে, সুতরাং ড্রেনেজ সিস্টেমের দিকে খেয়াল দিয়েছি। পাকা ড্রেন করে দিয়েছি যাতে কোনোভাবেই জলাবদ্ধতা না হয়। পানির জন্য পুকুর, খেলার মাঠ; যাতে খোলা জায়গা থাকে। আছে দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। এই গ্রামটির মানুষ কোনোভাবেই অবহেলিত না বলতে পারে সেই বব্যস্থা করেছি’, বলেন তিনি।
আরও পড়ুন
নতুন প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’
তারাও আর পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নয়
বেদখল জমিতে যেভাবে গড়ে উঠছে আগামীর স্বপ্ন