ভ্রমণ

সিকিম ও গ্যাংটকের সুলুকসন্ধানে: দ্বিতীয় পর্ব    

আবারও গাড়ি সাইসাই করে পাহাড়ের আঁকাবাকা রাস্তা বেয়ে সাপের মতো উপরের দিকে তরতর করে উঠতে থাকল। বিশাল পাহাড়ের বুক থেকে পাথর কেটে প্রস্তুত রাস্তা ধরে উপরে ওঠার সময় নানারকম ভয় ঢুকে যাচ্ছে মনে। ভয় যে আমাদের একেবারে কাবু করছে না তা নয়। কিন্তু বেশিক্ষণ সাহস ধরে রাখা যাচ্ছে না। বিশেষ করে আমাদের গাড়ি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরে ওঠার সময়, বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়িগুলোকে সাইড দিতে খাড়া রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখতে হচ্ছে। তখন দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে থাকা পাহাড়ি খাদের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে- গাড়ি চালাতে মনের খেয়ালে যদি উনিশ-বিশ হয়ে যায় তবে নিমিষেই উপত্যকার কয়েক হাজার ফুট নিচের খাদে এখনি বুঝি গাড়ি গড়িয়ে পড়বে। 

মুহূর্তেই এক গা শিরশিরে অনুভূতি শরীরের রক্ত মাংস ভেদ করে অস্থিমজ্জায় ঢুকে যাচ্ছে। গাড়ি যত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে আমরা তত যেন মেঘের বাড়ির খুব কাছাকাছি চলে যাচ্ছি। গাইড মেয়েটি ড্রাইভারের সঙ্গে সামনের সিটে বসেছে। সে যখন মাঝেমধ্যে পেছনের পানে তাকিয়ে আমাদের সঙ্গে হিন্দিতে কথা বলছে তখন তার গালে টুকটুকে গোলাপি আভা দেখতে পাচ্ছি। দাঁতগুলো একদম সাদা।  আমি যখন গাইড মেয়েটিকে প্রথম পিছন থেকে দেখি তখন তার চুলগুলো ছিল কাকের পালকের মতো কালো। পরে ভালোভাবে লক্ষ্য করলাম, চুলে হালকা সোনালি প্রলেপ দেয়া হয়েছে। আসলে এখানকার স্থানীয় মেয়েগুলোর বেশিরভাগ নেপালি বংশদ্ভূত। দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের রাঙ্গামাটি বান্দরবানের উপজাতিদের মতো।   

গ্যাংটক থেকে সাঙ্গু লেক যাওয়ার পথে বিশাল পাহাড়গুলো পেঁয়াজের মতো বিভিন্ন স্তরে গড়ে উঠেছে। পাহাড়ের স্তরগুলোকে ভিত্তি করে ভূপৃষ্ঠ হতে রাস্তা নির্মাণ করে নেয়া হয়েছে ১২ হাজার ফুটেরও অধিক উচ্চতায়। হিমালয়ের পাদদেশে অধিক উচ্চতায় অবস্থিত হলেও এখানে সড়ক ব্যবস্থা আমাদের শহরের সড়ক ব্যবস্থার চেয়ে ভালো। পাহাড়ি এ রাস্তা তৈরির কর্মযজ্ঞ দেখে একটি কথা মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, বলা হয় মানুষ তার কর্মের সমান। আর এ জন্যই বোধহয় মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব বলা হয়। মানুষ চাইলে অনেক অসম্ভব কে সম্ভব করতে পারে। মানুষের পাখা না থাকলেও উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেছে। উড়োজাহাজে চড়ে আকাশে ওড়ার ব্যবস্থা ঠিকই করেছে। 

আমরা যত সাঙ্গুলেকের কাছাকাছি চলে যাচ্ছি ঠান্ডার দাপট তত প্রকট হয়ে উঠছে। ডানদিকে নিচে তাকালে চোখে পড়ছে ভয়াল গিরিখাদ। বামদিকে মাঝে মধ্যে মিলছে পাহাড়ের চূড়া থেকে রাস্তা অবধি নেমে আসা ছোট আর মাঝারি মায়াবি ঝরণা। প্রচণ্ড ঠান্ডার কারণে ঝরণার পানি সাদা বরফে পরিণত হয়ে আছে। যে কারণে পানির স্রোতধারা বা ঝরণার কলরব নেই। ঝরণার স্রোতধারার জল ঠান্ডায় জমে শুভ্র বরফ হয়ে জড়িয়ে ধরেছে পাথুরে পাহাড়ের বুক। শৃঙ্গের চূড়ায় সবুজঘেরা অরণ্যের হাতছানি না থাকলেও শৃঙ্গের কোলে মাথা রেখে যেন চলছে তুষারের প্রেম নিবেদনের ক্ষণ। সাঙ্গু লেকে পৌঁছানোর আগে একদল পুরোহিত আমাদের গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তাদের রান্না লুচি, নারিকেলের তৈরি পায়েসের প্রসাদ খেয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করল। পথচারী পুরোহিতগণ সাঙ্গুলেককে ধর্মীয়ভাবে খুব পবিত্র স্থান মনে করেন।  মাথার উপর কাকের ঝাঁকের মতো ঘন কালো মেঘ ওড়াউড়ি করছে, আমরা প্রসাদ খেয়ে আবারও রওনা হলাম।  

সহকর্মীদের সঙ্গে চিত্রাক হোটেলের সামনে 

সাঙ্গুলেকে পৌঁছে একটা বাঁকে গাড়ি দাঁড় করানোর পর মাটিতে পদচিহ্ন রেখে দেখতে পেলাম প্রকৃতিপ্রেমী অপরিচিত ভ্রমণপিপাসু মানুষের হাট বসেছে। সুউচ্চ উপত্যকার কোলে একটি ডিম্বাকৃতির হ্রদ। সম্ভবত তার পরিধি মাইল-খানেকের মতো। এখানে লেকে জল উপচে পড়ছে। হ্রদটির উপরের মাথায় একটা বিশাল পাহাড়ের বিশাল উঁচু চূড়া দিব্যি দাঁড়িয়ে আছে। মাথা উঁচু করে উপরের পাহাড়ের দিকে চোখ মেলে দৃষ্টির ক্যামেরায় ধরা পড়ল পাথরের উপর বড় বড় বরফ খণ্ড পড়ে এক অন্যরকম সাজে সজ্জিত হয়ে আছে স্থানটি। এ যেন পাথর আর বরফের মিলনভূমি। একে অপরের গায়ের সঙ্গে গা লেপটে আছে। সাঙ্গু লেকের স্বচ্ছ নীলাভ জলের উপরে থাকা মেঘের কুহেলিকা উড়ে বেড়াচ্ছে সাদা ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো। লেকের কোল ঘেঁষে থাকা রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে আছে বড় পশমওয়ালা তিব্বতি গরু। কেউ চমরিগাই বা ইয়াকের পিঠে চড়ে সাঙ্গু লেকের চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেবল কারে চড়ে শো শো করে লেকের পাশে থাকা পাহাড়ের চূড়ায় যাচ্ছে। আবার কেউবা বরফ হাতে নিয়ে খেলছে। এমন নৈসর্গিক সৌন্দর্যমণ্ডিত বরফাচ্ছন্ন পরিবেশ যে কোনো ভ্রমণপিপাসুকে মুহূর্তে মাতাল করে তুলবে। আমরা সাঙ্গু লেকের চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে মাতোয়ারা হয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম। 

সাঙ্গু লেক পুরোপুরি দর্শনের সবচেয়ে ভালো উপায় হলো কেবল কার রাইড এ উঠে উপরে যাওয়া। জানতে পারলাম, এখানকার ক্যাবল কারে চড়ে লেকসহ আশেপাশের বিস্তৃত এলাকার মনোরম দৃশ্য উপভোগ করা যায়। সাঙ্গুলেকের পাশে থাকা রোপওয়েতে/ কেবল কারে চড়ে চূড়ার শিখরে উঠতে জনপ্রতি ৩২৫ রুপি গুনতে হয়। আমাদের একজন ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে গাড়ির ভেতরে অবস্থান করায় এবং অন্য আরেকজনের সাহসে না কুলানোতে আমরা অকুতোভয় অদম্য ১২ জন লাইনে দাঁড়ালাম। টিমের ক্যাশিয়ার লাহিদুল এখানে পাহাড় বেয়ে আসতে ভয়ে আধমরা হয়ে গেছে। তারপর শীতে প্রায় জমে যাচ্ছে। যে কারণে সে সাঙ্গুলেকের পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার সাহস দেখাল না। কেবল কার প্রতি ট্রিপে চারজন করে নিয়ে যাচ্ছে। 

আমরা চারজন যখন কেবল কারে চড়ে উপরে উঠে যাচ্ছি তখন নিচের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি কয়েক ফিটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। ঘন কুয়াশার কারণে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছানোর পর দেখতে পেলাম বিশাল কৃষ্ণবর্ণের পাথর খণ্ডগুলো বরফ খণ্ড মাথায় নিয়ে উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের চূড়ায় তাপমাত্রা মাইনাস ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস চলছে। বরফে ঢাকা পাহাড়ের সৌন্দর্যই অন্যরকম। সাঙ্গুলেকের আকাশ প্রচন্ডরকম মেঘলা হয়ে আছে। গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মতো বরফের ছোট ছোট কুঁচিগুলো উপর থেকে আমাদের মাথায় পড়ছে। বইছে প্রচন্ড রকম  হিমেল ঠান্ডা হাওয়া।

শীতের গরম পোশাক পরলেও ঠান্ডায় শরীরের কাঁপুনি থামছে না। শরীর নিজে থেকে কম্পন সৃষ্টি করছে আর ঠান্ডায় দেহের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তীব্র ঠান্ডায় নিজেকে উষ্ণ রাখতে কয়েকজন পর্যটক এক হাতে সিগারেট আর অন্য হাতে বিয়ার ও বেশি অ্যালকোহলযুক্ত পানীয় পান করছে খুব আয়েশ করে। আগেই শুনেছি সাঙ্গু লেকের পাহাড়ের চূড়ায় আসার পর অনেকের শ্বাস প্রশ্বাস নিতে সমস্যা হয়। কিন্তু আমাদের কারো কোন সমস্যা হলো না। এদিকে সূর্য মামা ঘন কুয়াশার মোড়কে আটকে থাকার কারণে দিগন্তের পানে তাকিয়ে না দেখা যাচ্ছে সাঙ্গুলেকের চারপাশের দৃশ্য, না দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের নিচের গিরিখাদ। 

প্রকৃতি অনুকূলে না থাকার কারণে আমরা আরও বেশি গা শিউরে ওঠা রোমাঞ্চকর দৃশ্যপট দেখা হতে বঞ্চিত হলাম। কিছুক্ষণ পর আমরা আবার ক্যাবল কারে চড়ে ফিরতি পথে সাঙ্গুলেকের তীরে ফিরে এলাম। ফিরে এসে অন্য পর্যটকদের ইয়াকের পিঠে চড়ে ঘুরে বেড়াতে দেখে নিজেরও লোভ হলো তুলতুলে ইয়াকের চর্বিযুক্ত পিঠে বসার। জানতে পারলাম ইয়াকের পিঠে চড়ে লেকের চারদিকে এক পাক খেতে ৬৫০ রুপি আর শুধু পিঠে বসে ছবি ওঠাতে ১০০ রুপি লাগে। আমি শুধু ছবি ওঠানোর জন্য যখন ইয়াকের পিঠে বসে পড়েছি তখন আমার বস ইয়াসীন আলী খুব মজা করে আমার ছবি তুলছিলেন। অনেকক্ষণ পর তার ঠোঁটে হাসির ঝিলিক বয়ে গেল। 

বসের হাসি দেখে ইয়াকের পিঠে চড়ে যে আনন্দ পাচ্ছিলাম তা যেন মুহূর্তে দ্বিগুণ হয়ে গেল। সাঙ্গু লেক থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দূরে ভারত-চীন সীমান্ত নাথুলা পাস এর অবস্থান হলেও আঁকাবাঁকা রাস্তার কারণে সীমান্তে পৌঁছতে প্রায় ১৮ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। আমাদের সবার খুব ইচ্ছে ছিল নাথুলা পাস, জিরো পয়েন্টে গিয়ে আরও বেশি সাদা বরফের মধ্যে আনন্দের মাত্রা বাড়িয়ে নেয়ার। এই সময় ভারতীয় নাগরিক ছাড়া কোনো বিদেশির এই সীমান্তে যাওয়ার অনুমতি নেই। আমরা আরও কিছুক্ষণ সাঙ্গুলেকে অবস্থান করে গ্যাংটক শহরের পথে যাত্রা শুরু করলাম। 

পড়ন্ত বিকালের আগেই আমরা যখন সাঙ্গুলেক হতে গ্যাংটক শহরের দিকে ফিরছি তখনও গাড়ি সর্পিল ভাবে বয়ে চলা লেকের স্রোতধারার মতো শুধু নিচের দিকে নামছে আর নামছে। এক সহকর্মী সাঙ্গু লেক হতে ফিরে এসে ঠান্ডা জ্বরের খপ্পরে পড়ে গেলেন। 

বেলা দুপুর গড়িয়ে বিকালের কাছাকাছি। আমরা আবারও সবাই হোটেল থেকে চলে এলাম শহরের এম.জি. মার্গ বা মহাত্মা গান্ধী মার্গে দুপুরের খাবার সেরে কেনাকাটা ও আড্ডা দেয়ার জন্য। এসেই জানতে পারলাম শহরের অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান এম.জি মার্গ শনিবার সাপ্তাহিক বন্ধ। তবে আশেপাশের অন্য রোড ও ফুটপাতের দোকানগুলো খোলা। বিলম্বে দুপুরের আহার সেরে কেউবা শপিংমলে আর কেউ  ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেরে নিচ্ছি নিজেদের  প্রয়োজনীয় কেনাকাটা। শহরে চোখে পড়ছে নারীদের পসরা সাজিয়ে বসার দৃশ্য। সস্তায় বিক্রি হচ্ছে কাশ্মীরি শাল চাদর ও অন্যান্য পণ্য। আমাদের সঙ্গে কেনাকাটায় ব্যস্ত অন্যান্য পর্যটক। 

সব জায়গায় নারীদের সরব উপস্থিতি আর নারীদের বিক্রয়কর্মী রুপে মেলে ধরার ভাবে মনে হচ্ছে  গ্যাংটকে মূলত ছেলে অথবা পুরুষ মানুষ অলস প্রকৃতির এবং নারীরা পুরুষদের চেয়ে  অধিক কর্মঠ। কেনাকাটা শেষে সন্ধায় আমরা এম.জি মার্গে সবাই সমবেত হয়ে বেশ কিছুক্ষণ আড্ডায় মগ্ন হয়ে বিভিন্ন ঢংয়ে ছবি তুলে রাত দশটার মধ্যেই পায়ে হেঁটে হোটেলে পৌঁছালাম।

সকালে হিমালয়ের কোলে অসাধারণ সৌন্দর্যের মেঘের রাজ্য দার্জিলিং ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আমরা রাতেই প্রস্তুত হয়ে থাকলাম। আর ভাবতে থাকলাম কখন পাড়ি জমাতে পারব পাহাড় কন্যা বলে অভিহিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি দার্জিলিং শহরে।

রবিবার সকালে আমরা হোটেল ত্যাগ করে গ্যাংটক থেকে দার্জিলিং যাওয়ার জন্য স্ট্যান্ডে এসে পৌঁছালাম। ভাড়া করা দুটো জিপ গাড়ির মধ্যে আমাদেরটা আগে রওনা হলো। রেম্পো থেকে গ্যাংটক আসার পথে রাত্রি ছিল। আর ফিরতি পথে দিনের আলো। যে কারণে প্রাকৃতিক কোনো দৃশ্য চোখের আড়াল হতে পারছে না। জায়গায়-জায়গায় জঙ্গল পরিষ্কার করে পাহাড়ের ঢালুতে জুমচাষ করা হয়েছে। পাহাড়ের নিচ থেকে চূড়া পর্যন্ত ভূমিতে গড়ে ওঠা ছোট-বড় বসতবাড়িগুলো যা খুব কাছ থেকে দেখছি । আরও বেশ কিছ দূর  এগিয়ে যাওয়ার পর চোখে পড়ছে- পাহাড়ের দুই ধারের ভাজের মাঝে শুয়ে আছে ছোট্ট একটি হ্রদ। যার বুকের উপর দিয়ে প্রবাহিত স্বচ্ছ নীলাভ-সাদা পানি দ্যুতি ছড়িয়ে যাচ্ছে। হৃদের কোলে শুয়ে আছে বিশাল বিশাল কালো পাথর খণ্ড। পাথরগুলোর গায়ে কৃষ্ণবর্ণ আর দাগ দেখে মনে হচ্ছে এগুলো যেন শতাব্দীর চিহ্ন বয়ে চলেছে। এভাবেই আমরা এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়, তারপর আরও উঁচু পাহাড়ি রাস্তা ডিঙ্গিয়ে দার্জিলিংয়ের ঢালু সীমানায় এসে পৌঁছালাম। 

ভারতের সবচেয়ে সুন্দর ও সুরক্ষিত পাহাড়ি রাস্তা বলে হয়ত এর খ্যাতি আছে। শিলাখণ্ডের বুক চিরে প্রস্তুত করা রাস্তাগুলোর জন্যে সিকিম ও দার্জিলিংয়ের মানুষ অনায়াসে গর্ব বোধ করতে পারেন। দার্জিলিং  পৌঁছাবার পাহাড়ি রাস্তাগুলো সিকিমের মতো ভয়াবহ নয়। তাছাড়া দুপাশের অপরূপ পাহাড়ি সৌন্দর্য্য মনের সব ভয় গায়েব করে দিচ্ছে। দার্জিলিংয়ের ঢালু স্থান থেকে আঁকাবাকা পথ বেয়ে উপরে  উঠতে উঠতে লাভারস মিট ভিউ পয়েন্টে এসে গাড়ি থামল। শীতল মৃদু হাওয়া বইছে। গাড়ি থেকে নেমেই চোখে পড়ল বন্য বানরের দল জোড়ায় জোড়ায় গাছের ডালে বসে আছে। কয়েক জোড়া বানর বাচ্চাসহ রাস্তায় নেমে এসে ঘোরাঘুরি করছে। পয়েন্টের দু’দিকে দার্জিলিংয়ের সুন্দরী মেয়েরা চকোলেট চা কফি বিস্কুট আর ফলের দোকান বসিয়ে বসে আছে।

লেখক উপভোগ করছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

লাভারস মিট ভিউ পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে চোখ মেলতেই চোখ ধাঁধানো দৃশ্যপট দেখে যেন মুগ্ধতার চরমে পৌঁছে যাচ্ছি। আমরা দাঁড়িয়ে থাকা উপত্যকা হতে নিচের প্রান্তের চারিদিক গাছের সবুজ বেষ্টিত ছোট-বড় পাহাড়ে ঘেরা। নিচের সবুজ গাছগাছালির উপর দুপুরের সূর্যের সোনালি কাঁচা রোদ পড়ে পাতাগুলো চিকচিক করে উঠছে। নিচের পাহাড়ের দিকে তাকাতেই চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। লাভার পয়েন্ট যেন সমতল ভূমির বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা এক টুকরো পাহাড়ি স্বর্গ। অপরূপ সৌন্দর্যের এক অসাধারণ প্রাকৃতিক লীলাভূমি যার সব কিছুতেই মুগ্ধতার রেশ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রকৃতির সব কিছুতেই এক দুর্দান্ত কিছু শক্তি রয়েছে যা জীবনকে ভালোবাসতে শেখায়, উদার হতে শেখায়। প্রকৃতির সান্নিধ্যে এলে মানুষের অপ্রকৃতিস্থ মনও সুস্থ হয়ে ওঠে। দার্জিলিং শহরে পৌঁছার তাড়া আছে বলেই আমরা ৩০ মিনিটের মতো অবস্থান করে, স্মৃতি চিহ্ন হিসাবে ক্যামেরা বন্দী হয়ে আবারও রাস্তা বেয়ে আরও উপরের দিকে উঠতে থাকলাম। 

যতই গাড়ি উপরে উঠতে থাকল তত ঠাণ্ডা বাড়তে থাকলো। আর উড়ে যাওয়া মেঘের পরশ নিয়েও গাড়ি ছুটতে লাগল দুর্বার ঘোড়ার মতো প্রচণ্ড গতিতে। আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে যাওয়ার সময় মাথার উপরের চা বাগানে ঘেরা গোর্খা স্টেডিয়াম পেরিয়ে, আর বনবাদাড়ের মধ্য দিয়ে হিলকার্ট রোডের আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে অবশেষে পৃথিবীর অন্যতম রোমাঞ্চকর ভ্রমণভূমি দার্জিলিং এসে পৌঁছালাম। (শেষ)

পড়ুন : প্রথম পর্ব : সিকিম ও গ্যাংটকের সুলুকসন্ধানে