জাতীয়

করোনায় বিপাকে শিশু শ্রমিকরা 

সামান্য আগেই ইফতার বিক্রি শেষ হয়েছে। দোকানের সামনে অনেকগুলো তৈজসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আশপাশে কয়েকটি কুকুর খুবলে পড়ার চেষ্টা করছে। তাদের সঙ্গে পেরে উঠছে না ৮ থেকে ১০ বছরের একটি শিশু হানিফ। হ্যাঁ, হানিফ একজন শিশু শ্রমিক।

রাজধানীর কাঁঠালবাগান বাজার এলাকায় একটি ছোট রেস্টুরেন্টে সর্ব কনিষ্ঠ শ্রমিক। সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত একটানা কাজ করতে হয় তাকে। শুরুতে তার কাজ ছিল শুধু টেবিল মোছা আর গ্রাহকদের পানির গ্লাস ভরে দেওয়া। বেশ চটপটে স্বভাবের। খুব অল্প সময়েই সে এখন অন্যান্য কাজের সঙ্গেও নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।

হানিফের শিশু শ্রমিক হয়ে ওঠার কাহিনি খুব একটা সাদামাটা নয়। পড়ালেখা করার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু হানিফ তার স্বপ্ন ভুলে বাস্তবতার সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।

হানিফদের বাড়ি কিশোরগঞ্জে কটিয়াদি। বাবা সালাম মিয়া ভূমিহীন কৃষক ছিলেন। রোগাক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহের জন্য পৈত্রিক ভিটাটুকুও হারাতে হয়। বাধ্য হয়ে তারা চলে আসে ঢাকা। ওঠেন কাঁঠালবাগান এক খুপড়ি ঘরে। বাবা রিকশা চালান। যা আয় হয় তা দিয়েই তাদের সংসার চলতো। কিন্তু এভাবে বেশি দিন যায়নি। ঢাকা আসার একবছরের মাথায় বাবা মারা যান। হানিফকে নিয়ে তার মা চোখে অন্ধকার দেখেন। এমন সময় নিজ এলাকার সফুরা খালার সঙ্গে তার মা’র দেখা হয়। তিনিই একটি বাড়িতে কাজ খুঁজে দেন। হানিফ তার মায়ের কাছেই ঘরে পড়ালেখা করেছে। এরই মাঝে হানিফের মাও অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় হানিফের মা যার বাসায় কাজ করতেন তিনি তার পরিচিত একটি রেস্টুরেন্টে হানিফের কাজের সুযোগ করে দেন। সেই থেকে হানিফ শিশুশ্রম বাজারের একজন সদস্য।

হানিফ রাইজিংবিডিকে জানায়, তেমন কষ্টের কাজ তাকে করতে হয় না। মালিক খুব ভালো মানুষ। 

কী কী কাজ করতে হয় জানতে চাইলে হানিফ বলেন, প্লেট ধোঁয়া, পানি দেওয়া, টেবিল মোছা। এ কাজ কেমন লাগে জিজ্ঞেস করলে সে মাথা নিচু করে নীরব থাকে। বেতনের কথা জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়, ‘মায় জানে।’

দেশে ২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয়। সরকার প্রথম দিকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এরমাঝে একবছরের বেশি সময় চলে গেছে। কিন্তু অবস্থার তেমন পরিবর্তন হয়নি। গত একবছর ধরেই দেশের মানুষ অনেকটাই অবরুদ্ধ করোনার কারণে। মানুষের রোজগারের পথ সংকুচিত হয়ে পড়ে। কিন্তু চাহিদা কমেনি। কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর বড় একটি অংশ বেকার জীবন-যাপন করছেন। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা যেসব ঘরে কর্মজীবীরা কর্মহীন বসে আছেস।

হানিফের নিয়োগকর্তা বেলাল হোসেন বলেন, ‘ওর মা অনেকদিন ধরেই অসুস্থ। আমার বাসায় কাজ করতেন। অসুস্থতার কারণে নিয়মিত কাজ করতে পারেন না। আমার স্ত্রীর অনুরোধে হানিফকে এখানে কাজ দিয়েছি। টুকটুক কাজ করে। কোনো চাপ দেওয়া হয় না। খুবই চটপটে। ওর ব্যবহারে দোকানের গ্রাহকরাও খুশি। এতটুকু ছেলে কাজ করে সংসার চালায় নিজের কাছেই খারাপ লাগে। কিন্তু কী আর করতে পারি। করোনার কারণে ব্যবসা একেবারেই শেষ। রোজার কারণে এখন কিছুটা ইফতার বিক্রি হয়। করোনা না কমলে তো অবস্থা আরও খারাপ হবে।’ 

করোনার কারণে হানিফের মতো আরও অনেককে শ্রমবাজারে নিজেদের নাম লেখাতে হচ্ছে। কিন্তু সে বাজারের আকারও খুবই ছোট। সরকারি নানা উদ্যোগে শিশুশ্রম কিছুটা কমে এলেও একেবারে বন্ধ হচ্ছে না। সরকার ছয়টি শিল্প খাতকে শিশুশ্রমমুক্ত ঘোষণা করেছে। সে ঘোষণা শিশুশ্রম বন্ধে কতটা কার্যকর হবে সেটা নিয়েও সন্দেহ অনেকের। 

ফার্মগেট থেকে নিউমার্কেট রুটে লেগুনা চালায় ফারুক। সে একসময় ঢাকা কলেজের সামনে একটি হোটেলে ধোঁয়ামোছার কাজ করতো। তার বয়স এখন ১৬। বিভিন্ন পেশা বদলে সে এখন লেগুনা চালক।  হেলপার আজিম। তার বয়স ১২। জীবিকার তাগিদে সেও এখন শ্রম বাজারে।

ফারুক বলে, ‘করোনার কারণে মাঝেমধ্যে গাড়ি বন্ধ রাখতে হচ্ছে। সংসারে টাকা দিতে পারছি না। বাড়ি গেলেই বাবা বকাবকি করে। সে কারণে বাড়িতেও থাকতে পারি না। করোনার কারণে আমার মতো অনেকেই এখন বেকার। জানি না কী হবে।’ এসময় অনেকেই নেশার জগৎসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বলেও সে জানায়। 

এসডিজি অর্জনে সরকার শিশুশ্রম দূর করতে বদ্ধপরিকর। ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম ও ২০২৫ সালের মধ্যে সব ধরনের শিশুশ্রম বন্ধের পরিকল্পনা সরকারের থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। দেশের জাতীয় শ্রম আইন-২০১৬ (সংশোধিত ২০১৮) অনুযায়ী ১৪ বছরের কম বয়সী শিশুদের কোনো ধরনের কাজে নিযুক্ত করা যাবে না। যদি কেউ শিশু শ্রমিক নিয়োগ করে, তাকে পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড করার বিধান রয়েছে। ১৪ থেকে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত কিশোরদের হালকা কাজ করার কথা উল্লেখ থাকলেও দেশের চিত্র ও বাস্তবতা অন‌্যরকম।

রাজধানীর সড়কে লেগুনা, বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনের হেলপার অপ্রাপ্তবয়স্ক। গ্যারেজ, ওয়ার্কশপ, মিল-কারখানা, সিগারেট বিক্রি, ফুল বিক্রি, ফুটপাতে পানি বিক্রি, বাদাম বিক্রি ও হোটেল-রেস্টুরেন্টের কর্মচারী এবং মহাসড়ক জুড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গাড়িতে বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করে অনেক শিশু। সংশ্লিষ্টরা জানান, রাজধানীতে শিশুরা শ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার পাশাপাশি অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়াচ্ছে, মাদক বহনের মতো অপরাধমূলক কাজে ব্যবহার করা হয় শিশুদের।

সরকার ৩৮টি ঝুঁকিপূর্ণ কাজের তালিকা করেছে, যার মধ্যে গণপরিবহন অন্যতম। এ বছর দেশের ছয়টি শিল্প খাতকে ‘শিশুশ্রমমুক্ত’ ঘোষণা করেছে সরকার। খাতগুলো হলো, রেশম, ট্যানারি, সিরামিক, গ্লাস, জাহাজ শিল্প, রপ্তানিমুখী চামড়াজাত ও পাদুকা শিল্প।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও ইউনিসেফ এক প্রতিবেদনে বলেছে, কোভিড-১৯ সংকটের ফলশ্রুতিতে লাখ লাখ শিশুকে শিশুশ্রমে ঠেলে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, যা গত ২০ বছরের অগ্রগতির পর প্রথম বারের মতো শিশুশ্রম বাড়িয়ে দিতে পারে।

‘কোভিড-১৯ ও শিশুশ্রম: সংকটের সময়, পদক্ষেপের সময়’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত শিশুশ্রম ৯ কোটি ৪০ লাখ কমেছে, কিন্তু এই অর্জন এখন ঝুঁকির মুখে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এরই মধ্যে শ্রমে থাকা শিশুদের হয়ত আরও বেশি কর্মঘণ্টা কাজ করতে হচ্ছে বা তাদের আরও খারাপ পরিবেশে কাজ করতে হতে পারে। তাদের মধ্যে আরও বেশি সংখ্যক শিশুকে হয়ত ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে নিযুক্ত হতে বাধ্য হবে, যা তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ক্ষেত্রে মারাত্মক হুমকির কারণ হবে।

আইএলওর মহাপরিচালক গাই রাইডার বলেন, ‘মহামারি পারিবারিক আয়ে বিপর্যয় নিয়ে আসায় কোনো সহায়তা না পেয়ে অনেকেই শিশু শ্রমে নিয়োজিত হতে বাধ্য হবে।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯ এর ফলে দারিদ্র্য বেড়ে গিয়ে শিশু শ্রম বাড়াবে। কারণ বেঁচে থাকার জন্য পরিবারগুলো সম্ভাব্য সবভাবে চেষ্টা করবে। কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, নির্দিষ্ট কিছু দেশে দারিদ্র্য ১ শতাংশীয় বৃদ্ধিতে শিশুশ্রম অন্তত দশমিক ৭ শতাংশ বাড়বে।

ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, ‘সংকটের সময় অনেক পরিবারই টিকে থাকার কৌশল হিসেবে শিশুশ্রমকে বেছে নেয়।’

বাংলাদেশে আইএলও’র কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পৌটিআইনেন বলেন,‘বর্তমান সংকটের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশ শিশু শ্রম হ্রাসে দারুন কাজ করে আসছিল।’

বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি তোমো হোযুমি বলেন, ‘সবচেয়ে অসহায় শিশুদের জীবন, আশা-আকাক্ষা ও ভবিষ্যতের ওপর কোভিড-১৯ মহামারি বিশেষ নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। স্কুল বন্ধ ও পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় অনেক শিশুর জন্য শ্রমে যুক্ত হওয়া এবং বাণিজ্যিকভাবে যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।’

গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুরা যত বেশি সময় স্কুলের বাইরে থাকে তাদের আবার স্কুলে ফেরার সম্ভাবনা ততটাই কমে যায়। আমাদের এখন শিশুদের শিক্ষা ও সুরক্ষার ওপর অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত এবং মহামারির পুরো সময়জুড়েই তা অব্যাহত রাখা উচিত।’

প্রতিবেদনে শিশু শ্রম বৃদ্ধির ঝুঁকি মোকাবিলায় বেশ কয়েকটি পদক্ষেপের সুপারিশ করা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে অধিকতর সমন্বিত সামাজিক সুরক্ষা, দরিদ্র পরিবারের জন্য সহজে ঋণ পাওয়ার সুযোগ, বড়দের মানসম্মত কাজের সুযোগ বৃদ্ধি, স্কুলের বেতন বাতিলসহ শিশুদের স্কুলে ফেরা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ, শ্রম পরিদর্শন ও আইন প্রয়োগে সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়গুলোও রয়েছে।

এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘করোনার কারণে দেশের অনেক মানুষ অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এ সময় দরিদ্র মানুষের সংখ‌্যাও বেড়েছে। মানুষ আয় বাড়াতে শিশুদের শ্রমবাজারে ঠেলে দিচ্ছে। অভাবের তাড়নায় আসা এসব শিশুরা অনেক কম দামে তাদের শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে। হয়তো এদের অনেকেই স্কুল ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। এই সব শিশুদের হয়তো আর স্কুলে ফেরা হবে না।’ 

তিনি বলেন, ‘সরকার সাধারণ মানুষের জীবিকা নির্বাহের জন্য গরিবদের হাতে নগদ সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এই অর্থ তাদের হাতে পৌঁছানোর পর অবস্থা কিছুটা হলেও পরিবর্তন হবে। আর এই বিপর্যয় দীর্ঘায়িত হলে শিশুশ্রম সমস্যাটা বাড়তে পারে।

## ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের তথ্যে গড়মিল, বাস্তবায়নে কচ্ছপ গতি

## শাকিবের ছোট কাঁধে বড় দায়িত্ব 

## রান্না ঘরে গৃহকর্মীর নীরব কান্না

## মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষ, মুজিববর্ষে গড়বো দেশ: মহান মে দিবস আজ

## করোনায় শ্রমজীবী মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসার আহ্বান রাষ্ট্রপতির

##‘সরকার শ্রমজীবী মানুষের জন্য সর্বাত্মক কার্যক্রম চালাচ্ছে’