ভ্রমণ

উজবেকিস্তানে মহাপরাক্রমশালী তৈমুরের সমাধিতে

ফেরার পথে আমি আবারও পথ হারাই। এবার আমি খুঁজতে শুরু করি, যে হোটেলে উঠেছি; সেটি। কিন্তু তার বদলে খুঁজে পাই সিনেমা হল। কিছুটা গথিক স্থাপত্যে নির্মিত সেই প্রেক্ষাগৃহ ভবনের সামনের টানা বারান্দা ছাদ ঠেকিয়ে রেখেছে সুবিশাল কয়েকটি থামের সাহায্যে। যেন পুরোনো কালের বনেদি বাড়ি। কোণের দিকে যদি একখানা পোস্টার না-টাঙানো থাকত, তবে আমি প্রেক্ষাগৃহ সন্দেহ করে এর সামনে দাঁড়াতাম কিনা সন্দেহ। ভেতরে ঢোকার একমাত্র দুয়ার আগলে দাঁড়িয়ে আছেন মোটাসোটা এক মহিলা। পরনে লম্বা ঝুল পোশাক; মখমলের। মাথার চুলগুলো একফালি কাপড় দিয়ে পিছমোড়া করে বাঁধা।

আমার উঁকিঝুঁকি দেওয়া খেয়াল করে ভদ্রমহিলা পৃথুলা হাতের ইশারায় ভেতরে আসতে বললেন। আমি ভেতরে গেলাম। এখানেও সেই ছাদে আটকে থাকা ঝাড়বাতি থেকে উজ্জ্বল আলোর ঝলকানি! ভদ্রমহিলা এবার আমাকে নিয়ে চললেন বাঁ ধারের একটি ঘরে। সেখান থেকে ঠুসঠাস গুলির শব্দ ভেসে আসছে। আমি অন্ধের মতো তাকে অনুসরণ করি। তারপর তিনি ঘরের পর্দা সরিয়ে আমাকে ভেতরে কোথাও বসে পড়ার ইঙ্গিত দিলেন। অর্থাৎ তিনি ধরেই নিয়েছেন, আমি এসেছি সিনেমা দেখতে। ওদিকে যে সিনেমা দেখতে ঢুকলাম, তার নাম কী, বিষয় কী, ভাষা কী- সেসব কিন্তু কিচ্ছুটি জানি না। সেই দৌবারিক মহিলার অতিথিপরায়ণতার আতিশয্য মেনে নিয়ে আমাকে অবশেষে ভিনদেশি সেই সিনেমা দেখার পেছনে কিছুটা সময় ব্যয় করতে হলো। সাব-টাইটেলের বালাই নেই। অন্ধভাবে দেখে যা বুঝলাম, এটি কোনো রুশ চলচ্চিত্র। আর বিষয়বস্তু- এক সৎ পুলিশ অফিসার কর্তৃক মাফিয়া সরদারের পেছনে ছুটে চলা। ভাগ্য ভালো, আমি হলে ঢোকার অল্প সময় পরই সেই অফিসার মাফিয়া সরদারকে সাজা প্রদানে সক্ষম হলেন। জ্বলে উঠল হলঘরের বাতি। গুনগুনিয়ে সিনেমা নিয়ে আলোচনারত দর্শকপালের সঙ্গে আমিও তখন বেরিয়ে এলাম বাইরের মুক্ত বায়ুতে।

পরদিন সকালে উঠেই চলে গেলাম হোটেলের প্রাতরাশ ঘরে। ঘরটির সিলিং বেশ উঁচুতে, যেটি ঢেকে আছে নীলাভ আল্পনার অন্তরালে। ওদিকে চারদিকের দেয়ালে আঁকা বিশালাকারের ম্যুরাল। তাগড়াই ঘোড়ায় চেপে কয়েক উজবেক নওজোয়ান প্রবেশ করছেন প্রাচীন এক নগরের প্রবেশদ্বার দিয়ে, এমন একটি ম্যুরাল ঘরের বাঁ দিকের পুরো দেয়াল দখল করে আছে। ঝকঝকে বার্নিশে ঢাকা লম্বাটে টেবিলে খাবার ছড়ানো। প্রথমেই বাটিতে রাখা কাশা। ওটা বলা চলে এখানকার প্রাতরাশের প্রধানতম খাদ্য। খেতে অনেকটা চিড়ে-দইয়ের মিশ্রণের মতো। কিছুটা আঠালো। এ ছাড়া আছে এক ধরনের পিঠা। মূলত দুধ-আটার মিশ্রণকে পাতলা রুটির মতো করে ভেজে নিয়ে তৈরি করা হয় এ খাবার। খেতে অনেকটা আমাদের পুলি পিঠার মতোই, পার্থক্য এই যে, এর মধ্যে কোনো ক্ষীর ঢুকিয়ে দেওয়া হয় না। সেই খাবারটির পাশে সেদ্ধ ডিমের ঝুড়ি। দেখলাম সেই মালিক ভদ্রলোক নিজেই খাবারের ট্রে গুছিয়ে রাখছেন। আমাকে দেখেই পোকায় খাওয়া দাঁতগুলো উন্মোচিত করে একগাল হাসি দিয়ে এগিয়ে এলেন। এ বেলায় কোথায় যাওয়া যায়, সে নিয়ে তার উপদেশ চাইলে তিনি হাতে থাকা ফর্কগুলো রুমালে মুছতে মুছতে বললেন, ‘প্রথমে গুর-এ-এমির-এ চলে যান। আমাদের হোটেল থেকে আই মাইল তিনেকের পথ। তারপর ওখান থেকে যাবেন রেজিস্তানে। হাঁটাপথ। কাজেই ওটুকুতে আপনার ট্যাক্সি লাগবে না। ট্যাক্সি লাগবে শুধু আই হোটেল থেকে গুর-এ-এমির-এ যেতে। আমি নিচের রিসেপশনে বলে দিচ্ছি। ওরা আপনাকে ট্যাক্সি ঠিক করে দেবে।’

উজবেকিস্তানের দর্শনীয় স্থাপনাগুলোয় নীল রঙের আধিক্য চোখে পড়ে

উজবেকিস্তানে ট্যাক্সি পাওয়া যায় জলের দরে। ঠকাঠকি নিয়ে খুব একটা ভাবতে হয় না। কারণ, ভাড়া যেখানে দুই ডলারের মতো, সেখানে ঠকিয়ে আর কতটাই-বা নেবে? হোটেলের বেয়ারা ছেলেটি অবশ্য তারপরও বেশ সতর্ক। ট্যাক্সিতে ওঠার আগে চালকের সঙ্গে দরদাম ঠিক করার পর আমাকে বলে দিলো বিশ হাজারের বেশি এক সম বেশি দেবেন না। না, বিশ হাজারের অঙ্ক শুনে চমকে ওঠার কিছু নেই! বিশ হাজার সম মানে টাকার অঙ্কে একশ ষাট টাকার মতো। ওদের এই বিশাল অঙ্কের টাকার জন্য গতকাল থেকে নিজেকে মহা ধনী বোধ হচ্ছে। ফিলিংটা মন্দ নয়। এ প্রসঙ্গে গত রাতের গল্প বলি। হোটেল থেকে বেরোনোর আগে হঠাৎ মনে হলো, সঙ্গে ডলার ছাড়া কিছু নেই। ওদিকে ততক্ষণে নিশ্চয়ই ব্যাংক সব বন্ধ হয়ে গেছে। শ’খানেক ডলার ভাঙিয়ে কিছু সম সঙ্গে রাখা দরকার। নতুবা কিছু কিনতে গেলেই তো বিপদে পড়তে হবে। হোটেল মালিককে সে কথা জানাতেই তিনি সহাস্যে বললেন, কোনো চিন্তা করবেন না। ডলার আমি ভাঙিয়ে দিচ্ছি। আপনি একটু দাঁড়ান, আমি ওপরতলার সিন্দুক থেকে সম নিয়ে আসছি। তিনি ফিরে এলেন সমের বিশাল এক বান্ডিল নিয়ে। দেখে আমার আক্কেলগুড়ুম! দু’ভাগ করে প্যান্টের দুই পকেটে চালান করার পর দেখি, দুই পকেটই ফুলে ঢোল হয়ে আছে। এভাবে বাইরে যাওয়া মানে পথের চোর-ছিনতাইকারীকে প্রলুব্ধ করে ডেকে আনা। কিন্তু পরে ভাবলাম, এ জন্মে কোনো দিন পকেট উপচানো টাকা নিয়ে তো ঘুরিনি। না হয় একদিন ঘুরেই দেখলাম, তাতে যদি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেই, ঘটুক না, ক্ষতি কী তাতে। এ কথা যোগ করতেই হয়, সেদিন সমরখন্দের অন্ধকার পথঘাট বেয়ে বেশ রাত অবধি হেঁটে বেড়ালেও কেউ আমার পথ রোধ করে বলেনি পকেটে যা আছে দিয়ে মানে মানে কেটে পড়ুন।

গুর-এ-এমির-এর মানে হলো সুলতানের সমাধি। নীল আর সাদা নকশাকাটা পাথরের মিনারশোভিত এ স্থাপনায় সত্যিই আছে এক মহা সুলতানের সমাধি, যিনি এককালে ভারতবর্ষ আক্রমণ করে নর কঙ্কালের পাহাড় জমিয়েছিলেন। উজবেক দেশের বীর কিন্তু ভারতবর্ষের ত্রাস সেই সুলতানের নাম এমির তেমুর। উপমহাদেশে আমরা যাকে চিনি তৈমুর হিসেবে। সেই তৈমুরের সমাধি গুর-এ-এমির-এর কিছুটা দূরে ট্যাক্সি আমাকে নামিয়ে দেয়। বাকিটুকু পায়ে হেঁটে যেতে হবে। দুই পাশে পার্ক। সকালের পাখিরা কংক্রিট বিছানো পথের এখানে-সেখানে নিশ্চিন্ত মনে হেঁটে বেড়াচ্ছে। আমি ওদের এড়িয়ে সমাধিস্থলের মূল ফটকে পৌঁছাই। দূর থেকে আসা একপাল উজবেক রমণী আমাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যায়। বাঁ ধারে ছোট্ট টিকিটঘর। টিকিটের মূল্য বেশি নয়। সাদা মলিন কাগজে ছাপা টিকিট দুয়ারের কাছটায় দাঁড়ানো একজনকে দেখালে তিনি সেটির এক কোণে ছিড়ে ফেরত দেন।

টিকিটখানা ফেরত পেয়ে আমি আমির তেমুরের ভেতরের চত্বরে প্রবেশ করি। চত্বরটি আয়তাকার। দুপাশে ঝাউগাছ। হাওয়ার অভাবে এ মুহূর্তে তারা নিশ্চল। মূল ভবনে ঢোকার মুখে বিশাল সৌধ। শীর্ষে গুহার ম্যালেকটাইটের মতো নকশা করা। হজরত মুহম্মদ (সা.) যে হেরা গুহায় বসে সাধনা করতেন, সেই গুহার প্রতিরূপেই এই নকশার কারুকাজ। সৌধের নিচে মসজিদের মিম্বরাকৃতির দরজা। তার নিচ দিয়ে মাথাটি গলিয়ে দিলে ভেতরের অপূর্ব বাগিচার উজ্জ্বল রঙের ফুলে চোখ ঝলসে যায়। সবুজ ঘাসের মাঝে লুটিয়ে থাকা সেই ফুলগুলো তো আছেই, সেই সঙ্গে আছে পোড়ামাটির পটে ভেসে থাকা গাঁদা ফুলের সম্ভার। ফুলভারে নত এই উঠানটির ওপাশে মূল সমাধি ভবন। ভেতরে ঢোকার সময়ে ছোট একটি জটলা তৈরি হয়। স্কুলের বড় ক্লাসে পড়ুয়া একপাল ছেলেমেয়ে এসেছে। তাদের মধ্যে মেয়েরা আরবি ক্যালিগ্রাফি আঁকা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় উড়নি বেঁধে নেয়। এদের অনেকের পরনেই জিনসের প্যান্ট-শার্ট, কেউবা পরেছে লম্বা ঝুলের স্কার্ট। মেয়েদের দল ভেতরে ঢুকে গেলে ওদের অনুগামী হয় সঙ্গের সেই ছেলেদের দলটি। ওদের পোশাকও বেশ পরিপাটি। দু’একজন এই গরমের মধ্যেও শার্টের ওপর চাপিয়েছে কালো কোট। মেয়েদের দলের সঙ্গে আসার ফলেই এই বাড়তি অঙ্গসজ্জা কিনা, কে জানে!

গুর-এ-এমির-এর মানে হলো সুলতানের সমাধি। নীল আর সাদা নকশাকাটা পাথরের মিনারশোভিত স্থাপনা

ভেতরে ঢোকার পর অন্ধকারাচ্ছন্ন প্যাসেজ। ছাদের কাছে ঢাকার কমলাপুর স্টেশনের ছাদের মতো নকশা করা। লোকজন কথা বলছে নিচু স্বরে। ভবনের শেষ দিকের ঘর থেকে মানুষের সমবেত গুনগুন শব্দ শুনে বুঝি, ওটাই মূল সমাধিঘর। ভেতরটা যেন সোনার চাদরে মোড়ানো। আকাশের কাছটায় উঠে যাওয়া ছাদ থেকে মেঝে অবধি সোনার জলের কারুকাজ। সামনের জমিনে দুটো সমাধি। একটি শ্বেতকায় মার্বেল পাথরের, অপরটি নিকষ কালো পাথরের। সেই কালো পাথরের কবরটি নাকি তৈমুরের। আর পাশেরটি তার নাতির। তিনিই তার প্রিয় নাতির মৃত্যুর পর এই সমাধি ভবন বানিয়েছিলেন। কথা ছিল, মৃত্যুর পর নিজের সমাধিটি হবে সমরখন্দ থেকে দক্ষিণের আরেক শহরে। কিন্তু যে সময়ে তার মৃত্যু হলো, সেটি ঘোর শীতকাল। ঘন তুষারের আড়ালে পথঘাট সব হারিয়ে গেছে। বাধ্য হয়ে তার অমাত্যবর্গ মৃতদেহ সমাধিস্থ করল নাতির পাশেই, সমরখন্দের এই ভবনে। তৈমুরের এই সমাধি নিয়ে আরেকটি লোকশ্রুতি আছে। সোভিয়েত সময়ে একজন বিখ্যাত পুরাতাত্ত্বিক সমরখন্দে ঘাঁটি গেড়ে প্রচুর খনন, সংরক্ষণের কাজ করেন। তার প্রতি এ অঞ্চলের মানুষের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। মৃত্যু অবধি তিনি সমরখন্দেই কাজ করে যান। কিন্তু এই বিশেষ সমাধিটি নিয়ে তিনি একটি বিতর্কিত কাজ করে বসেন, যেটি এখানকার লোকজন খুব একটা ভালোভাবে নেয়নি। তিনি ওই সময়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, সমাধি খুঁড়ে কঙ্কাল বের করে তিনি তৈমুরের দৈহিক গঠন পরীক্ষা করবেন। আরও একটি উদ্দেশ্য হলো, সত্যিই সেখানে তৈমুরের দেহাস্থি আছে কিনা, সেটি যাচাই করে দেখা। তো সেই কষ্টি পাথরের ভারী আবরণ সরানো হলো সমাধি থেকে। সেখানে তৈমুরের দেহাবশেষের সঙ্গে মিললো আরেকটি গোপন বার্তা, যেটি লেখা ছিল সমধি গহ্বরের অভ্যন্তরে। সেখানে লেখা ছিল, ‘আমার কবর যদি কোনো দিন খোলা হয়, তবে জেনে রেখো, আমার চেয়েও ভয়ঙ্কর কোনো শক্তি ধেয়ে আসবে এই দেশের পানে।’

সেই বার্তা পড়ে আতঙ্কে নীল হয়ে গিয়েছিল সবার মুখ। মজার ব্যাপার হলো, সেদিনের সেই ঘটনার তিন দিন পর হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করেন। আর উজবেক দেশ যেহেতু তখন ইউনিয়নের অংশ, তাই তৈমুরের হুমকিবাণীই যেন সত্য বলে প্রতীয়মান হয়। যাকগে, এগুলো অবশ্য অনেকটা কাকতালীয় ব্যাপার। কারণ, হিটলার তো সোভিয়েত দেশ আক্রমণের গোপন পাঁয়তারা করছিলেন তারও বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই। আর তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, সমাধি খোঁড়া না হলেও ওই বছর, অর্থাৎ ১৯৪১ সালে জার্মানি কর্তৃক সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ থেমে থাকত না। (চলেব)

** সমরখন্দে নীল মাদ্রাসা