শিল্প ও সাহিত্য

সে রাতে পূর্ণিমা ছিল: শহীদুল জহির ও তার উপন্যাস 

সম্ভবত, মানে আমার বিবেচনায় নিশ্চিত, শহীদুল জহিরের সেরা কাজ ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’। এখন প্রশ্নটা উঠতেই পারে, কোন বিবেচনায় আমি একটি উপন্যাসকে একজন লেখকের সেরা কাজ বলি?

আদতে আমি মনে করি, গল্প বা উপন্যাস বা কবিতা বা অন্য যে কোন ধাঁচের কোনো লেখায় যদি সেই লেখককে চিনতে পারা যায় তাহলে সেটিই তার সেরা কাজ। যেমন কাফকাকে ‘মেটামরফসিস’ আর ক্যামুকে ‘আউটসাইডার’ পড়ে আবিষ্কার করা যায়। যে লেখার মধ্যে লেখক তার সকল গুণ আর করণকৌশল নিয়ে হাজির সে লেখাই তো তার সেরা কাজ। সেদিক থেকে, আমি মনে করি, ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসটি শহীদুল জহিরের সেরা কাজ।

যে জাদুবাস্তবতার সঙ্গে শহীদুল জহিরকে বরাবর আমরা সংযুক্ত করি সে জাদুবাস্তবতার ঘোর ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসে সবচেয়ে প্রকট। অথচ বলার অপেক্ষা রাখে না এই জাদুবাস্তবতা আরোপিত নয়, ল্যাটিন নয়, আমার বাংলাদেশের জাদুবাস্তবতা। আমাদের শৈশবের রূপকথা, লোককথা, পুরাণ কাহিনী এখানে একাকার। জ্বিনের আছর থেকে শুরু করে অলৌকিক দৃশ্যাবলোকনের কথা আমরা শুনে এসেছি দাদা, দাদির মুখে। সেইসব শৈশব, সেইসব পুরাণ আর লোকজ গল্প বাস্তবের সঙ্গে এক জাদুমায়া তৈরি করে শহীদুল জহিরের ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসেও। 

‘‘মহিন সরকারের উঠোনে তোরাপ আলির কথা শুনে তাদের মনে হয় যেন তারাও তোরাপ আলির মতো একটি পাহাড় দেখতে পায়, সেই পাহাড় যেন একটি জীবন, মফিজুদ্দিনের জীবন; এবং সেই পাহাড়ের উপর একটি চাঁদ হেসে ওঠে, সেই চাঁদ ছিলো চন্দ্রভান।’’ শহীদুল জহির বর্ণনায় এতোটাই ঋদ্ধ আর জাদুবাস্তবতা নির্মাণে এতো দক্ষ কারিগর যে আমরাও বর্ণনার তোড়ে, পাঠের সমতলে পাহাড়, চাঁদ দেখতে পাই। এমনকি চন্দ্রভান আকতারের বিস্ময়কর গল্পের ভেতরে ঢুকে যাই। 

যদিও ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাস মূলতই এবং প্রধানতই মফিজদ্দি ওরফে মফিজুদ্দিনের গল্প। তাকে কেন্দ্র করেই পূর্ণিমা রাতে বিকাশ ও বিলোপ রচিত হয়। প্রায় পুরাণের মতোই অমিত শক্তি আর রহস্য, বাস্তব ও মায়ার মিশেলে গড়ে উঠেছে মফিজউদ্দির গল্প। চরিত্র এখানে গ্রীক ট্র্যাজেডির মহানায়ক যেনবা। ‘‘তারপর থেকে সুহাসিনী গ্রামে এবং ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নে আর নির্বাচন হয় নাই, নির্বাচন এলে গ্রামের লোকদের এই কথাটি জানা থাকে যে, মফিজুদ্দিন মিয়া নির্বাচনে দাঁড়াবে এবং সে প্রার্থী হলে আর কেউ প্রার্থী হবে না; এভাবে, গ্রামের লোকেরা দেখতে পায় যে, মফিজুদ্দিন একনাগাড়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যায়। সুহাসিনীর মানুষের এই কথাটি জানা ছিল যে, মফিজুদ্দিন একশ এগারো বছর জীবিত থাকবে এবং যে কোনো কারণেই হোক, এ কথায় তাদের যেহেতু আস্থা জন্মে গিয়েছিল, তারা একসময় ধরে নিয়েছিল যে, এই একশ এগারো বছর তাদের আর ভোট দেওয়ার কোনো ব্যাপার নাই। তাদের এই জ্ঞান এবং এই জ্ঞানের যথার্থতার ধারণা নিয়ে তারা ব্রিটিশ আমলের শেষাংশ পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট এবং আইউব খানের বিডি চেয়ারম্যানের কাল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস এবং মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের সময়কালের ভেতর দিয়ে পার হয়ে আসে...’’

এক অপ্রতিরোধ্য, অপ্রতিদ্বন্দ্বী মফিজুদ্দিনের গল্প আমরা শুনতে শুরু করি এবং সেই মফিজুদ্দিন যার শতায়ু হওয়া সুনিশ্চিত। অর্থাৎ লক্ষ্য করার বিষয় যে, মফিজুদ্দিন রাজা ইদিপাস কিংবা ইউলিসিস কিংবা আগামেননের মতোই প্রবল শক্তিধর হয়ে ওঠে। এবং কে না জানে, ট্র্যাজেডির অনিবার্য শর্ত হলো বিশাল, বিপুলের পতন। গ্রীক ট্র্যাজেডির বিপুল নায়ক মফিজুদ্দিনের সমীকরণ কিন্তু শহীদুল জহির অন্যভাবে করেন। গল্পে নয়, গল্প বলার বয়ানে লেখক অনন্য হয়ে ওঠেন। যে মফিজুদ্দিনের একশ এগারো বছর বাঁচার কথা সে মফিজুদ্দিনকে সপরিবারে নিহত হওয়ার ঘটনা দিয়েই উপন্যাসের সূচনা। সময় এখানে লেখকের হাতের ক্রীড়ানক, তিনি গল্পের সময়কে দুমড়ে-মুচড়ে দেন, ফলে বাস্তবতা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যেন জাদুবাস্তবতার দিকে এগুতে থাকে। গল্প কখনো অতীতে যায়, কখনো বর্তমানে ফিরে আসে, এমনকি কখনো ভবিষ্যতেও রওনা দেয়। এক অদ্ভুত আখ্যান বয়ান কৌশল আয়ত্ত্ব করে শহীদুল জহির তার ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসে।

উপন্যাসের ‘তোরাপ আলি পুনরায় চাঁদের পূর্বের বর্ণনায় ফিরে যায়...’  আর লেখক বারবার এক কাহিনী থেকে আরেক উপকাহিনীর দিকে ফিরে যান, ফিরে আসেন সময়কে আগে-পিছে নিজের ইচ্ছা মতো টেনে নেওয়া ছাড়াও, এ উপন্যাসে শহীদুল জহির একটা ঘোর তৈরি করেন দীর্ঘ বাক্য বয়ানে। এই দীর্ঘ বাক্য নির্মাণ কিন্তু কমলকুমার মজুমদারের মতো নয়। প্রলম্বিত এই বাক্য বয়ানও শহীদুল জহিরের নিজস্ব রীতি, কেননা এখানেও তিনি শব্দ ছাড়িয়ে, বাক্য ছাড়িয়ে ভিন্ন কোনো চিত্রের দিকেই যেতে থাকেন ক্রমাগত। ‘এই পর্যায়ে গ্রামের লোকদের হয়তো এ রকম মনে হয় যে, তারা মফিজুদ্দিন মিয়াকে আজীবন এ রকমই দেখছে, বৃদ্ধ এবং জীর্ণ; কিন্তু এই জীর্ণতার এখানেই শেষ, এরপর তা আর অগ্রসর হয় না, মনে হয় যেন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যায় মফিজুদ্দিনের জীবন, এবং এই জীবন অনড় ও স্থায়ী হয়ে ওঠে সুহাসিনীতে; সুহাসিনীর লোকেরা জানে, একশ এগারো বছর বাঁচবে এই বুদ্ধ।’ 

শহীদুল জহিরের কাহিনী বয়ানের আরেকটি বড় কৌশল হলো বহুবচনে গল্প বলা। একজন একক ব্যক্তি নয়, ‘অনড় ও স্থায়ী’ মফিজুদ্দিনের গল্প বয়ান করছে পুরো গ্রামবাসী আর এই সামষ্টিক বর্ণনায় গল্প ক্রমশ এক বাস্তবতার অতীত তলে যেতে থাকে।

প্রসঙ্গত খেয়াল করা যেতে পারে শহীদুল জহিরের উপন্যাসসমূহের নাম। ‘জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’, ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’, ‘মুখের দিকে তাকিয়ে’ এবং ‘আবু ইব্রামিহের মৃত্যু’ নামকরণের মধ্যেও গল্পকথা বুননের ইঙ্গিত বিদ্যমান। লক্ষ্যণীয় যে, প্রতিটি বাক্যই একটি গল্পের দিকে পাঠককে টানতে থাকে। এখানে উপন্যাসের বা কাহিনী বয়ানের প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ধারা প্রসঙ্গে দুকথা বলতে পারি আমি। পাশ্চাত্যে গল্প, উপন্যাস, নাটক ক্রমাগত ক্লাইমেক্সের দিকে আগায়, অর্থাৎ একটা চূড়ায় পৌঁছে ক্রমে তা আবার অবতরণ করে। কাহিনী আগায় ধারাবাহিক, সুগঠিত কাঠামোতে। তথাকথিত সমালোচকের ভাষায় বলা যায়, পাশ্চাত্য গল্প-উপন্যাস টানটান, এখানে দীর্ঘ বয়ানের সুযোগ কম। এমনকি মার্কেজের শেষ উপন্যাস ‘মেমোরিজ অব মাই মেলানকোলিজ হোর’ এতোই টানটান, সুগঠিত যে তা এক বসাতেই পড়ে ফেলা যায়। প্রায় ৯০ পৃষ্ঠার এই উপন্যাস একজনের পাঠকের টানা পঠনে দুয়েক ঘণ্টায় শেষ হয়ে যায়। তুলনায় শহীদুল জহিরের বর্ণনা দীর্ঘ। তার দীর্ঘ, প্রলম্বিত বাক্যের মতো, উপন্যাসের দীর্ঘ নামকরণের মতো তার কাহিনীও দীর্ঘ। অনেক ডালপালা নিয়ে এগুতে থাকে তার গল্প, কখনো আবার এগোয় না, পিছোয়। 

লক্ষ্যণীয় এ আমাদের প্রাচ্য দেশীয় গল্পরীতি। রামায়ণ, মহাভারত, মঙ্গলকাব্য থেকে শুরু করে আমাদের ব্যক্তি জীবনে কোনো কিছু আমরা টানা, টানটান করে বলি না। আমাদের যেন গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়া নেই, গন্তব্য জানা আছে, আমরা মুগ্ধ হয়ে আছি পথের বর্ণনায়। শহীদুল জহির তেমনি আমাদের মূল গল্প থেকে বারবার সরিয়ে আনেন, তারপরে কী হলো, তারপর... ? কিন্তু দেখা যায়, তিনি হুট করে বলা শুরু করেন, তারও আগে কী হয়েছিল। অথবা কখনোবা বলতে শুরু করেন, তারপর কী হতে পারতো বা হতে পারে। আর এসবও তিনি সরল করে বলেন না। সরল করে বলার চেয়ে পুরাণ তৈরিতে যেন তার আগ্রহ বেশি। ‘...ঘরের মেঝেতে নিচু টুলের উপর বসা মফিজুদ্দিনের সামনে সে হাঁটু গেড়ে বসে এবং জ্বলন্ত হারিকেনের উপর পরনের শাড়ির আঁচল গরম করে স্বামীর বীজভান্ডার সেঁক দিয়ে উত্তপ্ত করে তোলে, এবং পরিণতিতে সেদিন শেষ রাতে সে গর্ভবতী হয়।’ বলার অপেক্ষা রাখে না, এমন করে পুরাণ আর অলৌকিকের মিশ্রণকে বাস্তবতার তস্তুরিতে উপস্থাপন একমাত্র শহীদুল জহিরের পক্ষেই সম্ভব। 

প্রকৃতি ঘনিষ্ঠতা ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসের একটা বড় দিক। পূর্ণিমা রাত, চাঁদের অনুষঙ্গ বারবার ফিরে আসে উপন্যাসে নানা ইঙ্গিতে। ‘আকালু পরে গ্রামের লোকদের বলে যে, শিশুটি চিৎকার করে ওঠামাত্র যেন জমে ওঠা অন্ধকার কেটে গিয়ে চাঁদের এই আলো এসে পড়ে এবং তখন সে বুঝতে পারে যে, সে রাতে পূর্ণিমা ছিল এবং এতক্ষণ এই পূর্ণিমার চাঁদে গ্রহণ লেগেছিল; গ্রহণ কেটে যাওয়ার শুরুর মুহূর্তে শিশুটি জন্মায় অথবা শিশুটির জন্মের মুহূর্তে গ্রহণ কেটে যেতে থাকে।’ যেই মফিজুদ্দিনের জন্মের ঘটনার সঙ্গে পূর্ণিমা রাত, গ্রহণ জড়িত সেই মফিজুদ্দিন সপরিবারে নিহত হয় আরেক প্রবল পূর্ণিমার রাতে। 

পূর্ণিমার মতো বৃষ্টিও ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ উপন্যাসে একটা অলৌকিক, পরাবাস্তব, জাদুবাস্তব আবহ তৈরি করে প্রায়শই। ‘সুহাসিনীর লোকেরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করে যে, দুলালির মৃত্যুর সঙ্গে বৃষ্টি থেমে যায় এবং তারা বলে যে এই অঝোর বৃষ্টি হয়তো ছিল দুলালির শেষ কান্নার মতো; তার মৃত্যুতে এই কান্না থামে এবং পরদিন সকালে সুহাসিনীর লোকেরা ঝকঝকে রোদ উঠতে দেখে এবং তারা শুনতে পায় যে, মোবারক আলির কিশোরী কন্যা দুলালি তার যন্ত্রণা এবং লজ্জার জীবন অতিক্রম করে গেছে, বৃষ্টির অন্ধকার এবং ভেজা দিনে ড্রামে গুলিয়ে রাখা হলুদ রং সে রোদের আলো মনে করে পান করেছিল।’ 

এই বর্ণনা নিরেট গদ্য নয়, শহীদুল জহির বিশুদ্ধ কথাসাহিত্যিক হয়েও প্রলম্বিত বর্ণনার মধ্যে, অতি বিস্তৃত বর্ণনার মধ্যেও কবিতার মতো রহস্য রেখে দেন। আর তার ভাষা প্রয়োগে, বিশেষত উপমায় আমরা প্রবল কবিত্ব দেখতে পাই। গ্রামের নাম সুহাসিনী, পতিতার নাম নয়নতারা আমাদের স্রেফ নামের মধ্যে রাখে না, আরো সুদূরে নিয়ে যেতে থাকে। আর শহীদুল জহিরের গল্পের বয়ানে আমরা পাই বহুকাব্যিক, অলৌকিক উপমা এবং একাধিক চিত্রকল্প। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যেতেই পারে :  ‘এক ছিন্ন মুন্ডুর মতো রক্তাক্ত চাঁদ গ্রামের মাথার উপর দিয়ে গড়িয়ে যায়’,  ‘এই সময় দেহি আসমানে এক বিদঘুইট্টা চান’,  ‘সেদিন মিয়াবাড়ির উঠোনে, এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত তরমুজের মতো কেটে ফাঁক করা গর্তে লাশ দাফন করা হয়ে গেলে...’,  ‘মফিজুদ্দিনের চোখে পড়ে উবু হয়ে থাকা খুনির অন্ডকোষ নক্ষত্র-জ্বলা আকাশের প্রেক্ষাপটে কালো এক জোড়া সুপারির মতো দোল খায়।’  ‘বেলায়েত হোসেনের চার দরজার কালো ফিঙে পাখির মতো ছিমছাম গাড়িটি...’     ‘... গ্রামের কাঁচা রাস্তা এবং ফসলের ক্ষেতের উপর ছিন্ন নক্ষত্রের মতো কাগজের টুকরো ছড়াতে ছড়াতে বালিকাটি কেমন ছায়ার মতো হালকা অবয়বহীন হয়ে ওঠে।’  ‘... সে রঙের প্রামের ভেতর থেকে রোদের আলো পান করেছে।’

এমন বেশুমার উদাহরণ দেওয়া যেতেই পারে। কারণ উপন্যাসের যে ঘরাণা শহীদুল জহির তৈরি করেছেন তা কেবল ‘এক দেশে ছিল এক রাজা, আরেক দেশে ছিল এক রানির’ সরল উপাখ্যান বয়ান নয়। তিনি ভাষারও জাদুকর। গল্প বলার কৌশল নিয়ে তিনি ভাবেন। গল্পের সময়কাল, চরিত্রকে তিনি মহাকালের দিকে ধাবিত করেন। ফলে তার উপন্যাস ক্রমশ ‘বাস্তব এবং স্বপ্নের এক অবিভাজিত রূপে প্রকাশিত হয়’। 

** প্রেম-প্রসঙ্গ: শহীদুল জহিরের দুটো গল্প