ঢাকা     মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

ছয়চিরী দিঘির পাড়ে চড়কের মেলায়

সুমন্ত গুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১৩, ১৩ এপ্রিল ২০২৪   আপডেট: ১২:২৬, ১৩ এপ্রিল ২০২৪
ছয়চিরী দিঘির পাড়ে চড়কের মেলায়

জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের ওপর দিব্যি হেঁটে যাচ্ছে মানুষ! লম্ফ-ঝম্প করছে বলিচ্ছেদের ওপর। জিহ্বায় লোহার শলাকা ভেদ করে ঘুরছে এদিক-সেদিক। কেউ আবার পিঠে গেঁথে দেওয়া বড়শির সাহায্যে ২৫-৩০ ফুট উঁচু চড়ক গাছে ঝুলছে এবং চক্রাকারে ঘুরছে অনবরত। অনেকে আবার বলিচ্ছেদ-ত্রিশূল হাতে উদ্দাম নেচে চলেছে শিব-কালীর বেশে। দর্শনার্থীরা ঘিরে রেখেছেন তাদের। প্রত্যেকের চোখে বিস্ময়! তারপরও শত শত পুণ্যার্থী মুহুর্মুহু উলুধ্বনি আর ঢাক-কাসর-শাঁখের শব্দে মুখরিত করে তুলেছে গোটা এলাকা। 

আমরা আছি মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ছয়চিরী দিঘীর পাড়ে ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজায়। গেল বছর পহেলা বৈশাখের কথা। ছোট বেলায় চৈত্র মাসের শেষ দিকে দেখতাম, সন্ন্যাসীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিব পার্বতীর নৃত্যগীতের মাধ্যমে চড়ক পূজার জন্য চাল ও অর্থ সংগ্রহ করতেন। পরে ঐ সংগৃহীত চাল আর অর্থ দিয়ে পূজা করতেন সন্ন্যাসীরা। নগর জীবনে এখন তেমনটা আর দেখা যায় না। কয়েক বছর ধরে পরিকল্পনা করছি দুইশ বছরের পুরনো ছয়চিরী দিঘীর পাড়ে ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজায় যাব। কিন্তু পাপী মানুষ তাই ব্যাটে বলে মিলছিল না আমাদের। 

পূর্বের পরিকল্পনা মোতাবেক সকালবেলা আমরা হাজির হলাম শ্রুতি সিলেটের শত কণ্ঠে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। সেখানে আগে থেকেই মাইক্রোবাস আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। শ্রুতি-সিলেটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আমরা ছুটে চললাম ছয়চিরী দিঘীর পাড়ে ঐতিহ্যবাহী চড়ক পূজা দেখতে। আজ সবাই রঙ্গিন পোষাকে বের হয়েছে। চোখে মুখে নতুন প্রত্যয়ে চলার অঙ্গীকার। আজ শহরজুড়ে যানজট। তাই শহর থেকে বের হতে আমাদের কিছুটা বেগ পেতেই হলো। ও বলাই হলো না- আমাদের আজকের ভ্রমণসঙ্গী নাইম, সুদীপ, আকাশ। 

গাড়ি চলছে গন্তব্য পানে, আর গাড়িতে গান চলছে... বৈশাখী আমেজে । সূর্য দেবের প্রখর তাপে  জীবন অতিষ্ঠ; তার মাঝেই চলছি আমরা। এদিকে আমাদের নাইমের পেটের মধ্যে ইঁদুর ডাকছে। সেই সকাল বেলা বের হয়েছে, এর মধ্যে পেটে কিছেই পড়েনি। অন্য সবারই একি দশা। কিন্তু বিপত্তি হলো নাইম ছাড়া বাকি সবার আজ আমিষ খাওয়া বারণ। কোথায় নামা যায় পেটপূজার জন্য- ভাবতে ভাবতে সবাই অস্থির, শেষ পর্যন্ত সুদীপ বলল, আমরা শ্রীমঙ্গলের ঐতিহ্যবাহী ম্যানেজার স্টলে যেতে পারি, সেখানে গেলে সব সমস্যার সমাধান হবে। কথা মত আমরা ম্যানেজার স্টলে নামলাম। আমি স্পঞ্জের মিষ্টি খেলাম, অন্যরা রুটি সবজি খেলো। আমরা ম্যানেজার স্টলে যাত্রা বিরতি শেষে ছুটে চললাম গন্তব্যে। 

ঘড়ির কাঁটার গতির সাথে সাথে আমরা এসে পৌঁছলাম  কমলগঞ্জের রহিমপুর। গ্রামের পথে ঢোকার পরেও জ্যাম পিছন ছাড়ছে না। রাস্তার পাশে চড়ক পূজার মেলা বসেছে তাই এত জ্যাম। গাড়ি সামনেই যেতে পারছে না। আমরা নিরুপায় হয়ে গাড়ি থেকে নেমে পদব্রজে রওনা দিলাম। কয়েক হাজার মানুষ অপলক তাকিয়ে ৩০ ফুট উচ্চতার কাঠের দণ্ডের দিকে। তিনজন মানুষ শূন্যে ঘুরছে একটি রশিতে ঝুলে। দড়িটি বাঁধা ওই মানুষগুলোর পিঠের চামড়ার সঙ্গে গাঁথা বড় দুটি বড়শির সঙ্গে। উলুধ্বনি, শঙ্খধ্বনি, ঢোলর শব্দে কান পাতা দায়। বড়শিতে ঝুলে থাকা তিনজন তাদের সঙ্গে থাকা ফুল-জল, আবির, বাতাসা, নকুলদানা ইত্যাদি ছিটিয়ে দিচ্ছে অগণিত ভক্ত-দর্শকের দিকে। 

হঠাৎ আমার সহকর্মী নিরঞ্জনদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তার বাড়ি রহিমপুরেই। তিনি বললেন, ছয়চিরী দিঘির পাড়ের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে নানান আয়োজনে মেতে থাকেন স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ। পূজার কয়েকদিন আগে থেকে ভক্তরা শিব-গৌরি সাজে নেচে গেয়ে অর্থ সংগ্রহ করেন। এদিনগুলোতে তারা সন্ন্যাসব্রত ও উপবাস পালন করেন। এ সময়ে স্থানীয় শ্মশানগুলোতে হিন্দুরা নানান পূজা অর্চনাও করে থাকেন। রহিমপুর ইউনিয়নে বিশাল জায়গাজুড়ে ছয়চিরী দিঘি। এ দিঘির চারপাশেই বসে এই পূজার আয়োজন। 

নৃত্য করার জন্য এখানে কলাগাছ, বাঁশ দিয়ে তৈরি করা হয় মণ্ডলী। উৎসবের আগের দিন রাত থেকেই এখানে শুরু হয় নানান আনুষ্ঠানিকতা। মন্ত্র পড়ে গভীর রাতে জ্বলন্ত আগুনের উপর কালী সেজে নৃত্য করেন। এক বলে ‘কালীনাচ’। অন্যান্য ভক্তরা এ সময়ে নৃত্যের তালে তালে বাজান ঢোল। নারীরা উলুধ্বনি দেয়। কালীনাচ শেষে প্রভাতে পূজারীরা পূজা দিয়ে চড়ক গাছকে নিমন্ত্রণ জানান।

আগের বছরের পূজা শেষে ছয়চিরী দিঘিতে ডুবিয়ে রাখা চড়ক গাছ তুলে আনা হয় কূলে। এ গাছের দিঘির পাড়ে গর্ত খুড়ে খাড়া করে বসানো হয় চড়ক গাছ। একশ ফুট উঁচু এ গাছে চারটি ধাপে বাধা হয় মোটা বাঁশ। বাঁশের মাথায় বেঁধে দেওয়া হয় লম্বা মোটা রশি। ছয়চিরী দিঘির পূর্ব পাশে একটি, উত্তর পাশে একটি ও দক্ষিণ পাশে দুটি করে মোট চারটি চড়ক গাছ বসানো হয়। আশপাশটা ছেয়ে গেছে ধূপের ধোঁয়ায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে লাগল ঢাকের বোল। লোকে লোকারণ্য-  এক অন্য রকম পরিবেশ!

সূর্যদেবের বিদায় নেবার পালা আসার সাথে সাথে মেলার অন্তিম মুহূর্ত চলে আসে। সন্ন্যাসীরা ২৫-৩০ ফুট উঁচু চড়ক গাছে দ্রুত গতিতে ঘুরছেন। আর ভক্তদের উদ্দেশ্যে কলা-বাতাসা-শসা ছুড়ে দিচ্ছেন। সন্ন্যাসীর ছোড়া এসব জিনিস হাতে পাওয়ার জন্য ভক্তদের মধ্যে পড়ে গেল হুড়োহুড়ি। অনেকেরই বিশ্বাস, এসবে থাকে দৈবশক্তি। ঘোরার পাঠ সাঙ্গ করে সন্ন্যাসীকে একসময় চড়ক থেকে নামিয়ে আনা হলো। অনেক ভক্ত গিয়ে সন্ন্যাসীকে প্রণাম করছে মনোবাঞ্ছা পূরণের নিমিত্তে। আমারা মেলার আশপাশে ঘুরে দেখতে লাগলাম হরেক রকমের সামগ্রী নিয়ে বসেছে বিক্রেতা মাটির পাত্র, হস্ত শিল্প, কাঠের তৈরি নানান দ্রব্য, মুড়ি, মুড়কি, মিঠাই সব আছে। এদিকে ঘড়ির কাঁটার গতি কেউ রুখতে পারে না, তাই আমাদের আবার ফিরে আসতে হয় শহর পানে। 

কীভাবে যাবেন

প্রথমে ঢাকা থেকে রেল কিংবা সড়ক পথে আসতে হবে শ্রীমঙ্গল। সেখান থেকে মাইক্রোবাস কিংবা অটোরিকশা নিয়ে যেতে হবে কমলগঞ্জের রহিমপুর। ঢাকার ফকিরাপুল ও সায়দাবাদ থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সিলেট এক্সপ্রেস ইত্যাদি পরিবহনের নন এসি বাস যায় শ্রীমঙ্গল। ভাড়া সাড়ে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা। এ ছাড়া ঢাকার কমলাপুর থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬.৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস, দুপুর ২টায় প্রতিদিন ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস এবং বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ১০টায় ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। ভাড়া ১১৫ থেকে ৭৬৫ টাকা। পারাবত ও জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেন দুটি ভানুগাছ স্টেশনে থামে। কমলগঞ্জের রেল স্টেশনই  ভানুগাছে। এ দুটি ট্রেনে এসে কমলগঞ্জে নেমে সহজেই যাওয়া যাবে রহিমপুরে।

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়