ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ৩০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

মুন্সীগঞ্জে সংকট দেখিয়ে সার বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ

শেখ মোহাম্মদ রতন, মুন্সীগঞ্জ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৮, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫   আপডেট: ১২:৪৫, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫
মুন্সীগঞ্জে সংকট দেখিয়ে সার বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ

ট্রাক থেকে সার নামাচ্ছেন শ্রমিকরা

মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় সংকট দেখিয়ে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে অতিরিক্ত মূল্যে কৃষকদের কাছে সার বিক্রির অভিযোগ উঠেছে। কৃষকরা জানান, সব ধরনের সার কেজিতে ২ থেকে ১১ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের অভিযোগ, সরকারি দামে কেনার কথা বললেই সার না থাকার অজুহাত দিয়ে বিক্রি করছে না ডিলার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা। ফলে চলতি আলু মৌসুমে জমি আবাদ করতে আর্থিক চাপে পড়েছেন চাষিরা।

সারের ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা জানান, ডিলার পর্যায়ে ইউরিয়া সার ২৫ টাকা, ডিএপি (ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট) ১৯ টাকা, টিএসপি (ট্রিপল সুপার ফসফেট) ২৫ টাকা, এমওপি (মিউরেট অব পটাশ) ১৮ টাকা কেজিতে দেওয়া হয়েছে। কৃষক পর্যায়ে প্রতিকেজি ইউরিয়া ২৭ টাকা, ডিএপি ২১ টাকা, টিএসপি ২৭ টাকা ও এমওপি দাম ২০ টাকায় বিক্রির নির্দেশনা রয়েছে। 

আরো পড়ুন:

আলু চাষিদের অভিযোগ, মুন্সীগঞ্জ সদরের মুন্সিরহাট বাজারে সার ব্যবসায়ীরা সরু ইউরিয়ার সংকট দেখিয়ে মোটা ইউরিয়া সার ২৯ থেকে ৩০ টাকা, টিএসপি ৩৭ থেকে ৩৮ টাকা, ডিএপি ২২ থেকে ২৩ টাকা ও এমওপি ২১ থেকে ২২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছেন।

শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) দুপুরে মেসার্স সরকার ট্রেডার্স থেকে সার কিনে গাড়িতে উঠাচ্ছিলেন সদর উপজেলার বাগাইকান্দি এলাকার রহমান, সাদ্দাম ও করিমসহ কয়েকজন কৃষক।

কী দামে সার কিনেছেন জানতে চাইলে তারা জানান, সারের দাম বলে আর লাভ নেই। সরকার সারে ভুর্তুকি দেয় কৃষকদের জন্য, অথচ ডিলার-ব্যবসায়ীরা যে, যেভাবে পারছেন চাষিদের জিম্মি করে টাকা নিচ্ছেন। ১৩৫০ টাকা বস্তার টিএসপি ১৮৫০ টাকায়, ১০৫০ টাকার ডিএপি ১৪০০ টাকায়, ১৩৫০ টাকায় সরু ইউরিয়া কেনার কথা থাকলেও মোটা ইউরিয়া ১৫০০ টাকা করে বস্তা কিনতে হচ্ছে।

এদিন আরো ৮-১০ জন কৃষকের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, ২৭ টাকার সার ৩৮ টাকা নির্ধারন করেছে। প্রতি বস্তায় ৫৫০ টাকা বেশি দাম চাচ্ছে। সারের দামের মেমো চাইলে সেটিও দিতে চান না ব্যবসায়ীরা। দরদাম বেশি করলে দোকানে সার নেই, সারের মান ভালো হবে না বলে ব্যবসায়ীরা দোকান থেকে তাড়িয়ে দিচ্ছেন। এ কারণে কৃষকরা চলতি আলু আবাদ মৌসুমে চরম বিরম্বনায় পড়েছেন।

মুন্সীরহাট বাজারের রিমা ট্রেডার্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকজন কৃষক সারের দরদাম করছিলেন। দোকান মালিক মো. রাশেদ টিএসপি সার ৩৭ টাকা এবং ইউরিয়া, ডিএপি ও এমওপি সার কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা বেশি চাচ্ছেন। নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দাম চাওয়ায় এসময় সার না কিনে কৃষকদের অন্য দোকানের দিকে চলে যেতে দেখা যায়।

জানতে চাইলে সার বিক্রেতা মো. রাশেদ বলেন, “টিএসপি সার নেই। অন্য সারেরও সংকটও রয়েছে। ডিলাররা আমাদের সার দিচ্ছে না। নারায়ণগঞ্জ থেকে অতিরিক্ত দামে সার কিনে এনে বিক্রি করছি। তাই আমাদেরও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।”

বাজারে পর্যাপ্ত সার নেই, ডিলাররাও চাহিদামত সার দিচ্ছেন না বলে জানান মেসার্স মৃধা এন্টারপ্রাইজের মালিক শরীফ হোসেন। মায়ের দোয়া ট্রেডার্সের মালিক মো. ছালাউদ্দীনসহ কয়েকজন খুচরা সার বিক্রেতাদেরও একই অভিযোগ।

শনিবার বিকেলে মুন্সীরহাটের জনি ট্রেডার্স, রিমা ট্রেডার্স, গাজী ট্রেডার্স, রানু এন্টারপ্রাইজে গেলে সার সংকটের কথা জানান প্রতিষ্ঠানের মালিকরা। টিএসপি সার নেই বলে জানান তারা। বন্ধ পাওয়া যায় সরকার ট্রেডার্সসহ সহ ৮-১০টি সারের ডিলার ও বিক্রয় প্রতিষ্ঠান।

অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মুন্সীরহাটের গাজী ট্রেডার্সের সারের ডিলার জসিম গাজী। তিনি বলেন, “আমরা সরকারি নির্ধারিত মূল্যেই সার খুচরা বিক্রেতা ও কৃষকদের কাছে বিক্রি করছি। কৃষক ও খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বেশি দামে সার বিক্রি করা হচ্ছে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন।”

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, জেলায় বিসিআইসির ৭৭ জন ও বিএডিসির ১৪৪ জন সার ডিলার রয়েছেন। ২২১ জন ডিলারের জন্য চলতি রবি মৌসুমে ২৫ হাজর ৫৩৪ মেট্রিক টন ইউরিয়া, ১০ হাজার ৩৯১ মেট্রিক টন টিএসপি, ৩৩ হাজার ৮১৬ মেট্রিক টন ডিএপি ও ১৩ হাজার ৩০০ মেট্রিক টন এমওপি সারের বরাদ্দ রয়েছে।

এর মধ্যে সদর উপজেলার ডিলারদের জন্য ৫ হাজর ৬৮০ মেট্রিক টন ইউরিয়া, ২ হাজার ১৬৫ মেট্রিক টন টিএসপি, ৬ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন ডিএপি ও ২ হাজার ৬৮০ মেট্রিক টন এমওপি সারের বরাদ্দ রয়েছে। যা জেলার কৃষকদের জন্য পর্যাপ্ত বলে জানায় কৃষি বিভাগ।

জেলা সদরের যোগনী ঘাট এলাকার কৃষক মো. সাইফুল ইসলাম। তিনি এবার ১০ একর জমিতে আলুর আবাদ করবেন। গত একtzf সপ্তাহ ধরে মুন্সীগঞ্জ সদরের মুক্তারপুর, মুন্সীগঞ্জ শহরের হাটলক্ষীগঞ্জ ও মুন্সিরহাট বাজারে ঘুরে ঘুরে অতিরিক্ত দামে কিছু সার কিনেছেন। এখনো সার কেনার জন্য ঘুরছেন।

গত তিনদিন ধরে এসব এলাকার দোকানে সার কিনতে দৌড়ঝাঁপ করলেও টিএসপি সার নেই। অন্যান্য সারের দামও কেজিতে ২ থেকে ৪ টাকা করে বেশি চাচ্ছে বলে জানান এই আলু চাষি।

সার সংকট ও বেশি দামে বিক্রির চিত্র জেলার টঙ্গিবাড়ী উপজেলাতেও দেখা গেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মুন্সীগঞ্জ সদরের মতো জেলার ছয়টি উপজেলায় অতিরিক্ত দামে সার বিক্রি করছেন ডিলার ও ব্যবসায়ীরা।

টঙ্গীবাড়ী উপজেলার চাঠাতিপাড়া গ্রামের কৃষক মিঠুন মন্ডল এবার ৬৫০ শতক জমিতে আলুর আবাদ করছেন। তিনি বলেন, “১০ দিন টঙ্গিবাড়ী বাজারের বিভিন্ন ডিলারের দোকান ঘুরেছি। কোথাও টিএনপি সার নেই। টিএসপি বাদে অন্য সার কিনতে বাধ্য হয়েছি। যেখানে সরকারি দামে সার কিনলে খরচ হত ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, সেই সার সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের কারণে ১ লাখ ৬০ হাজার টাকায় কিনতে হয়েছে। শত শত কৃষককে ভুগতে হচ্ছে।”

জেলার কোথাও সারের সংকট নেই এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে সার রয়েছে বলে জানান জেলা কৃষি প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা মো. তাজুল ইসলাম। তিনি জানান, বছরের এ সময় জেলায় আলু আবাদের জন্য সারের ব্যাপক চাহিদা থাকে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা সারের দাম বেশি রাখছেন। আমরা ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অভিযান শুরু করেছি। বিভিন্ন উপজেলায় আমাদের কর্মকর্তারাও অভিযান চালাচ্ছেন।

মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসক সৈয়দা নুরমহল আশরাফী বলেন, “প্রশাসন প্রতিটি উপজেলার প্রতিটি বাজারে তদারকি শুরু করেছেন। আমাদের জেলায় পর্যাপ্ত পরিমাণে সার মজুত রয়েছে। ডিলারদের তাদের চাহিদা অনুসারে সার সরবরাহ করা হচ্ছে। এরপরেও যারা সারের কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে সার বিক্রি করছেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

ঢাকা/রতন/মাসুদ

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়