ঢাকা     রোববার   ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

সিকিম ও গ্যাংটকের সুলুকসন্ধানে

মো. জাহিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৮, ১২ এপ্রিল ২০২৩   আপডেট: ১৭:২৫, ১২ এপ্রিল ২০২৩
সিকিম ও গ্যাংটকের সুলুকসন্ধানে

গ্যাংটকের মহাত্মা গান্ধী মার্গে

রূপসী বাংলার অভ্যন্তরে শীতে বরফের আস্তর পড়ে এমন স্থান খুঁজে পাওয়া যায় না। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে বরফ দেখার জন্য দেশের বাইরে কোথাও বেড়াতে যাব। সুবিশাল পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে অবগাহন করব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে। পাহাড়ের চূড়ার খোলা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে গায়ে লাগাব শীতল ঝিরিঝিরি হাওয়া। নিসর্গের অসীমতায় ভেসে বেড়াব আর চোখ মেলে ধরব নীল আকাশের বিশালতায়। 

আমাদের দেশে শীত পেরিয়ে বসন্ত এসে গেছে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ওয়ালটন করপোরেট অফিসের তৃতীয় তলার বেলকনিতে টবে ফুটে থাকা কিছু বর্ণিল ফুল আভা ছড়িয়ে জানান দিচ্ছে বসন্তের আগমনী বার্তা। অফিসে ফাগুন বরণ অনুষ্ঠানে অনুভব করলাম শীতের তীব্রতা কমে গিয়ে ফাগুনের হাওয়া প্রকৃতিতে বইতে শুরু করেছে। আমাদের ভ্রমণের দিনক্ষণ আগেই স্থির করা ছিল। পাঁচ দিনের ভ্রমণে ইন্ডিয়ার সিকিম ও দার্জিলিং বেড়াতে যাব। ভ্রমণসঙ্গী আমরা মূলত চৌদ্দ জন সহকর্মী। আমাদের দলের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া বেশিরভাগ সদস্যের দেশের সীমানার চৌহদ্দি পেরিয়ে বাইরে ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। আমার ভাবনাগুলো বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়েই শুরু হলো পর্যটকের পদযাত্রা।

প্রতিদিন অফিসের রুটিন আর অফিস থেকে ফিরে সংসারের কাজ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে ১৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার রাত নয়টায় কল্যাণপুর থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হলো বাসের মাধ্যমে। প্রথম গন্তব্য বুড়িমারি-বাংলাবান্দা বর্ডার অতিক্রম করে শিলিগুড়ি। আমরা পরদিন সকাল ৭টায় লালমনিরহাটের  বুড়িমারি পৌঁছে কিছুক্ষণের মধ্যে নাস্তা সেরে নিলাম। আমাদের দলনেতা জনাব ইয়াসিন আলী, ওয়ালটন কোম্পানির অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগের বিভাগীয় (প্লাজা) প্রধান। ভারতের অন্যতম রোমাঞ্চকর দুটো স্থান ভ্রমণের উদ্দেশ্যে সঞ্জয় দেবকে হোটেল ভাড়া সংক্রান্ত দায়িত্ব, তন্ময়কে ট্রান্সপোর্ট, লাহিদুলকে খরচের জন্য ক্যাশের দায়িত্ব আর মোজাম্মেলকে হিন্দি ভাষায় কথা বলে দোভাষীর দায়িত্ব পালন করার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হলো। বাংলাদেশ-ভারতের বুড়িমারি-চ্যাংড়াবান্ধা বর্ডারের ইমিগ্রেশনের যাবতীয় কার্য সম্পাদন করে স্বল্প সময়েই সীমান্ত পাড়ি দিলাম। ওপারের সীমান্তে ডলার আর টাকাকে রুপিতে রুপান্তর করতে করতে বেলা ১১টা বেজে গেল।  

ভ্রমণসঙ্গীদের সঙ্গে আনন্দ উল্লাস

চ্যাংড়াবান্ধা হতে শিলিগুড়ি প্রতিটি ৪ হাজার রুপি করে দুটো টাটা সুমো জিপ ভাড়া করা হলো। শিলিগুড়ির সমতল রাস্তা ধরে গাড়ি সাইসাই করে চলছে। গাড়ির জানালা দিয়ে দৃষ্টি মেলতেই চোখে পড়ছে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ আর মাঝে মাঝে কৃষকদের ঘরবাড়ি। ঘরগুলো বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মতোই, যা বসবাসকারী মানুষের আর্থিক দৈন্য স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে শিলিগুড়ির প্রত্যান্ত অঞ্চলের মানুষ ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছোয়া তেমন পায়নি। চলন্ত গাড়িতে কখনো চোখ বন্ধ করে ভাবছি সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক এবং দার্জিলিং-এর প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে কখন একান্তভাবে মিশে গিয়ে  নিজের ক্লান্তি শ্রান্তি মুছে মন উৎফুল্ল করতে পারব। গাড়িতে বসে দৃশ্যপট দেখতে দেখতে আর ভাবনার ঘোরে ঘুরতে ঘুরতে  শিলিগুড়ি এসে পৌঁছাতে দুপুর দুটো বেজে গেল।

দীর্ঘ বাস যাত্রার কারণে বেশ ক্ষুধা লেগেছে। কিন্তু শিলিগুড়ি থেকে সিকিমের রেম্পো পৌঁছে সন্ধ্যার মধ্যে ইমিগ্রেশন হতে অনুমোদন নিতে না পারলে গ্যাংটক যাওয়া সম্ভব হবে না। আমরা আবারও দুটো জিপ গাড়ি ভাড়া করার সময় সিদ্ধান্ত নিলাম- শিলিগুড়িতে খাবার হোটেল খুঁজে সময় নষ্ট না করে মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে কোনো রেষ্টুরেন্টে দুপুরের খাবার সেরে নেব। আমরা আবারও শিলিগুড়ি হতে যাত্রা শুরু করলাম সিকিমের পথে। কিছুদূর যাওয়ার পর সবুজ চায়ের বাগান যেন আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকতে লাগল। চা বাগানগুলো অপরূপ সুন্দর যেন সবুজের এক সমতল সিঁড়ি। সমতল ভূমিতেও যে এত সুন্দর চা বাগান হতে পারে সেটা শিলিগুড়ির রাস্তা পেরিয়ে গ্যাংটক রওনা না হলে হয়ত নিজের কাছে  অধরাই থেকে যেত।

সমতল ভূমির চা বাগানের নিরিবিলি পেরিয়ে আরও বেশ কয়েক মাইল যেতেই দেখা মিলল সবুজময় পাহাড়। পড়ন্ত বিকালে পাহাড়ি বিশাল উঁচু রাস্তায় যখন আমাদের গাড়ি সর্পিলভাবে চলছে, তখন নিচের দিকে তাকিয়ে দেখা গেল পাথুরে সরু হ্রদ। দুপাশে পাহাড় আর মাঝখানে বয়ে চলা হ্রদের পানির গভীরতা না থাকলেও আছে স্রোতের তীব্রতা। স্বচ্ছ নীলাভ জলের খরস্রোত লেকের মাঝে পড়ে থাকা বিশাল বিশাল পাথর খণ্ডে ধাক্কা খেয়ে নিজের গতিপথ পরিবর্তন করে এগিয়ে যাচ্ছে নিজের মতো দুরন্ত গতিতে। দুপাশে পাহাড় আর মধ্যখানে লেকের যুগলবন্দী চমৎকার দৃশ্যপট দেখে রোমাঞ্চকর অনুভূতি জেগে উঠছে মনে। পাহাড়ের সবুজ আর লেকের অল্প জলের তীব্র স্রোতধারা দেখতে দেখতে পথ চলছি এমন সময় মাঝে মাঝে দেখা মিলছে বানরের। ওরা উপদলে বিভক্ত হয়ে রাস্তার বাঁকে বাঁকে বসে আছে। গাড়ির ড্রাইভার হঠাৎ একটা রেষ্টুরেন্টের সামনে গাড়ি পার্কিং করলেন। আমরা রেষ্টুরেন্টে ১১টি আইটেমের ইন্ডিয়ান খাবারের মেনু সিলেক্ট করলাম- ভাত রুটি আলু ভাজি সবজি ডাল মিষ্টি ও নাম না জানা আরও কয়েকটি পদের খাবার। জন প্রতি ২২০ রুপি দিয়ে খাওয়া শেষ করে আবারও যাত্রা শুরু করলাম। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে রেম্পো এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বিকাল পাঁচটা বেজে গেল।

রেম্পো সিকিম রাজ্যের দূতাবাসের মতো। ১৯৭৫ সালে গণভোটের পরে ভারতের সাথে একীভূত হওয়ার আগে সিকিম একটি স্বাধীন দেশ ছিল। যার কারণে বিদেশিদের সিকিমে প্রবেশের আগে বাধ্যতামূলক অনুমতি নিতে হয়। আধা ঘণ্টার মধ্যে পাসপোর্টে আগমন ও বহির্গমনের সময়সহ সিল মারা হলো। অনুমোদন পাওয়ার পর আবারও গাড়ি সাপের মতো করে পাহাড়ি  ঢালু বা উঁচু নিচু রাস্তা ধরে এগিয়ে চলল গ্যাংটকের পথে। আমরা যতই গ্যাংটকের কাছাকাছি এসে পৌঁছাচ্ছি ততই যেন বড় বড় পাহাড়ের দেখা মিলছে আর পাহাড়গুলো নিজেদের রূপবৈচিত্র মেলে ধরছে ভিন্ন আঙ্গিকে। অবশেষে রেম্পো থেকে  আরও প্রায় তিন ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা গ্যাংটক পৌঁছালাম। ড্র্যাইভারের সাথে কথা ছিল সাড়ে চার হাজার রুপির ভাড়াতে আমাদের হোটেলে পৌঁছে দেবে। কিন্তু  এমজি মার্গ বা মহাত্মা গান্ধী মার্গ এর আগেই আমাদের নামিয়ে দিলো। হোটেলে পৌঁছানোর জন্য অতিরিক্ত এক হাজার রুপি করে দাবি করে বসল। 

দার্জিলিংয়ের লাভ পয়েন্ট থেকে পাখির চোখে দেখা দৃশ্য

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত্রি হওয়ার পথে। অর্থাৎ ঘড়িতে সময় ৮টার কাছাকাছি। আমরা  শহরের উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে আবারও ট্যাক্সির জন্য অপেক্ষা করছি। তখন শহরের উঁচু স্থানে দাঁড়িয়ে যত দূর দৃষ্টির সীমানা যায় তত দূর দৃষ্টি রেখে আশেপাশের বিশাল বিশাল পাহাড় দেখে মনে হচ্ছে, পাহাড়গুলোর আগা থেকে গোড়া অবধি  বিয়ে বাড়ির মতো ছোট ছোট লাইটিং দিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল হাজার হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের খাদের কিনার হতে চূড়া পর্যন্ত খাপে খাপে মানুষের বসতি স্থাপন করা হয়েছে যার প্রায় সবগুলো ইট পাথরে নির্মাণ করা বাড়ি। বাড়িগুলোর লাইটিংএর কারণে পুরো পাহাড় সাজ সাজ রবে ফুটে উঠেছে। পাহাড়ের কোলে গড়ে ওঠা বাড়িগুলোর লাইটিং দেখে মনে হচ্ছে- যেন ছোটো ছোটো জোনাকি পোকা পিদিম জ্বালিয়ে গাছের ডালে নোঙ্গর ফেলে চুপ করে বসে আছে।  

হোটেল খুঁজে পাবার জন্য কয়েকবার গাড়ি থামিয়ে পথচারীদের কাছ থেকে পথনির্দেশ নিতে হলো। অবশেষে আমরা রাত সাড়ে আটটা নাগাদ গ্যাংটক শহর থেকে নিচের দিকে অবস্থিত হোটেল চিত্রাক বুটিক-এ চেক ইন করলাম। রাস্তা বরাবর থাকা হোটেলের রিসিপশনে প্রয়োজনীয় আনুষাঙ্গিকতা শেষ করার পর ম্যানেজার আমাদের সিঁড়ি বেয়ে নিচের দিক নামতে বললেন। রাস্তা লেভেল হতে আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়ার কথা শুনে প্রথমে কিছুটা থতমত খেয়ে গেলাম। তারপর রুমে প্রবেশ করে ফ্রেশ হয়ে জানালা দিয়ে তাকাতেই বুঝতে পারলাম ম্যানেজার কেন নিচের দিকে আসতে বলেছিল। অর্থাৎ রাস্তার পাশে খাদের কিনারের মাটি হতে ৬ তলা পর্যন্ত বিল্ডিং উঁচু হওয়ার পর টপ ফ্লোর রাস্তার সাথে এসে মিশেছে। জানালা খুলে তাকাতেই পাহাড়ি শীতল হাওয়া এক নিমিষেই আমার ঠান্ডা শরীর আরও ঠান্ডা করে দিলো।  আরো ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখা গেল, মহিষ যেভাবে নদীর তলায় পা রেখে পুরো দেহ পানিতে ডুবিয়ে মাথাটা জলের উপর শূন্যে ভাসিয়ে রাখে। অনুরূপভাবে শহরের বেশিরভাগ বিল্ডিংগুলো পাহাড়ের খাদ হতে নির্মাণ শুরু হয়ে মাথাটা রাস্তার উপর মহিষের মতো জাগিয়ে রেখেছে। আমরা ফ্রেশ হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই হোটেলের সামনে থেকে ট্যাক্সি ক্যাব ভাড়া করে আবারও গ্যাংটক শহরের দিকে রওনা হলাম রাতের খাবার সেরে নেওয়ার জন্য। 

শহরে এসে আমরা প্রথমেই অন্যতম প্রধান দর্শনীয় স্থান মহাত্মা গান্ধী মার্গ-এ চলে আসলাম কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার জন্য। এম.জি. মার্গের শুরুতেই মহাত্মা গান্ধীর খুব সুন্দর একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর গায়ে চাদর, পরনে ধুতি আর হাতে রাখা একটি লাঠি। রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে আছে বহুতল বাণিজ্যিক ভবন। ভবনগুলোয় বিভিন্ন নামিদামী ব্র্যান্ডের শো-রুমগুলো সুসজ্জিত অবস্থায় দেখে মনে হচ্ছে এমজি মার্গ গ্যাংটক শহরের ব্যবসায়িক কার্যক্রমের কেন্দ্রস্থল।
রাস্তাটি খুবই পরিষ্কার। চকচকে ঝকঝকে করে রাখা হয়েছে। গ্যাংটকের এমজি মার্গের রাস্তায় ধূমপান, আবর্জনা ফেলা এবং থুতু ফেলা আইনত নিষিদ্ধ। অথচ আমাদের আজব শহর ঢাকার এত ‘উন্নয়ন’ তবুও কত ভোগান্তি! আর কয়েক দিন পরপর হয়ে উঠছে বিশ্বের বায়ু দূষণের শহর। 

গ্যাংটকের মহাত্মা গান্ধী মার্গে সহকর্মীর সঙ্গে লেখক

তাছাড়া রাস্তার মাঝখানের বাগান পরিপূর্ণ করে রাখা হয়েছে বিভিন্ন প্রকার ঝুলন্ত টব ও মাটিতে বপন করা  ফুল ও সৌন্দর্য বর্ধনকারী গাছের সমাহারে। সত্যিই সুন্দর সুন্দর ফুল দিয়ে সাজানো দারুণ দর্শনীয় জায়গা এই এমজি মার্গ। গাছের প্রতিটি ডাল ও পাতায় বিভিন্ন রঙ-বেরঙের লাইটিং করে রাস্তার সৌন্দর্যের মাত্রা যেন আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিছুদূর পরপর বাগানের মাঝে স্থাপন করা হয়েছে কৃত্রিম ঝরণা।  

সব মিলিয়ে কৃত্রিম আর প্রাকৃতিক পরিবেশের সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। যা ভ্রমণপিয়াসী মানুষের মধ্যে অন্য রকমের এক আকর্ষণ সৃষ্টি করছে। বাগানের গা ঘেঁষে দুধারে রাখা বেঞ্চগুলোতে বসে ভ্রমণার্থীরা কেউ নীরবে দৃশ্যপট দেখে মুগ্ধ হয়ে আনন্দময় মুহূর্ত উপভোগ করছে। কেউবা বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি ও সেলফি তোলায় ব্যস্ত। আমরাও এমজি মার্গে নিজেদের পদধ্বনিকে স্মৃতিচিহ্ন করে রাখার জন্য বিভিন্ন ঢং আর ভঙ্গিতে মোবাইলে ক্যামেরা বন্দী হলাম। রাস্তার শেষ প্রান্তে স্থাপন করা হয়েছে রেড পান্ডার একটি বিশাল মূর্তি। এমজি মার্গ ঘোরাঘুরি করে মুগ্ধ হয়ে আমাদের দু’দিনের গাড়ি যাত্রার ক্লান্তি যেন অনেকটাই দূর হয়ে গেল। অবশেষে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম রাতের খাবারের জন্য আশেপাশে  মুসলিমদের জন্য জান্নাত বিরিয়ানি, আসলাম বিরিয়ানি আর মুসলিম হোটেল বিখ্যাত। আমরা আসলাম বিরিয়ানিতে গিয়ে খুব সস্তায় তৃপ্তি সহকারে গরুর মাংস দিয়ে  রাতের আহার সেরে নিলাম।

ফিরতি পথে আমরা হোটেলে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি ভাড়া না করে পায়ে হেঁটে যাওয়ার সিন্ধান্ত নিলাম। হাঁটার পথে চোখে পড়ল গ্যাংটক শহরের অলিতে-গলিতে মদের বার। পসরা সাজিয়ে বসে আছে। মদের দোকানের ঘনত্ব আর সাজানো বোতল দেখে মনে হচ্ছে গ্যাংটক শহর যেন মাতালদের জন্য এক অভয়ারণ্য এবং স্বর্গরাজ্য। এক সহকর্মী বার-এ প্রবেশ করে সহাস্যে বিক্রয়কর্মী সুন্দরী নেপালী মেয়ের কাছে হিন্দি ভাষায় জানতে চাইলো- তোমাদের এখানে মদ পানির চেয়েও সস্তা? তোমরা কি সব সময় এগুলো পান করো নাকি? প্রতি উত্তরে মেয়েটি হাসতে হাসতে কৌশলে জানাল- পর্যটক আর শুধু স্থানীয় যারা তথাকথিত সভ্যতার সংস্পর্শে এসেছে তারা ছাড়া আমাদের পাহাড়ি লোকেরা মদ তেমন খায় না। 

হোটেলে পৌঁছানোর পর ম্যানেজার আমাদের জানালো শনিবার সকালে ছাঙ্গু লেকে যাওয়ার অনুমোদন মিলেছে আর দুটো জিপ গাড়িও ভাড়া করে রাখা হয়েছে। গ্যাংটক থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছাঙ্গু লেকে যেতে হলে আগে থেকেই অনুমতি নিয়ে রাখতে হয়। মুলত ছাঙ্গু লেকে ভ্রমণের উদ্দেশ্যই আমাদের গ্যাংটক আসা। সমতল ভূমি থেকে ১২ হাজার ৫০০ ফুটের অধিক উচ্চতায় অবস্থিত ছাঙ্গু লেক সাদা বরফে আচ্ছাদিত থাকার আকর্ষণই মূলত আমাদের পর্যটক বানিয়ে এত দূর টেনে নিয়ে এসেছে । যেখানে বাংলাদেশের প্রাকৃতিক ভূ-স্বর্গখ্যাত খাগড়াছড়ির সাজেক ভ্যালির উচ্চতা ভূ-পৃষ্ঠ থেকে মাত্র ১৮০০ ফুট। সকাল আটটায়  শহর থেকে যাত্রা শুরু হবে ছাঙ্গু লেকের দিকে। তাই রিসিপশন হতে ২৪ ঘণ্টার টানা ভ্রমণের ক্লান্ত শরীর নিয়ে দ্রত রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি ঘুমের রাজ্যে ডুবে গেলাম। 

ভ্রমণের জন্য হাতে সময় খুব সীমিত। তাই রাতে ঘুমানোর সময় পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম, সূর্যের আলো গ্যাংটকের আকাশকে আলোকিত করার আগেই ভোরে পাহাড়ি জনপদে ঘুরতে বেরিয়ে পড়ব। একাকিত্ব আমার কাছে সবচেয়ে নিঃস্বার্থ বন্ধু মনে হয়। কারণ এ সময় ভাবনার পালে হাওয়া লাগিয়ে যেখানে খুশি সেখানে ইচ্ছে মতো প্রবেশ করা যায়। ভোরে সূর্যের আলো পুরোপুরি ফোটার আগেই আমি হোটেল হতে একাকী বেরিয়ে রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকলাম। মাথার উপর গাছের ডালে কাক বসা ছাড়া বৃক্ষের ডালপালায় নেই অন্য পাখিদের কলরব ও আনাগোনা। দিগন্তে তেমন কুয়াশা না থাকলেও ঠান্ডার দাপট চলছে। এখানে পাহাড়ি উঁচু-নিচু রাস্তার ঢালে গড়ে ওঠা মানুষের বসতবাড়ির বড় একটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো। তা হচ্ছে- প্রতিটি বাড়ির বেলকনিতে বিভিন্ন রকমের ফুলের টব রয়েছে। যা বাড়িগুলোকে আলাদা একটা জমকালো ঐতিহ্য এনে দিয়েছে। মনে হচ্ছে পর্যটন এলাকা হওয়ায় আর পর্যটকদের আনাগোনা বেশি থাকার কারণে স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক নির্দেশনা আছে বাড়িগুলোকে পরিপাটি করে রাখার বিষয়ে। চারদিকে  পাথুরে পাহাড়, তেমন  কোনো ফসলের চাষ চোখে পড়ছে না। মনে হচ্ছে শুধু পর্যটন শিল্পের ওপর মানুষের আয় রোজগার নির্ভরশীল। সময় আরও গড়িয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ভোরের কাঁচা সূর্যরশ্মি পাহাড়ের  চূড়ায় খেলা করতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে  ঝকঝকে হয়ে উঠলো নীল আকাশ। সবুজ গাছপালায় পূর্ণ  পাগাড়ের শৃঙ্গ সূর্যের কাঁচা রোদ পড়ে  ধীরে ধীরে সোনালি রং ধারণ করতে শুরু করেছে । মনে হচ্ছে আগুনে যেন ঝলসে যাচ্ছে পাহাড়চূড়া। বেশ কিছুক্ষণ পায়ে হেঁটে গ্যাংটক শহর ঘুরে বেড়ানোর পর সকাল আটটার আগেই হোটেলে এসে নাস্তা সেরে, অপেক্ষা করতে থাকলাম সাঙ্গুলেকে যাওয়ার জিপ গাড়ি কখন এসে পৌঁছায়। 

লেখক উপভোগ করছেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

এদিকে আটটা বাজল, তারপর নয়টা পেরিয়ে যখন বেলা ১০টার কাছাকাছি তখনও হোটেল ম্যানেজার একই রেকর্ড বাজিয়ে যাচ্ছেন- পাঁচ মিনিটের মধ্যে গাড়ি এসে যাবে। সাঙ্গু লেক ভ্রমণের জন্য গ্যাংটক হতে অনুমোদিত যে কোনো ট্যুর অপারেটরের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে হয়। ট্যুর অপারেটর ছাড়া সাঙ্গুলেকে কোনো বিদেশি ভ্রমণ করতে পারে না। আমাদের ধৈর্যচ্যুত হওয়ার উপক্রম। অবশেষে গাড়ি এলো আর আমরা ১০টার দিকে ছাঙ্গু লেকের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। চলতি পথে পাহাড়ের কোল বেয়ে উপরের দিকে ওঠার সময় ভয়ে গা ছমছম করে উঠল। গ্যাংটক হতে সাঙ্গু লেকে যাওয়া মানেই পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে সিঁড়ির মতো বেয়ে একবার উপরে ওঠা আবার নেমে আসা। আর চারপাশে তাকালে কয়েক স্তরের পাহাড়। সব কিছুই যেন ছবির মতো সাজানো! আমরা আধা ঘণ্টার রাস্তা ইতোমধ্যে পাড়ি দিয়ে সাঙ্গু লেকের দিকে চলে এসেছি। হঠাৎই সকাল সাড়ে দশটায় হোটেল ম্যানেজার ফোনে জানিয়ে দিলো ট্যুর অপারেটর সাঙ্গু লেকে যাওয়ার অনুমোদন নিতে পারেনি তবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনুমোদন না পাওয়ার বার্তা পেয়ে ড্রাইভার গাড়ি রাস্তার বাম পাশে দাঁড় করিয়ে রাখল। আমাদের ভ্রমণের আনন্দ হঠাৎ করেই কমে গেল আর সবাই চুপচাপ হয়ে গেল। 

বেলা এগারোটাটা দশ মিনিট। সাঙ্গু লেকে যাওয়ার আশার আলো ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে। মনের দুঃখ আর হতাশায় পাশেই দুজন জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো ফুঁসছে। অবশেষে টিমের দুই সদস্যের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলে নীরবতা ভেঙে বলে ফেলল- সাঙ্গু লেকে যাওয়ার সাধ মিটে গেছে! আমরা হোটেলে ফিরে যাব। আমরা একে অপরের মুখের দিকে গোমড়া মুখে  ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছি কিন্তু কোনো কথা বলছি না। আর আমরা সবাই মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি গ্যাংটক শহরে ফিরে যাওয়ার জন্য। এমন সময়  হোটেল ম্যানেজার আবারও ফোনে জানিয়ে দিল- ট্যুর অপারেটর সাঙ্গু লেকে যাওয়ার অনুমোদন নিতে পেরেছে। অনুমোদনের খবর শুনে হঠাৎই এক পশলা বৃষ্টির মতো সবার ঠোঁটে হাসির এক ঝিলিক বয়ে গেল। (চলবে)

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়