ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

১১তম পর্ব

দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান

 ইকরামুল হাসান শাকিল  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৩, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৩:৩৬, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান

দুপুরের খাবার রান্না শেষ। রোদের মধ্যে মাঠে বসেই দুপুরের খাবার খেলাম। আজ মুরগির মাংস, সবজি আর ডাল। খাবার শেষ করে আমরা খেলা দেখার উদ্দেশ্যে স্কুল মাঠে চলে এলাম। স্কুলটি গ্রাম থেকে কিছুটা উপরে। হিমালয়ের এই উচ্চতায় পাহাড়ের মধ্যে এতো সুন্দর সমতল বড় একটি খেলার মাঠ সহজে দেখা যায় না। টুর্নামেন্ট হচ্ছে। আজ চারটা দলের খেলা। পরপর দুইটা খেলা। আমরা আসার আগেই প্রথম দুই দলের খেলা শুরু হয়ে গেছে। মাঠের পূর্ব পাশে গ্যালারীর মতো ঘাসের চাদর বিছানো পাহাড়ের ঢাল উপরে উঠে গেছে। সবাই ঘাসের উপর বসে খেলা দেখছে। গ্রামের সব নারী পুরুষ, ছেলেমেয়ে খেলা দেখতে এসেছে। দেখে মনে হচ্ছে এ যেন এক উৎসবমুখর দিন। 

ঝালমুড়ি, ফুচক বিক্রি হচ্ছে। রং-বেরঙের পোশাক, গয়না পরে বিভিন্ন গ্রাম থেকে দল বেঁধে খেলা দেখতে এসেছে মানুষজন। তাদের নিজেদের দলকে সাপোর্ট করতে। আমরাও ঘাসের উপর শুয়ে বসে খেলা দেখছি। আমার একটা ভালো লাগার বিষয় না বললেই নয়, পাহাড়ি পথ পেরিয়ে দূরের গ্রামগুলো থেকে এতো উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে গ্রামবাসী খেলা দেখতে এসেছে এবং প্রত্যেকে প্রত্যেকের দল চিৎকার করে সাপোর্ট করছে- এটা ভীষণ আনন্দের। সূর্য পশ্চিম আকাশে পাহাড়ের আড়ালে চলে যাওয়ার আগেই খেলা শেষ হলো। আমরা একদম শেষ পর্যন্ত খেলা দেখলাম। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি সানভি ভাই নরম ঘাসে শুয়ে ঘুমের সমুদ্রে ডুবে আছে। তাকে ডেকে তুললাম। চারপাশ অন্ধকার হওয়ার আগেই আমরা ক্যাম্পে চলে এলাম।  

সন্ধ্যা সাতটার মধ্যেই আমরা কিচেন তাবুর ভিতরে বসে রাতের খাবার খেলাম। খাবার শেষে সুরবিন্দ্রা এসেছে তার বন্ধু ভক্তপুন মাগারকে নিয়ে। তার সাথে বসে অভিযানের পথ নিয়ে পরামর্শ করা হলো। আগামীকাল সকালে আমাদের সাথে ভক্তপুন যাবে। তিনি আমাদের স্থানীয় পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করবেন। যেসব খচ্চরে করে এই মাইকোট পর্যন্ত আমাদের অভিযানের প্রয়োজনীয় মালপত্র আনা হয়েছে খচ্চরের মালিক সকালেই মালপত্র রেখে খচ্চর নিয়ে চলে গেছে। ভক্তপুনের খচ্চর আছে, তার খচ্চরে করেই উপরে মালপত্র নেওয়া হবে। আলোচনা শেষে সুরবিন্দ্র আর ভক্তপুন চলে গেল। আমরা সবাই নিজ নিজ তাবুতে চলে এলাম।

ভোরে উঠেই আবার ট্রেকিং শুরু হবে। তাই সবাই ঘুমিয়ে গেল। আমিও দ্রুতই ঘুমিয়ে গেলাম। রাত বারোটা নাগাদ আমার ঘুম ভেঙে গেল। তাবুর বাইরে অনেক আলো দেখা যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে রাতের অন্ধকার কেটে গেছে। আমি স্লিপিং ব্যাগ থেকে বেরিয়ে তাবুর জিপার খুললাম। সামনে পুরো গ্রাম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। প্রথমে ভাবলাম ভোর হয়ে গেছে। মোবাইল ফোনে সময় দেখি রাত বারোটার মতো বাজে। তাবু থেকে বেরিয়ে দেখি পরিষ্কার আকাশ। মেঘের ছিঁটেফোঁটাও নেই। আকাশে বিশাল এক চাঁদ। চাঁদের আলোয় চারপাশ আলোকিত হয়ে আছে। তাবু থেকে একটু দূরে এগিয়ে এসে পাহাড়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে চাঁদের আলোয় দূরের পাড়াগুলো দেখছি। চারপাশ একদম নীরব। শুধু বাতাসের নরম শব্দ। আমি মুগ্ধ হয়ে জোছনা রাতের এই অপরূপ সৌন্দর্যে হারিয়ে গেলাম কিছু সময়ের জন্য। প্রচণ্ড ঠান্ডায় শরীর প্রায় জমে যাওয়ার অবস্থা। কিন্তু রাতের সৌন্দর্যে এতোই ডুবে গেলাম যে ঠান্ডার কথা ভুলেই গেছি। বাইরে ঠান্ডা  বাতাস থাকায় বেশি সময় থাকতে পারলাম না। কারণ শরীর সুস্থ রাখতে হবে। তাই আবার তাবুর ভিতরে ফিরে এলাম। 

ভোরেই পাশের তাবু থেকে মুহিত ভাইয়ের ডাক শোনা গেল। ঠান্ডার মধ্যে স্লীপিং ব্যাগের ভিতর থেকে বের হতে কোনোভাবেই ইচ্ছে করছে না। তবু বের হতে হবে। তাবুর ভিতরে বসেই বিছানা, স্লীপিং ব্যাগ রুকস্যাকে গুছিয়ে নিয়ে একেবারে বেরিয়ে পড়লাম। সবাই একইভাবে তাবুর ভিতর থেকে বেরিয়ে গেছে। কিলু নিমারা তাবু গোটাচ্ছে। আমিও তাদের সাথে কাজে হাত লাগালাম। তাবু গোটানোর পর সকালের নাস্তা খেলাম। এর মধ্যে ভক্তপুনও চলে এসেছে তার খচ্চরের পাল নিয়ে। সাথে তার দুই ছেলেকেও নিয়ে এসেছে। তারা খচ্চরের পিঠে মালপত্র তুলছে। সুরবিন্দ্রা ও গাঁপালিকার এই এলাকার ওয়ার্ড মেম্বারও এসেছে আমাদের বিদায় জানাতে। খাবার শেষে আমরা আগেই রওনা হয়ে গেলাম। আমাদের সাথে এখন তারাও হাঁটছে। গ্রামের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। গতকাল এই দিক দিয়েই হেঁটেছি। গ্রামের মানুষজন কৌতূহল নিয়ে আমাদের দেখছে। গ্রাম পেরিয়ে আসতে প্রায় মিনিট দশেক লেগে গেল। গ্রামের শেষ প্রান্তে এসে সুরবিন্দ্র আমাদের থামতে বললো। 

আমরা সবাই দাঁড়ানোর পর সে বললো, গ্রামের পক্ষ থেকে তোমাদের শুভকামনা জানানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। তোমরা যদি এই অবিজিত পর্বত চূড়া আরোহণ করে সফল হতে পারো তাহলে সেই সফলতা আমাদের গ্রামের জন্যও এক বড় আনন্দের হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাঁচজন কিশোরী গাঁদাফুলের মালা ও ফুলের তোড়া নিয়ে এলো। তারা নিজেরাই আমাদের জন্য এই ফুলের মালা বানিয়ে এনেছে। একে একে আমদের সবাইকে সেই ফুলের মালা পরিয়ে শুভকামনা জানালো তারা। তারপর সবাই একসঙ্গে ছবি তুলে আমরা বিদায় নিলাম। তারা জানালো আমাদের জন্য অপেক্ষায় থাকবে এবং সফল হয়ে এলে আবার এভাবেই তারা আমাদের ফুলের মালা দিয়ে বরণ করে নেবে।

এই গ্রামের মানুষের ভালোবাসা আমাদের মুগ্ধ করল! সেই মুগ্ধতা আর তাদের শুভকামনা নিয়ে আমরা এগিয়ে চলছি। গ্রাম থেকে বেরিয়ে এসেছি অনেক আগেই। এখন ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে খাড়া চড়াই উঠছি। একটা পাহাড়ি ঝিরি ধরে উপরের দিকে এগিয়ে চলছি। কখনো এপাশ আবার কখনো ওপাশ। কখনো ডালপালা ধরে আবার কখনো গাছের শেকড়-বাকর ধরে উপরে দিকে উঠতে হচ্ছে। এগারোটা নাগাদ আমরা একট ফাঁকা জায়গায় এসে পৌঁছালাম। এটা একটা ক্যাম্প সাইট। গ্রামের মানুষজন যখন পশু পালনের জন্য উপরের দিকে যায় তখন তারা এখানে তাবু করে থাকেন। এখানে ছোট একটা ভাঙা ঘরও আছে। কিছুটা জায়গা সমতল। এখানে তাবু করে ক্যাম্পও করা যাবে। পাশেই ছোট একটা ঝিরি আছে। তাই পানিও সহজেই সংগ্রহ করা যায়। আস গুরুং জানালো, এখানেই আজকে দুপুরের খাবারের বিরতি।

আমরা সবাই রুকস্যাক রেখে রোদে বসে গল্প করছি। কিচেন স্টাফরা দুপুরের খাবার তৈরিতে ব্যস্ত। কেউ স্টোভ জ্বালাচ্ছে, কেউ সবজি কাটছে। প্রথমেই আমাদের সবাইকে চা বানিয়ে দেওয়া হলো। রোদে বসে বসে চা খাচ্ছি আর গান শুনছি। এর মধ্যেই কেউ কেউ রোদে শুয়ে ঘুমিয়েও নিলো। খাবার প্রস্তুত হয়ে গেছে। আমরা সবাই খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। প্রথমে আমাদের খাবার দেওয়া হলো। ডাল ভাত আর সবজি আজকের খাবারের মেনু। খাবার নিয়ে রোদে বসে খাচ্ছি। তিন পাশেই পাহাড়ে ঘেরা। বড় বড় গাছের ঘন জঙ্গল। শুধু এক পাশ ফাঁকা। অনেকটা দূর দেখা যাচ্ছে। সবাই একসঙ্গে খাবার খাচ্ছি। কেউ বসে আবার কেউ দাঁড়িয়ে। খাবার শেষ করে আবার চড়াই ওঠা শুরু। 

ঘন জঙ্গলের ভিতর দিয়ে সরু একটা ড্রেইনের মতো রাস্তা দিয়ে উঠতে হচ্ছে। বড় বড় গাছ পড়ে আছে। সেই গাছের নিচ দিয়ে উঁকি দিয়ে পেরিয়ে আসতে হলো। এই জঙ্গলের ভিতরেই একটি ছোট পাস অতিক্রম করতে হলো। আমরা বিকেল তিনটার মধ্যেই চলে এলাম ডোলে নামক একটি ছোট্ট গ্রামে। এই এলাকার এটাই শেষ গ্রাম। এখানে মাত্র পাঁচ-ছয়টি পরিবার বসবাস করে। গ্রামটা আমরা দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম। পাহাড়ের গায়ে এই ছোট্ট গ্রাম দূর থেকে দেখতে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল। গ্রামের পাশেই ফাঁকা জায়গায় আমাদের ক্যাম্প করা হলো। গতরাতের মতোই একই ভাবে তাবুতে থাকার ব্যবস্থা হলো। তাবুর ভিতরে রুকস্যাক রেখে কিচেন তাবুতে চলে এলাম। গরম গরম চা খেয়ে শরীরের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। বিকেলের দিকে আমরা কিছুটা উপরের দিকে হাইট গেইন করতে এসেছি। প্রায় আধা ঘণ্টার পথ আমরা হেঁটে এসেছি। এখান থেকে ধউলাগিরি রেঞ্জের পর্বত দেখা যাচ্ছে। দিনের আলো খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরাও ফিরতি পথ ধরলাম। 

ক্যাম্পে ফিরতে ফিরতে অন্ধকার হয়ে গেছে চারপাশ। ডোলেতে তাপমাত্রা আরো কমে গেছে। তাই আজ আর ডাউন জ্যাকেট না বের করে থাকা যাবে না। তাই রুকস্যাক থেকে ডাউন জ্যাকেট ও মাথার টুপি বের করে পরে নিলাম। রাতে তাপমাত্র শূন্যের নিচে যে নামবে সেটা খুব সহজেই বুঝতে পারলাম। সন্ধ্যার মধ্যেই রাতের খাবার তৈরি হয়ে গেছে। নিমা আমাদের সবাইকে কিচেন তাবুতে যেতে বললো খাবারের জন্য। মাথায় হেডটর্চ পরে পানির বোতল হাতে নিয়ে কিচেন তাবুতে চলে এলাম। তাবুর ভিতরেই যেহেতেু রান্না হয়েছে তাই তাবুর ভিতরটা বেশ গরম। বাইরের ঠান্ডা থেকে গরমে দারুণ আরাম বোধ হচ্ছে। এক পাশে লম্বা ম্যাট্রেস বিছিয়ে দিয়েছে। সেখানে বসেই খাবার খাচ্ছি। আজ রাতের খাবারে ভাত, ডাল, সবজি আর শাক। খাবার শেষে বোতলে গরম পানি নিয়ে তাবুতে চলে এলাম। আমাদের ক্যাম্পের পাশেই একটি বাড়ি আছে। কিলু এসে মুহিত ভাইকে বললো, আমরা এই বাড়িতে আড্ডা দিচ্ছি। তোমরাও আড্ডায় যোগ দিতে পারো। মুহিত আমাদের বললেন, চলেন কিছু সময় আড্ডা দিয়ে আসি। কিলু আগেই চলে গেছে। আমার মিনিট পাঁচেক পরে এলাম। তামটিং, আংডু, নিমা আর কিলু বাড়ির রান্না ঘরে বসে আড্ডা দিচ্ছে। বাড়ির মালকিন আর তার মেয়ে চুলায় কিছু রান্না করছে। আমরা ঘরের ভিতরে ঢুকলাম। চুলার পাশেই আমাদের বসতে দিলো। 

ঘরের উপরের দিকে তাকিয়ে দেখি মাংস ঝুলছে। এই মাংসগুলো সাধারণত খাসি, ভেড়া বা ইয়াকের হয়ে থাকে। কিছু মাংস শুকনো সেগুলো অনেক পুরনো হবে। কিছু মাংস কাঁচাই রয়েছে। এগুলো হয়তো তিন-চার দিন আগেই সংগ্রহ করা হয়েছে। এরা ঘরে মাংস ঝুলিয়ে রাখে শুকানোর জন্য। আর এই শুকনো মাংসগুলোই তারা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করে রেখে খায়। মেয়েটির বয়স চৌদ্দ-পনেরো হবে। মায়ের সাথেই কাজ করে। পড়ালেখা করে না। এই গ্রামে কোনো স্কুল নেই। সে মায়ের পাশে বসে শুকনো মাংস ছোট ছোট টুকরো করে কাটছে রান্নার জন্য। মেয়ের মা কড়াইয়ে কিছু মাংস রান্না করছে। এগুলো অবশ্য রান্না হচ্ছে কিলুদের জন্য। তারা তুংবা নামক স্থানীয় মদ পান করছে। মিলেট নামক একটি শস্য থেকে এই মদ তৈরি হয়। যদিও এটা খুব বেশি নেশা হয় না। এই শস্যটা দেখতে অনেকটা কলাই ডালের মতো তবে আকারে কালাইয়ের থেকে কিছুটা ছোট। তুংবা খাওয়ার জন্য বড় আকারের মগের মতো এক বিশেষ পাত্র আছে। পাত্রটি একটি ছিদ্রসহ ঢাকনা থাকে। পাত্র ভর্তি করে গাজনকৃত মিলেট নেওয়া হয়। তারপর গরম পানি ঢেলে সরু স্ট্র দিয়ে সেই মিলেট ভেজা পানি পান করা হয়। এই তুংবা সাধারণত আড্ডা, সামাজিক অনুষ্ঠান বা অতিথি আপ্যায়নে দেওয়া হয়। 

সবাই তুংবা পান করছে আর গল্প, গান চলছে। তাদের মধ্যে শুধু নিমা তুংবা পান করে না। আমরাও যেহেতু তুংবা পান করি না সেহেতু আমাদের পাঁচজনকে শুধু মাংস বাটিতে করে দেওয়া হলো। আমরা সেই মাংস খাচ্ছি। বেশ সুস্বাদু হয়েছে খেতে। এই মাংসকে সুকুটি বলা হয়। ঘণ্টাখানেক আড্ডা দেওয়ার পর আমরা তাবুতে চলে এলাম। (চলবে)

পড়ুন দশম পর্ব : দোগারি পর্বতে বাংলাদেশের প্রথম অভিযান

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়