জাতীয়

‘ভাই না থাকলে আমি অনেক আগেই আত্মহত্যা করতাম’

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের অ্যালেন শহরে ফারহান তৌহিদ ও তার ভাই ফারবিন তৌহিদ পরিবারের চার সদস্যকে হত্যা করেছেন। তারাও বেছে নিয়েছেন আত্মহননের পথ। মানসিক বিষণ্নতায় ভুগছিলেন ওই দুই সহোদর। হত্যাকাণ্ডের আগে ফারহান তৌহিদ ইনস্টাগ্রামে একটি দীর্ঘ ‘সুইসাইড নোট’ পোস্ট করেছেন। বিষণ্নতা যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা এই নোটে ফুটে উঠেছে। রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য সেই ‘সুইসাইড নোট’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।বিশাল সেই নোটের পঞ্চম পর্ব এখানে।

(ফারহানের নোটের শিরোনাম ছিল—পরিবারের সবাইকে হত্যার পর আমি আত্মহত্যা করলাম)

কলেজ ছাড়ার পর প্রথম কয়েক সপ্তাহ আমি আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে কেবল টিভি সিরিয়াল দেখে কাটিয়েছি। আপনি যদি ভাবেন যে আমার পরিস্থিতি বাজে হয়েছিল, তবে তার অবস্থা আরও খারাপ ছিল। ভাই অসম্ভব প্রতিভাবান, কিন্তু সে অনেক বেশি বিষন্ন ছিল এবং এটা নিয়ে সামাজিকভাবে কোনো কিছু করতে সে উদ্বিগ্ন ছিল। আমার নিজের জন্য যেগুলো প্রত্যাশার ছিল, তাকে সেই একই ধরনের ফালতু বিষয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। সে না থাকলে অনেক আগেই আমি আত্মহত্যা করতাম।

আমাদের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিরিয়াল ছিল দ্য অফিস। এটা আমাকে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টটির দিকে নিয়ে যায়। মাইকেলে (সিরিয়ালের চরিত্র) যখন চলে যায় তখনই দ্য অফিসের সমাপ্তি টানা উচিত ছিল।আমাকে ভুল বুঝবেন না, এরপর অনেক ভালো পর্ব হয়েছে (সিজন ৩ ও ৭ আমার প্রিয়), কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটা ফালতু হয়েছিল।

পুরো বিষয়টি হলো, অফিসের লোকজন আনন্দের মধ্যে থাকে, তবে সেটা গ্রহণযোগ্য পরিস্থিতিতে।কিন্তু পরে তারা রবার্ট ক্যালিফোর্নিয়াকে নিয়ে আসলো। এই চরিত্রটি নিজেকে প্রধান নির্বাহী করতে একটি মাল্টি মিলিয়ন ডলার কোম্পানির মালিককে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিল। এরপর বেকুব ব্রিটিশ তরুণী, যারা নাম আমি মনেও করতে পারছি না, সে অ্যান্ডির চাকরি খেয়ে ফেললো এবং কেউ তার পাশেও দাঁড়ালো না। নাটকে তাদের বন্ধন দেখানো হলো কিন্তু কেউ তাকে সমর্থন দিলো না।

কি ফালতু এক ব্যাপার। এটি মোটেও বাস্তব নয় এবং আমাদের বিকশিত চরিত্রগুলোর মুখে এটি থুথু দেয়। যার কথা বলছি, সেই অ্যান্ডিকে কেন শেষ সিজনে পাগল হতে হবে? নাটকের প্রত্যেকটি চরিত্রের মধ্যে তার আত্মপ্রকাশ ছিল সবচেয়ে বেশি। তার রাগ সামাল দেওয়ার সমস্যা ছিল এবং প্রচণ্ড চাটুকার ছিল। তবে সত্যিকারের যত্নশীল এবং খাঁটি মানুষ ছিলেন। তার পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় এবং তিনিই সেই ব্যক্তি যে বিশৃঙ্খলা দূর করেছিল। কিন্তু তারপরে সে এলোমেলোভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ফালতু নৌভ্রমণের, যার কোনো কারণ ছিল না। সে এরিনের জন্য পুরো ফ্লোরিডা ঘুরেছে। কিন্তু তাকে স্রেফ একটি নৌভ্রমনের জন্য সে একা ছেড়ে গিয়েছিল? জঘন্য? শেষ পর্যন্ত দলের সবচেয়ে খারাপ পরিণতি হয় তার।

খুব ভালো। মানুষ বলে যে, সমাপ্তি টানার জন্য এটি করা হয়েছে যা পুরোপুরি মিথ্যা। নিশ্চিতভাবেই এটা সুন্দর ছিল।তবে আমাদেরকে যে শেষ কয়েকটি ফালতু সিজন দেখতে হয়েছে এটি তার মূল্যায়ণ করে না।মাইকেল অবশ্য এই পর্বগুলোতে ছিল, তবে কেবল দুটি সিজনে। আমি আরও অনেক কিছু বলতে চাই। কিন্তু জীবন ছোট।

আমরা ২০২১ সালের ২১শে ফ্রেব্রুয়ারি পর্যন্ত সিরিয়াল দেখা চালিয়ে যাই। ওইদিন আমার বড় ভাই একটি প্রস্তাব নিয়ে আমার ঘরে এসেছিল- আমরা যদি এক বছরের মধ্যে সব ঠিক করতে না পারি, তাহলে আমরা আত্মহত্যা করব ও পরিবারের সবাইকে হত্যা করব।

আমাকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ দিন। আমাকে যারা চেনেন, তারা জানেন যে, আমি খাঁটি যুক্তির ওপর ভিত্তি করে কাজ করি। আমার পরিবারকে হত্যাসহ প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত উপকারের তালিকার ভিত্তিতে করেছি।

চলুন শুরু করা যাক জীবনের অর্থ দিয়ে। প্রত্যেকেই মনে করে জীবনের অর্থ গভীর অবিশ্বাস্য রহস্য দিয়ে ঘেরা, তবে আমি যে সিদ্ধান্তে এসেছি তা সত্যিই সহজ : অস্তিত্বের একমাত্র কারণ হলো সুখ। প্রকৃতপক্ষে, আপনি প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত নিজে নিজেই নেন, কারণ এটি আপনার সামগ্রিক সুখের ওপর প্রভাব বিস্তার করে। আমি জানি, আপনারা অনেকেই আমার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করবেন, তবে আশা করি আমি কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে আপনাদের বোঝাতে পারব।

আমাদের সিনেমা দেখা বা ভিডিও গেম খেলার মতো সুস্পষ্ট পছন্দ রয়েছে। এগুলো আমাদের আনন্দ দেয়, তবে এরপর আরও অস্পষ্ট এবং কম স্পষ্ট সিদ্ধান্ত রয়েছে। শিক্ষার্থীরা সরাসরি সুখের জন্য স্কুলে যায় না, তবে তারা বিকল্পটিকে সুখের জন্য আরও খারাপ হিসাবে দেখে, এটি তাদের বাবা-মাকে হতাশ করুক বা সুন্দর ভবিষ্যত নাই থাকুক, এরপরও তারা যায়, এভাবে তারা সুখে অবদান রাখে।

অন্যরা স্কুল বাদ দেওয়াকে খারাপ সিদ্ধান্ত হিসাবে দেখে এবং স্বল্পকালীন সুখকে আরও মূল্যবান হিসেবে দেখে। আপনাদের মধ্যে যারা ধার্মিক তারা হয়তো বলবেন, আপনারা শুধু ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করার জন্যই বেঁচে থাকেন। তবে উপাসনা করা আরেকটি ভিন্ন সিদ্ধান্ত যা আপনাকে তৃপ্ত করে।

এমনকি কিছু ‘নিঃস্বার্থ’ জিনিস, যেমন-বিরক্তিকর বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে যাওয়া আপনাকে সুখী করার একটি উপাদান, কারণ এখানে না গেলে আপনার অন্যান্য বন্ধুরা আপনাকে আরও খারাপ মনে করবে। কাজে যাওয়া, মাদক নেওয়া, এমনকি আবর্জনা বের করার সিদ্ধান্তকেও আমরা কেবল আমাদের সুখ ও সুখের জন্য করি।

যদি বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ সুখ হয়, তাহলে যৌক্তিকভাবে সুখী না হলে আপনার বেঁচে থাকা উচিত নয়। এটা বুঝে এসেছে?  ভাবুনতো এক ঘন্টার জন্য ওয়াটারবোর্ডিং, ২০ মিনিটের জন্য বিদ্যুস্পৃষ্ট হওয়া, দ্য অফিসের নবম সিজনের প্রথম অর্ধেক দেখতে বাধ্য করা এবং অবশেষে ঘুমিয়ে পড়া।  এখন কল্পনা করুন, এই  চক্র মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আপনি পুনরাবৃত্তি করছেন। এই পর্বে , আমি নিশ্চিত যে আপনাদের প্রত্যেকেই মৃত্যুকে পছন্দ করবেন, আপনি এটি স্বীকার করতে চান বা না চান। যদিও আমি এই পরিস্থিতির মতো খারাপ অবস্থায় নেই, তবে আত্মহত্যার পরোয়ানা দেওয়ার পক্ষে এটি যথেষ্ট খারাপ। আমি এতোটা যন্ত্রণা ও অশান্তিতে বাস করি যে, তা বেঁচে থাকার মতো নয়। আমি জানি , আমার মৃত্যু অন্যদের জন্য দুঃখ নিয়ে আসবে, তবে আমার ধারণা এটি তোয়াক্কা করার ক্ষেত্রে আমি খুব স্বার্থপর।

অবশ্য যথেষ্ট স্বার্থপর নই। আমার পরিবার আছে:  ১৯ বছর বেঁচে থাকতে বাধ্য হওয়াটা এর একটি কারণ। আমি জানি আমি বলেছিলাম যে, আমি যুক্তি দিয়ে চলি। তবে জীবনের একটি অনুভূতিই আমার এখানে থাকার একমাত্র কারণ। আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি। আমি সত্যিকারার্থেই ভালোবাসি। ঠিক এই কারণেই আমি তাদের হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

আরও পড়ুন

সুইসাইড নোট (১) সুইসাইড নোট (২) সুইসাইড নোট (৩) সুইসাইড নোট (৪)