ঢাকা     সোমবার   ২০ মে ২০২৪ ||  জ্যৈষ্ঠ ৬ ১৪৩১

এক ঝুড়ি তানজানিয়ান আনন্দ 

ফাতিমা জাহান  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৪, ৮ মে ২০২৪   আপডেট: ১৮:০৩, ৮ মে ২০২৪
এক ঝুড়ি তানজানিয়ান আনন্দ 

‘হাকুনা মাটাটা’, আমাকে দেখে কিলিমানজারো এয়ারপোর্টের এক পুলিশ বলল। আমি তো ভয় পেয়ে গেলাম। কি বকছে এই খোদার বান্দা! এই দেশে ঢুকতে দেবে তো? এখন অবধি কোনো দেশ থেকে আমাকে ফেরত পাঠায়নি। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে আমার সামনে শ’ খানেক মানুষের লাইন। সবাই ইউরোপ থেকে এসেছে। নাইরোবি থেকে আমি খেলনার মতো যে প্লেনে চড়ে এসেছি সেই প্লেনের সব যাত্রীই ইউরোপীয় ছিল। কে জানে একমাত্র এশিয়ান যাত্রী হবার অপরাধে কি নাস্তানাবুদ করবে? কিন্তু এই লম্বা লাইন ঠেলে ইমিগ্রেশন ডেস্কের সামনে দাঁড়াতেই আমাকে বিদায় দিলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তানজানিয়ায় আমার ভ্রমণের অনুমতি পেয়ে গেলাম। এখানেও আরেক পুলিশ দেখি সবগুলো দাঁত বের করে বলছে, ‘হাকুনা মাটাটা’ মানে ‘নো প্রব্লেম’। 

এই হলো সোয়াহিলি ভাষায় এদের স্বাগতম জানানোর পদ্ধতি। বিদায় যখন করছেই না তখন এদের ঘাড়ে চেপে বসতে অসুবিধে কোথায়! 

ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে প্রথম যে কাজটির কথা মনে পড়ে তা হলো ডলার এক্সচেঞ্জ করতে হবে। ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্সের আনন্দে প্রায়ই আমি টাকা ভাঙাতে ভুলে যাই। বাইরে গিয়ে পড়ি ঝামেলায়। এক্সিট গেইটের আগেই কয়েকটা ব্যাংকের মানি এক্সচেঞ্জ অফিস। একটাতে ঢুকে ডলার পাসপোর্ট দেবার পর সোজাসুজি দেয়ালে চোখ পড়ল। সেখানে ঝুলছে এক লাল হিজাবি মহিলার ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবি। অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে ইনি?’ তিনি বললেন, ‘ইনি আমাদের দেশের প্রেসিডেন্ট। নাম সামিয়া সুলুহু হাসান।’ আরও বললেন, ‘ভদ্রমহিলা নাকি দেশের জন্য বেশ কাজ করছেন। সাধারণ জনগণ তাঁকে এবং তাঁর কাজ পছন্দ করেন।’ 

যানযিবারের বাসিন্দা এই প্রেসিডেন্টের কোনো পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। বাবা, ভাই, স্বামী কেউ জীবনেও রাজনীতির ধারেকাছ দিয়েও যায়নি। সংখ্যালঘু মুসলমান সামিয়া সুলুহু নিজ আগ্রহে, দেশের সেবা করার জন্য রাজনীতিতে নেমেছিলেন। চারজন সন্তান জন্ম দেবার পরও উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেছেন দেশে-বিদেশে। কাজ করেছেন অনগ্রসর সমাজের জন্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রতিষ্ঠানে। তিনি প্রথমে যানযিবারের মন্ত্রী ছিলেন, পরে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। সাবেক প্রেসিডেন্ট জন মাগুফুলির মৃত্যুর পর যোগ্যতা অনুসারে ২০২১ সালে সামিয়া সুলুহু দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। 

একে তো সংখ্যালঘু মুসলিম তার উপর নারী এবং বড় কোনো রাজনৈতিক দলের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকা সত্তেও প্রেসিডেন্টকে এত সম্মান প্রদর্শন একমাত্র বোধহয় আফ্রিকাতেই সম্ভব। পরে প্রেসিডেন্ট সাহেবকে নিয়ে ভাবা যাবে। আপাতত এই রাত দশটায় আমি কীভাবে আরুশা যাব সে চিন্তা করি। বাইরে তখন ট্যাক্সির খরা পড়েছে। সুনসান নীরবতা নেমেছে এয়ারপোর্টের সামনের রাস্তাটিতে। যারা প্লেন থেকে নেমেছেন তারা কেউ নেই। রাতারাতি সব উধাও হলো কীভাবে! সামনে কয়েকটি ইউরোপীয় ট্যুরিস্টকে নিয়ে একটা ট্যাক্সি হুশ করে চলে গেল। এখন আমি কীভাবে আরুশা যাব? হঠাৎ দেখি একটি স্থানীয় মেয়ে হেঁটে বাইরের দিকে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম আমি আরুশা যাব, ট্যাক্সি কি পাওয়া যাবে এখানে? মেয়েটি ফ্লাইট মিস করেছে। ও এসেছে আরুশা থেকেই। সেখানেই ফিরে যাচ্ছে। ওর সাথে গাড়ি আছে। আমি অনুরোধ করলাম আমাকে নিয়ে যেতে এবং আআত্মবিশ্বাসের সাথে ভেবে নিলাম মেয়েটি আমাকে তার গাড়িতে নেবেই। হলোও তাই। আফ্রিকার এতগুলো দেশ ঘুরে অন্ততপক্ষে নিরাপত্তা বা সহযোগিতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই আমার। 

মেয়েটি তার গাড়িতে আমাকে নিয়ে চলল। ওর নাম জেনিফার। ড্রাইভারের নাম মাইকেল। খুবই বিনয়ী। আফ্রিকার অনেক অবাক করা ব্যাপারের একটা হলো, এরা নিজেদের কাজের লোক বা ড্রাইভারের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করে। প্রভু-ভৃত্য আচরণ বোধহয় একমাত্র আমাদের এশিয়া মহাদেশের কিছু অংশে এখনো বহাল আছে। 
রাত বাড়ছে। বাইরের জগৎ গাড়ির জানালা দিয়ে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। মাঝে একবার আমার গেস্ট হাউসে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি যে আমি পথে আছি। 

এক ঘণ্টার মধ্যে মাইকেল আমাকে গেস্ট হাউসের সামনে নামিয়ে দিলো। গেস্ট হাউসকে দেখে মনে হলো বিশাল বাগান বাড়ি। বড় ঘন গাছপালায় ঘেরা বাগানের মাঝখান দিয়ে ছোট ছোট দ্বীপের মতো আলাদা আলাদা কটেজ। গেস্ট হাউসের মালিক ইব্রাহিম আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বিশালদেহী, মাথা কামানো একজন হাসি-খুশি মানুষ ইব্রাহিম। এত রাতেও গেস্ট হাউসের স্টাফদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি ঢুলু ঢুলু চোখে দেখছি বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা সব চাকরি করে এখানে। মানে এ এক নারীদের জগৎ। আমার রুম বুঝে পাবার পরই ইব্রাহিম এক গাদা স্ন্যাকস আর ফল পাঠিয়ে দেন। রাতের খাবার খাইনি আর ওদের কিচেন বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অতিথিপরায়ণতায় আফ্রিকাবাসী যে সেরা তার প্রমাণ বারবার মেলে। 

সকালে চোখ খোলার আগেই পাখির ডাকে ঘুম ভাঙল। একেবারে বনানীর মাঝে বাস করছি। গেস্ট হাউসের রূপ মাধুর্যেও কিছুই দেখিনি গতরাতে। এখন বের হয়ে যা দেখি তাই রূপকথার রাজ্যের অংশ বলে মনে হচ্ছে। ছোট, মাঝারি, বড় সব ধরনের গাছের বিন্যাস। বৃক্ষ, গুল্ম, লতায় ছেয়ে আছে আঙিনা। এদের একটা বসার ঘর এবং খাবার আছে যার চারদিকে খোলা। ছাদ আমাদের দেশের ছনের ঘরের মতো পাতা দিয়ে বানানো। এর উপর এক বিশাল বর্ষীয়ান বৃক্ষ দু’হাত ছড়িয়ে আগলে রেখেছে আঙিনার একটা বড় অংশ। আমার কুটিরের উপর বাগানবিলাস বাড়াবাড়ি রকমের রঙ ছড়াচ্ছে। প্রত্যেকটা কটেজ দেখতে ছনের কুটিরের মতো, দেয়ালে হালকা হলুদ রং করা। আঙিনার মাঝখানে আরেক প্রস্ত বাগানের মাঝে চেয়ার টেবিল পেতে বসার জায়গা করা আছে। এত বড় গেস্ট হাউস আমি আগে দেখিনি। শুরু আছে শেষ নেই। সিটিং স্পেস বা বসার ঘরে গিয়ে আমি লম্বা একটা রঙিন সোফায় বসে কফি খেতে খেতে এর বাহারি ইন্টেরিয়র দেখি। বিশাল এই সিটিং স্পেসে বর্র্ণিল বিশাল সোফা সারি সারি পাতা। একেক সোফার কভার একেক রঙের প্রিন্ট করা। চারপাশ খোলা কিন্তু ফাঁকে ফাঁকে নানা রঙের, নানা আকারের টবে গাছ লাগানো। 

সিটিং স্পেসের ডাইনিং টেবিলে আমার জন্য নাস্তা সাজিয়ে দিলো মোয়ানা, এখানে কাজ করে ও। এত মিষ্টি মেয়ে! ইব্রাহিম এসে আরও একটা মেয়ের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো, ওর নাম জেসিকা। এই গেস্ট হাউসের ম্যানেজার। সবাই এত হাসিখুশি আর উৎফুল্ল যে, মনে হয় আমি সত্যিই পিকনিক করতে এসেছি। 

টেবিলে পাতা টেবিলম্যাটগুলোও ভীষণ রঙিন। এরা ইংলিশ ব্রেকফাস্ট আর প্রচুর ফল পরিবেশন করে আমার দিন রঙিন করে দিলো। নাস্তা করে জেসিকার কাছ থেকে জেনে নিলাম আশেপাশে কোথায় কী আছে। কাল রাতে বুঝতে পারিনি কোন পথ ধরে কোথায় যাওয়া যায়। খুব কাছেই ক্লক টাওয়ার আর হস্তশিল্পের বাজার। আফ্রিকার সবকিছুই ভীষণ রঙিন আর প্রাণবন্ত। প্রজাপতির মতো উচ্ছ্বল মানুষেরা সব আর তার মাঝে সবুজ প্রকৃতি উদার করে ঝুড়ি থেকে ঢেলে দিয়েছে সবুজ রঙের জাদু। 

আমি হস্তশিল্পের বাজারের দিকে হাঁটা ধরলাম। পথের দু’ধারে গাছপালা চকচক করছে। এ দেশে এখন বর্ষাকাল। যখনতখন বৃষ্টি পড়ে। আমি তো এমন মৌসুমই চেয়েছিলাম। সবাই যখন শুকনো মৌসুমে ঘুরে বেড়ায়, আমি ইচ্ছে করেই এসেছি বারিধারার কালে। ক্লক টাওয়ার পার হয়ে বাঁ দিকের পথ খানিক পেরোলেই পথের ধারে সারি সারি আফ্রিকান পেইন্টিং রাখা। বাজারের শুরু এখান থেকেই। দূর থেকে উজ্জ্বল রঙে ভেসে যাচ্ছে। বিশাল বিশাল রঙিন চিত্রগুলোয় আঁকা আছে আফ্রিকান নারী-পুরুষের পোর্ট্রেট, বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর জীবনযাপন পদ্ধতি, আফ্রিকার জঙ্গলের পশু ইত্যাদি। বাজারের সামনের ফুটপাতও ভরে উঠেছে নানা রঙের জিনিসপত্রে। তানজানিয়া বিখ্যাত পুঁতিশিল্পের জন্য। সাধারণ পুঁঁতি জুড়ে জুড়ে এরা লম্বা, মোটা গহনা থেকে শুরু করে আসবাবপত্রেও নানান রঙিন নকশা তৈরি করে ফেলতে পারে। শিল্পকর্মের জন্য কম দামি, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যবহার করাকে আমার কাছে এক বিস্ময় হয়ে রয়েছে। 

সাধারণ চিকন লোহার তারে আটকে এরা গহনা, ঝুড়ি বানিয়ে ফেলেছে। এই পুঁঁতি দিয়েই আবার নানা ছোট ছোট পশুপাখি, টেবিলম্যাট বানিয়ে রেখেছে। কিছু কিছু কাঠের জিনিসপত্রের আস্তরণ রঙিন পুঁঁতি সাজিয়ে আঠা দিয়ে জোড়া দিয়ে রঙিন করে তোলা হয়েছে। যেমন: ফুলদানি, মুখোশ, পুতুুল ইত্যাদি। এই বাজারে দু’শর মতো হস্তশিল্পের দোকান আছে। বাজারের নাম মাসাই মার্কেট। কেনিয়া, তানজানিয়ার বিখ্যাত মাসাই নৃগোষ্ঠীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। মাসাইরা নারী-পুরুষ সকলেই গাঢ় রঙ; যেমন লাল, ম্যাজেন্টা রঙের নিজেদের তাঁতে বোনা কাপড় পরে। পূর্ব আফ্রিকায় এই গোষ্ঠীই সংখ্যায় অধিক তাই মাসাই শব্দটা বলার সাথে সাথে যে কোনো দেশের মানুষ এদেরকে চিনতে পারেন। 

আমি বহু দেশের হস্তশিল্পের বাজার দেখেছি। কিন্তু রঙিন, সাধারণ জিনিসপত্র দিয়ে তৈরি হস্তশিল্পের চেয়ে অন্য কিছু আমায় এত আকৃষ্ট করেনি। কাঠের ওপর খোদাই করা শিল্পকর্ম আফ্রিকাকে এক টুকরো শিল্পের ভূূমি করে দিয়েছে। মুখোশ থেকে শুরু করে শোপিস বা তৈজসপত্র নানা রঙে শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে দোকানগুলোর। হোগলা পাতার মতো এক ধরনের পাতা যার স্থানীয় নাম কিকাপু দিয়ে এরা ব্যাগ, টেবিলম্যাট ইত্যাদি বানায়। এগুলো দেখলে আর সে দোকান থেকে বের হয়ে আসতে ইচ্ছে করে না। কিছু দোকানে সব ধরনের হস্তশিল্প পাওয়া যায়। কিছু দোকানে শুধুই পেইন্টিং বা কাঠের জিনিসপত্র পাওয়া যায়। পাটের তৈরি পুতুল বা অন্যান্য জিনিস আমাদের দেশে প্রায় বিলুপ্তির পথে কিন্তু এখানে পাটের তৈরি ব্যাগ, শোপিস ইত্যাদি দেখে ছোটবেলায় দেখে আসা বাংলাদেশের হস্তশিল্পের দোকানের কথা মনে পড়ে গেল। 

এ দেশে আরেক ধরনের উদ্ভিদের আঁশ থেকেও ব্যাগ, টেবিলম্যাট ইত্যাদি তৈরি করা হয়। স্থানীয় ভাষায়, এই আঁশকে বলা হয় ‘মিয়া’। আমার এই ব্যাগ, ওয়াল হ্যাংগিং দেখে সব কিনে নিতে ইচ্ছে করে। এরই মধ্যে কিনবো না ভেবেও পুঁতি দিয়ে তৈরি চাবির রিং আর ঢাকনা দেয়া পুঁতির বক্স শোপিস, মাসাই কাঠের পুতুল, একটা ছোট পেইন্টিং কিনে ফেলেছি। এখন দাঁড়িয়ে আছি ব্যাগের দোকানের সামনেÑ কিছুতেই চোখ সরছে না। পাট, চামড়া, পাতা, দড়ি, কাপড় কত কি যে দিয়ে বানিয়েছে রঙিন ব্যাগ, আমি কি করে উপেক্ষা করি! অগত্যা খান কয়েক রঙিন ব্যাগ কিনে ফেললাম। অতি লোভে তাঁতি নষ্ট হবার আগে সেখান থেকে সটকে পড়লাম। 

স্নেক স্টোন নামে এক ধরনের পাথর দিয়েও বিভিন্ন শোপিস, পুতুল, দাবার বোর্ড ইত্যাদি তৈরি হয়। সেগুলোও বগলদাবা করে নিতে ইচ্ছে হলো। আমার ভ্রমণ শুধু এক দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না। কিন্তু নেবার উপায় নেই। পথে ভেঙে যেতে পারে। আমি ঘুরে বেড়াই এক দেশ থেকে অন্য দেশে। কোনো দেশেই প্রলুব্ধ হই না কিছু কেনার জন্য। কিন্তু আফ্রিকা আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে। রঙিন কাপড় দিয়ে যে কত ধরনের শোপিস, ওয়াল হ্যাংগিং এরা বানায়, এদের সৃজনশীলতার জুড়ি নেই। সবচেয়ে ভালো লেগেছে কাপড়ের পুতুলের গায়ের কৃষ্ণবর্ণ দেখে। আফ্রিকার মানুষের গায়ের রঙ যেমন পুতুলেরও সেরকম হওয়াই স্বাভাবিক। 

সাধারণ চিত্রকর্মের সাথে এ দেশের ঐতিহ্যবাহী পেইন্টিং-এর নাম টিংগা টিংগা পেইন্টিং। বিভিন্ন মানুষ বা পশুপাখিকে কার্টুনের মতো করে এঁকে রঙে রঙিন করে তোলা হয় এই চিত্রকর্মে। আরও এক ধরনের চিত্রকর্ম এরা করে কলাগাছের বাকল শুকিয়ে। বাকলের উপর তখন হালকা রঙ দিয়ে আঁকা হয় গ্রামের সাধারণ মানুষের বিভিন্ন দৈনন্দিন চিত্র। অবশ্য এই চিত্রকর্মকে বাঁধাই করে রাখতে হয়। না-হলে নষ্ট হয়ে যাবার আশঙ্কা  থাকে।

আফ্রিকায় ‘বিগ ফাইভ’ মানে বনভূমির সিংহ, চিতা, জিরাফ, জেব্রা, মহিষ, গণ্ডার, হাতি যে কোনো শিল্পকলার মূল উপাদান। জঙ্গলে দেখতে পাওয়া গেলে মঙ্গলে মানে দোকানেও এদের পাওয়া যায়। কাঠ, পুঁতি, পাট বা চিত্রকর্ম দিয়ে বিগ ফাইভকে এরা পাঠিয়ে দেয় পৃথিবীর প্রত্যেক কোণা থেকে যারা আসে তাদের সাথে করে। আমি নিজেও এসেছি সাফারি পার্কে ঘুরে ঘুরে বিগ ফাইভ দেখতে। এই বাজার থেকে তাই কিনে নিলাম কাঠের তৈরি ছোট ছোট কয়েকটি বিগ ফাইভ। 

চামড়াশিল্প এখানে আগেই দেখেছি। সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় গরু বা মহিষের চামড়ার জিনিসপত্র। জুতা, স্যান্ডেল, ব্যাগ, শো পিস থেকে শুরু করে চিত্রকর্মও ফুটিয়ে তোলা হয় চামড়ার ক্যানভাসে। আরেকটা জিনিস দেখে আশ্চর্য হলাম, গরু বা মহিষের হাড় দিয়েও এরা ছোট আকারের সব ধরনের শোপিস, পুতুল, চামচ, চাবির রিং, ট্রে, প্লেট, গ্লাস বানিয়ে ফেলেছে। এর আগে ইন্দোনেশিয়ায় এমন শিল্প দেখেছি তবে এত ধরনের নয়। এদের এই ধরন দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি! 

নারকেলের মালা দিয়ে এরা এত সুন্দর সুন্দর শো পিস, ওয়াল হ্যাংগিং, ট্রে, প্লেট, বাটি বা তৈজসপত্র বানিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছে যে, এগুলোকে এখন চেনাই যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে এগুলো কাঠের তৈরি কোনো হস্তশিল্প। এদের গায়ের উপর আবার মিনাকারী নকশার মতো রঙ গলিয়ে গ্লেইজ করে মিনিয়েচার পেইন্টিং এঁকে আবার প্রলেপ দিয়ে এক অনন্য চিত্র তুলে ধরেছে। 

আমাদের দেশে ধামাশিল্প অনেক প্রাচীন একটি শিল্পমাধ্যম। এখানেও বিভিন্ন ধরনের ও আকারের ধামা দেখলাম। এই বাজারে স্থানীয় মানুষের চেয়ে বিদেশিদের আগমন বেশি। তাই ধামার মতো সাধারণ জিনিসও এখানে সোনার দামে বিকোচ্ছে। ছোট ছোট ধামার ঝুড়ির মুখে এরা আবার ঘন করে নানা রঙের পুঁতি বসিয়ে সেলাই করে দিয়েছে। দেখতেও খুব নান্দনিক হয়েছে। 

এই বাজারে সারাদিন ঘুরলেও দেখা শেষ হবে না। আর লোভেরও শেষ থাকবে না। পকেটের বাকি শিলিং শেষ হয়ে যাবে। মনের মতো হস্তশিল্পের বাজারে ঢুকে কেনাকাটা করা এক অমোঘ ইন্দ্রজাল, এ থেকে বের হওয়া অসাধ্য সাধনের মতো। তাই এই রঙিন জাল ছিন্ন করে বের হয়ে আসলাম। এখন যাব সোয়াহিলি খাবার খেতে। সকালে জেসিকা একটা রেস্তোরাঁর সন্ধান দিয়েছে। স্থানীয় খাবারের আয়োজন করে এরা। আরুশার মতো ছোট শহরে খাবারের দোকান পাওয়াই যেন এক সোনার হরিণের খোঁজ পাওয়া।  

রেস্তোরাঁটিতে এখন মানুষের সমাগম। এদের সাজসজ্জা না খাবার কি জন্য কে জানে। বাগানের মাঝে চেয়ার-টেবিল পেতে বেশ একটা আনন্দদায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে। আরেক পাশে ছাউনি দেয়া অংশ। অন্য পাশে বারবিকিউ সেকশন আর তার উল্টো পাশে জুস বার। আমি বাগানের একটা টেবিল দখল করলাম। সমস্ত আফ্রিকার মানুষ আমাকে ইউরোপীয় ভেবে ভুল করে। এদের ভাষায় বলে মুসুঙ্গু। আমি বারবার চেষ্টা করেও এদের ভুল ভাঙাতে পারি না। আসল ইউরোপীয়দের কাছে সকল এশিয়ান, আফ্রিকান যে কালো এটা অনেকেই জানে না, তার গায়ের রঙ যাই হোক না কেন। কিন্তু এরা তা মানবে না। মুসুঙ্গু ভেবে এরা বেশিরভাগ জায়গায় বাড়তি খাতির করে। কী বিনয়ী আর অদ্ভুত জাতি এরা, এত বছর দাসবৃত্তি করার পরও মুসুঙ্গুদের এত সমীহ করে চলে! 

আমি মেন্যু দেখে ভাত আর চিকেন কারি অর্ডার করলাম। স্থানীয় ভাষায় বলা হয় কুকু জেগেরে। খাবারটি দেখতে একদম আমাদের দেশের মাংসের তরকারির মতোই, শুধু মাংসের ঝোলের সাথে খানিকটা টমেটো, শিম আর গাজর কেটে দিয়েছে। স্বাদের কথা কী আর বলব, আফ্রিকায় আসার পর এই প্রথম মনে হয় কোনো খাবার খেয়ে মনের সাধ পূরণ হলো। অন্যান্য দেশগুলোতে স্থানীয় খাবার নাকেমুখে গুঁজে খেয়েছি খেতে হবে বলে। খেতে অনেকটাই আমাদের দেশের মুরগির তরকারির মতো। সাথে এরা লাল মরিচের ঝোল আর মাঝারি আকারের শিম সেদ্ধ দিয়ে খায়। মরিচের লাল ঝোল খেতে তেমন ঝাল নয়। আমার বেশ কয়েকজন ইউরোপীয় বন্ধু বলেছিল, পূর্ব আফ্রিকার খাবারের মাঝে সবচেয়ে সুস্বাদু হলো তানজানিয়ার খাবার। 

বাইরে ঝরোঝরো মুখর বাদল দিন। এ শহরের গাছপালা যেন পাল্লা দিয়ে বরিষণে বেড়ে চলে, বাড়িয়ে চলেছে সবুজের উদ্দামতা। আমি বৃষ্টিতে ভেজার উদ্দেশ্যে গাছপালা ঘেরা পথ ধরে হাঁটতে থাকলাম। এ দেশের বৃষ্টির সাথে আমাদের দেশের বৃষ্টির তফাত তো আছেই কিন্তু ভেজার আনন্দ একই। হাতে ছাতা নিয়ে, মাথায় মেলে না ধরে ভিজতে ভিজতে যখন গেস্ট হাউসে এলাম তখন জেসিকা মনে করল আমার মাথা পুরোই খারাপ। আরেক দফা ভেজার আদর্শ স্থান হলো এদের বাগান। কফির পেয়ালা হাতে বৃষ্টিতে ভেজার এক ঝুড়ি আফ্রিকান আনন্দ আর কোথায় পাব! 

পরদিন খুব ভোরে উঠতে হলো। আজ আমি যাব তানজানিয়ার  উল্লেখযোগ্য ন্যাশনাল পার্ক সেরেঙ্গেটি। মাইগ্রেশনের সময় মানে জুলাই-আগস্ট মাসে প্রচুর পশু দেখতে পাওয়া যায়। আমি ইচ্ছে করেই বর্ষাকালে এসেছি। এত সবুজ আর সতেজ বছরের অন্য কোনো সময় দেখা যায় না। নাইবা দেখলাম ঝাঁকে ঝাঁকে বিগ ফাইভ। 

একা ভ্রমণের সুবিধা যেমন, তেমনি কিছু অসুবিধেও আছে। একা চাইলেই একটা জিপ নিয়ে ন্যাশনাল পার্কে সাফারি করার মতো সামর্থ্য আমার নেই। তাই কয়েকজন মিলে একটা জিপ ভাড়া নিয়ে যাওয়া যায়। কেনিয়ায় আমার সাথে কয়েকজন ইউরোপীয় মেয়ের পরিচয় হয়েছিল। ওরাও তানজানিয়ায় আসছিল। আমরা চারজন তাই ঠিক করেছিলাম একসাথে সাফারি করব। ওরা আরুশায় অন্য একটা গেস্ট হাউসে উঠেছে। জিপ ড্রাইভার এন্ডু প্রথমে আমাকে তুললো গেস্ট হাউস থেকে, তারপর মারিয়া, ডিয়ানা, ওরিয়ানাকে একসাথে।

পূর্ব আফ্রিকার শহর ছাড়লেই সবচেয়ে ভালো লাগে যে বিষয়টি তা হলো সোজা পিচঢালা পথ নেমে গিয়েছে পাহাড়ের ঢালে, আবার উঠে গিয়েছে। দু’পাশের শ্যামলিমার জুড়ি নেই। জনসংখ্যা কম বলে এ দেশে পথের দু’পাশে গ্রাম বা শহর ছাড়া বাড়িঘর বাজার, মানুষ তেমন চোখে পড়ে না। প্রায় চার ঘণ্টার লম্বা পথে তিন-চারটে ছাড়া আর মফস্বল শহর বা গ্রাম পেলাম না। বাকি দেশজুড়ে শুধুই শস্যক্ষেত বা অনাবাদি জমি। এখন অবশ্য সবই সবুজ হয়ে গিয়েছে। 

আফ্রিকার যে ব্যাপারটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে, তা হলো পথেঘাটে কেউ গাড়ির হর্ন বাজায় না। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার হলো কেউ চেঁচিয়ে কথাও বলে না। গ্রাম বা শহরের কোথাও কোনো ময়লা আবর্জনা পড়ে নেই। সবকিছু ছবির মতো ঝকঝকে পরিষ্কার। 

এসব মাধুর্য দেখতে দেখতে আমরা সেরেঙ্গেটি ন্যাশনাল পার্কের গেটে এসে পৌঁছালাম। টিকিট কেটে শুরু হলো আমাদের সাফারি বা স্থানীয় ভাষায় গেম ড্রাইভ। এন্ড্রু জিপের ছাদ খুলে দিলো যাতে আমরা খোলা অংশে মাথা বাড়িয়ে পশুপাখি দেখতে পারি ভালোমতো।  

গেম ড্রাইভের সময় সব জিপেই ওয়াকিটকি থাকে। যে কোনো জিপ জঙ্গলে বা পার্কে যদি পশুর দেখা পায় তাহলে সাথে সাথে ওয়াকিটকিতে ন্যাশনাল পার্কে অবস্থান করা অন্যান্য জিপকে জানিয়ে দিতে পারে যাতে অন্যরাও তা দেখতে পায়। এই সাফারি পার্কে প্রবেশের সাথে সাথেই ঝাঁকে ঝাঁকে জেব্রা দেখলাম। এতদিন দেখেছি মাঠে গরু চড়ে বেড়ায় এখন দেখছি জেব্রারাও গরুর মতোই চড়ে বেড়ায় আর মাথা নিচু করে ঘাস খায়। আকারে আমাদের দেশের গাধার সমান। এন্ড্রু বলল, ‘একেক ন্যাশনাল পার্কের জেব্রার গায়ের ডোরাকাটা দাগ নাকি দেখতে একেক রকম।’ জেব্রার সাথে ওয়াইল্ডবিস্ট বা মহিষ একসাথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এন্ড্রু বলল, ‘এরা সবসময় একসাথে ঘুরে বেড়ায় কারণ জেব্রার দৃষ্টিশক্তি ভালো আর ওয়াইল্ডবিস্টের শ্রবণ ও ঘ্রাণশক্তি অসাধারণ।’ জেব্রা অপেক্ষাকৃত লম্বা ঘাস খায় আর ওয়াইল্ডবিস্ট খায় ছোট ছোট ঘাস। সিংহের আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য বা খাদ্যের খোঁজে এরা একসাথে চলাফেরা করে নিজেদের পঞ্চ ইন্দ্রিয় কাজে লাগিয়ে। 

এই অভয়ারণ্যের পাশেই প্রচুর সোনালি রঙের হরিণ দেখলাম। এদের বলে গ্যাযেল। এখানে অনেক ধরনের হরিণ দেখতে পাওয়া যায়। গ্যাযেল দলের মেয়েরা সব একসাথে চড়ে বেড়ায়। অবশ্য দলে মেয়েদের সাথে অবশ্যই একটি পুরুষ গ্যাযেল থাকবেই, এটাই দলের নিয়ম। পুরুষ গ্যাযেলের লম্বা শিং থাকে, মেয়েদের থাকে না। 

জিপ যত সামনে এগোচ্ছে তত রহস্যময় হয়ে উঠছে এই জল ও জঙ্গল, ঝোঁপঝাড়, দূরের সবুজ পাহাড়। সমতল বনভূমিতে বৃষ্টির জন্য কিছু কিছু জায়গায় জল জমে জলাশয় করে তুলেছে। খানিক দূরে সতেজ আর সবুজ বনভূমির একটা বাবলা বা অ্যাকাশিয়া গাছের পাশে যে খানকতক জিরাফ মনের আনন্দে গাছের পাতা চিবোচ্ছে তা প্রায় ফেলেই আসছিলাম। হঠাৎ ডিয়ানার চিৎকারে এন্ড্রু জিপ থামালো। কি মায়া মায়া চেহারা জিরাফের, কি শান্ত প্রাণী এরা! মনে হয় কোলে করে বাড়ি নিয়ে যাই। এক মনে পাতা খেয়েই যাচ্ছে। এদের মধ্যে একজন আবার হেলেদুলে হেঁটে বেড়াচ্ছে। সাধারণত জিরাফদের জিপের খুব কাছে দেখতে পাওয়া যায় না, এরা দূরেই থাকে। 

আমি উসখুশ করছি। কখন সিংহের দেখা পাব। জিপ চলছে নিজের গতিতে। সামনে কয়েকটি জিপ দাঁড়িয়ে। আমরাও থামলাম। এখানে হাতিরা স্বর্গ বসিয়েছে। বড়, ছোট, বাচ্চা সব ধরনের হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আফ্রিকার হাতি অন্যান্য মহাদেশের হাতির চেয়ে আকারে বড়। এরা দলবেঁধে চলাফেরা করে। দলের নেতা হলো বয়স্ক মা হাতি। দলের সবাই তার আদেশে ঘোরাফেরা করে। দলবদ্ধ হয়ে চলাফেরা করার কারণ খাদ্য বণ্টনে সুবিধা হয়, বাচ্চা হাতিদের দেখাশোনা করা যায় যেন কোনো বিপদে না পড়ে। একদল হাতির মাঝে আমাদের জিপের সামনে এসে একজন শুঁড় এগিয়ে দিলো। মারিয়া তো খুশিতে শুঁড় জড়িয়েই ধরতো। কিন্তু এসব করা নিষেধ তাই সংযত আছে সে। একের পর এক হাতিরা সারিবদ্ধভাবে রাস্তা পার হলো। দেখে আমরা আরেকটু এগোলাম। এক জায়গায় এসে দেখি এক দল জেব্রা ঘাস খাচ্ছে। কিন্তু এন্ড্রু বলছে, এর কাছাকাছি সিংহ আছে। আমি তো দেখতে পাচ্ছি না। সবাই ছাদ খোলা জিপের উপরের অংশে মাথা বের করে আছি। এই এলো বলে। হঠাৎ এক সবুজ টিলার উপর দু’জন মহারানীকে দেখা গেল। তারা এমনভাবে বসে আছেন যেন রোদ পোহাচ্ছে। মোটেও ক্ষিপ্ত বা ক্ষিপ্র নয়। অদূরেই একপাল জেব্রা, অন্যপাশে হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে কিন্তু তাদের কোনো হেলদোল নেই। 

ধীরে ধীরে এনাদের একজন উঠে জেব্রাদের দিকে এমনভাবে এগোলেন যেন তাঁরও একটু ঘাস খাবার ইচ্ছে জেগেছে। বিধাতা আর সিংহীর মনে যে কি থাকে তা তেনারাই জানেন। ইনি ধীরে ধীরে এক জেব্রার কাছে গেলেন, আরও ধীরে এগোলেন, আরও ধীরে এক লাফে জেব্রার ঘাড়ে চেপে বসতে চাইলেন কিন্তু জেব্রা ততক্ষণে সচেতন হয়ে গিয়েছে। সে আরও জোরে লাফ দিয়ে উঠে দৌড়াতে লাগল। শিকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় মহারানীর মেজাজ এখন তুঙ্গে। তিনি প্রতিশোধ নিয়েই ছাড়বেন। তিনি আরও দ্রুত গতিতে দৌড়ালেন শিকারের পেছনে। আত্মসম্মান এখন যায় যায়। কিন্তু শিকারের নিজের জান বাঁচানো ফরজ। সাক্ষাৎ যমের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে সে এখন নিরুদ্দেশ। এরপর শিকার বা শিকারীকে আর দৃষ্টিসীমায় পাওয়া গেল না। আমাদের আরও কত পশুপাখি যে দেখা বাকি! 

এই অল্প সময়ের মধ্যেই মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য ন্যাশনাল পার্কেও এক জায়গায় থামতে হলো। সেখানে জিপ থেকে নামার অনুমতি আছে এবং বসার ব্যবস্থা আছে। টেবিল আর বেঞ্চ পাতা। আশেপাশে প্রচুর বানর। আমাদের জন্য এন্ড্রু বক্সে খাবার এনেছিল। আমরা খাবার খাওয়ার মাঝে বানরেরাও ভাগ বসানোর জন্য কয়েকবার ছোঁ মেরে তুলে নিল আমাদের ভাগের জুস, চিকেন ফ্রাই, ফল। এদের খাবার দেয়া নিষেধ তাই এরা ছোঁ মেরে যা পায় তাই নিয়ে যায়। 

দিনের বাকি অংশ আমাদের কাটাতে হবে জঙ্গলে ঘুরে ঘুওে; এখন অবধি যা দেখিনি তা দেখার জন্য। এই ন্যাশনাল পার্কে গণ্ডার দেখতে পাওয়া প্রায় দুর্লভ ব্যাপার। গণ্ডার সাফারি জিপ এড়িয়ে চলে। তাই এদের দেখা যায় বহু দূরে। জিপের রাস্তা থেকে সরে গিয়ে এরা চড়ে বেড়ায় অন্য স্থানে। এন্ড্রু ওয়াকিটকিতে খবর পেয়েছে যে, অদূরে গণ্ডার দেখা গিয়েছে। কিন্তু এই অভয়ারণ্যে গণ্ডারের নাম করে যা দেখা যাচ্ছে তা একটি বিন্দুর সমান। বাইনোকুলার দিয়ে দেখা গেল যে চারটি গণ্ডার পাশাপাশি ঘাস খাচ্ছে। অন্যান্য পশুদের মতো এরাও দলবেঁধে চলাফেরা করে। এদের সাথে একটা বাচ্চা গণ্ডারও আছে। 

এর মাঝে বেশ কিছু পাখিও দেখে ফেললাম। জোড়া উটপাখি বেশ দূরে খুঁটে খুঁটে খাবার খাচ্ছিল। বিভিন্ন ধরনের হাঁস, শকুন, সারস পাখি দেখালো এন্ড্রু। ‘সেক্রেটারি’ নামে এক পাখি আছে, শরীরের অর্ধেক সাদা আর অর্ধেক কালো। সেক্রেটারির পোশাকের মতো রং বলে নাম সেক্রেটারি। এছাড়া ময়ূরের মতো দেখতে লেজহীন পাখির নাম ‘গিনিফাউল’। 

আফ্রিকান বিগ ফাইভের আরেকজন তখন এক মাথা ঝোঁপজঙ্গলের মাঝে বসে ছিলেন পড়ন্ত বেলায়। তিনি চিতা বাঘ। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল না। সবগুলো জিপ ভিড় করেছিল বলে বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, এখানে উল্লেখযোগ্য কেউ আছে। তেমন নড়াচড়া করছিল না বলে তার হাঁটাহাঁটির দৃশ্য দেখা গেল না। বিকেল গড়িয়ে আসছে। আমাদের ফিরতে হবে। ন্যাশনাল পার্কের গেট বন্ধ হয় ৬টা সময়। আমি ঘ্যানঘ্যান করছি সিংহ কেন দেখালো না এন্ড্রু। আমার সঙ্গে ওরিয়ানাও যুক্ত হলো। সামনে এন্তার ওয়াটার বাফেলো, বিভিন্ন জাতের হরিণ, শূকর, হনুমান, পাখি দেখিয়েও এন্ড্রু কূলকিনারা পাচ্ছিল না। আমার দেখা চাই কেশরে কেশরে কেশরাজ সিংহ। 

আমরা দিনশেষে ফিরেই যাচ্ছিলাম। প্রায় ৬টা বাজতে চলল। এর মাঝে এন্ড্রু জিপ ঘুরিয়ে দিলো ন্যাশনাল পার্কের দিকে। নতুন কিছু দেখাবে বোধহয়। এক জায়গায় জিপ থামিয়ে বলল, ‘ওই যে দূরে দেখ বনের রাজা দেখা যায়।’ আমরা হুমড়ি খেয়ে পারলে খোলা ছাদ বেয়ে উপরে উঠে যাই। দূরে সবুজ ঝোঁপের মাঝে এক চিলতে হলুদ দেখা যাচ্ছে। সাথে তার মহারানীও আছে। সাধারণত খাবার জোগাড় করার দায়িত্ব থাকে সিংহীর কাঁধে। সিংহ মহারাজ একটুও নড়াচড়া করে না। তিনি শুধু বসে বসে খান। মাঝে মাঝে নিজের শাবক খেয়ে ফেলারও রেকর্ড আছে তার। তাই সিংহী ছানাদের দূরেই রাখে। কাজ শুধু খাওয়া, রাজকীয়ভাবে হেঁটে বেড়ানো আর ঘুম। এর চেয়ে আরামের জীবন আর হয় না।  

আমাদের সাফারি সার্থক। আমরা ফিরে চললাম জঙ্গলের বাইরে আমাদের ক্যাম্পে। ঠান্ডা পড়তে শুরু করেছে। আজ ক্যাম্পে বারবিকিউ হবে; ক্যাম্প ফায়ার জ্বালিয়ে দিয়েছে ইতোমধ্যেই। আমাদের দিনের ক্লান্তি ঘুঁচে গেল। আমরা একরাশ উচ্ছ্বাস নিয়ে ক্যাম্প ফায়ারের চারপাশে গোল হয়ে বসে নতুন এক উৎসব উদযাপনে মেতে উঠলাম। তানজানিয়ার জঙ্গলবাসের চেয়ে বড় আনন্দ উৎসব এখন আর কিই-বা হতে পারে!

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়