রাইজিংবিডি স্পেশাল

করোনায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দৃষ্টি: চা শিল্পে ঈর্ষণীয় অগ্রগতি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘আশ্রয়ন প্রকল্পের’ মাধ্যমে গত ছয় মাসে জমির সঙ্গে স্থায়ী পাকা ঘরের মালিকানা পেয়েছেন এক লাখ ২৩ হাজার ২৪৪টি পরিবার। এছাড়া সমাজের পিছিয়ে পড়াদের নিয়ে রয়েছে সরকারের পৃথক প্রকল্প।  এসব প্রকল্পের আওতায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী পাচ্ছে ভালো থাকার নিশ্চয়তা। বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনযাত্রার মানও। বাদ যাচ্ছে না সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীও। তাদের জন্যও সরকারের রয়েছে নানা পদক্ষেপ, প্রকল্প।  রুপকল্প-২০৪১ কে সামনে রেখে পিছিয়ে পড়াদের এগিয়ে আনতে সরকারের নেওয়া এসব কর্মসূচির মাধ্যমে কীভাবে উপকারভোগী হচ্ছেন সুবিধাবঞ্চিত এই মানুষগুলো তা সরেজমিনে দেখেছেন রাইজিংবিডির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এসকে রেজা পারভেজ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে এসে পরিবর্তনের সেসব গল্পের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে পঞ্চম ও শেষ পর্ব।

যতদূর চোখ যায়, শুধু সবুজের সমারোহ। ছোট-বড় টিলায় সুবজ চা বাগানগুলো দূর থেকে দেখলে মনে হবে সবুজের ঢেউ লেগেছে।  চোখ জুড়িয়ে যাওয়া এই দৃশ্য শ্রীমঙ্গলের চা বাগানের। মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের মতোই এখন সাজানো এখানকার শ্রমিকদের জীবন। গত একযুগে তাদের জীবনেও এসেছে আধুনিকতার ছোঁয়া, বেড়েছে জীবনযাত্রার মান।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্ত আর বিশেষ পদক্ষেপের কারণে করোনার এই দুঃসময়েও চা শিল্পের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে উৎপাদন, বেড়েছে রপ্তানি। করোনাকালেও এই শিল্পের কর্মকাণ্ড একদিনের জন্যও থেকে থাকেনি।  সম্প্রতি হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজরের বিভিন্ন চা বাগান ঘুরে চা শিল্পের এই এগিয়ে যাওয়া চোখে পড়েছে। এ কারণে সেখানে শিল্পের সঙ্গে জড়িত শ্রমিকদেরও সংকটে পড়তে হয়নি।

শ্রীমঙ্গলের চা বাগানের শ্রমিক রেবেকা। প্রায় আট বছর ধরে কাজ করছেন। নিজের চোখে দেখেছেন চা শিল্পের উন্নয়নের চিত্র।  তার মতে, গত কয়েক বছরে চা শিল্পে খুব ভালো উন্নয়ন হয়েছে। এ কারণে তাদের জীবনযাত্রার মানও বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে ভাঙাচোরা ঘরে থাকতেন এখন পাকা ঘরে থাকেন। আগে কম বেতন বেতেনে যা নিয়ে চলতে কষ্ট হতো। এখন সেই তুলনায় বেশ ভালো আছেন।  পান আনুষাঙ্গিক বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধাও।

‘আমি প্রায় আট বছর থেকে কাজ করছি।  প্রতিদিন ৮ ঘণ্টা কাজ করি।  যেদিন যেমন পাতা পাওয়া যায় তেমন ইনকাম। সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করি। বাসায় দুই ছেলে-মেয়ে আছে। মেয়ে বিয়ে দিয়েছি চট্টগ্রাম। ছোট ছেলেও কাজ করে ফ্যাক্টরিতে।  আগে তো বেতন অনেক কম ছিলো, এখন ১১৮ টাকা মজুরি।  আগে থেকে খুব ভালো চলতেছি।”

নতুন বিয়ে হওয়া চা শ্রমিক বিশাখা রঙ্গিন ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেন।  সাত বছর শ্রীমঙ্গলের এই চা বাগানে কাজ করছেন তিনি।  স্বামীও কাজ করেন এখানে।  সাথে পান রেশনও।  তিনি স্বপ্ন দেখেন ছেলেকে উচ্চ শিক্ষিত করার। 

‘দুই বছর কাজ করছি স্যার। নতুন বিয়ে হয়েছে। একটা বাচ্চা আছে। সংসার করছি, কাজও করছি। জামাইও কাজ করে। বাগানের মানুষ বাগানে কাজ করতে ভালো লাগে। ছেলেটাকে মানুষ করবো’, বলছিলেন তিনি। 

শ্রীমঙ্গলের আমতলা চা বাগানের ম্যানেজার সোহেল রানা পাঠান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘২৪ কেজিতে ১১৮ টাকা এখন মজুরি পাচ্ছে তারা। অতিরিক্ত পাতা তুললে অতিরিক্ত টাকা পায়। যারা পারমানেন্ট তারা এর পাশাপাশি চিকিৎসা, বাসস্থান ফ্রি, প্রভিডেন্ট ফান্টসহ অন্যান্য সুবিধা পাচ্ছেন। আমরা চাই চা শ্রমিকরা যাতে উন্নত জীবন পায় সেদিকে আমরা সুদৃষ্টি রাখছি।’ 

জানা যায়, যখন করোনায় বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান লকডাউনে চলে যায় তখন চা বাগানেও একটা অস্থিরতা ছিলো।  প্রধানমন্ত্রী তখন চা বাগানের উৎপাদন অব্যাহত রাখার নির্দেশনা দেন। তার সেই নির্দেশনা ছিলো সুদূরপ্রসারী।  কারণ চা গাছ থেকে প্রতিদিন পাতা না তুললে পাতা নষ্ট হয়ে যায়। গাছও বড় হয়ে যায়। সর্বোপরি পুরো বাগান নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী একদিনের জন্যও চা উৎপাদন বন্ধ থাকেনি। এর ফলে শিল্পের উৎপাদন যেমন ঠিক ছিলো তেমনি চা শ্রমিকরাও করোনায় কর্মসংস্থান হারাননি, সংকটে পড়েননি। একই সময়ে ভারতে প্রায় একমাসের বেশি সময় চা উৎপাদন বন্ধ ছিলো। ভারতের চা উৎপাদন বন্ধ থাকায় অনেক বাগান নষ্ট হয়ে গেছে, গাছ কেটে ফেলতে হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনার সময়কালীন উৎপাদনমুখী অর্থনৈতিক খাতগুলোতে বিশেষ নজর ছিলো বলেই এই সময়েও সরকার চায়ের মতো শিল্পের উৎপাদন চালু রেখেছে। যা করোনায় দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক অবদান রাখতে পেরেছে। চা শ্রমিকদের জন্য সরকারের পাশাপাশি চা বাগানের মালিকদেরও ছিলো সৃদৃষ্টি।

চা শিল্পের উৎপাদন চালু রেখে অর্থনীতি অবদান রাখার সুযোগ দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিননন্দন ও কৃতজ্ঞতা জানান শ্রীমঙ্গলের ইস্পাহানি জেরিন চা বাগানের ম্যানেজার সেলিম রেজা।

তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমাদের কোম্পানি বিশ্বাস করে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন করতে হবে।  কারণ তারা ভালো থাকলে আমাদের বাগানও ভালো থাকবে প্রোডাকশনও ভালো হবে।  এজন্য শ্রমিকদের বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, মৌলিক যে বিষয়গুলো সেগুলো অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। প্রতিটি শ্রমিকের এখন পাকা বাড়ি।  আগে কাচা ছনের ঘরে ছিলো।  গত একযুগ ধরে তাদের এই উন্নয়ন করেছি। ঘরগুলো দেখতেও খুব চমৎকার।’

তিনি বলেন, ‘২০১২ সালে এই বাগানের শ্রমিকদের শতভাগ স্যানিটারির আওতায় আনা হয়েছে।  সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।  ডিপ টিউবয়েলের মাধ্যমে পানি উঠিয়ে তা বিশুদ্ধকরণ করে সেই পানি শ্রমিক লাইনে আমরা সরবরাহ করি।  আমরা-শ্রমিকরা সবাই একই পানি খাচ্ছি। ঝড় তুফানের আশ্রয় নেওয়ার জন্য দুটো করে শেল্টার রেখেছি বাগানে। পাকা সিঁড়ি করে দিয়েছি যাতে ওঠানামা সহজ হয়।  অর্থাৎ কর্মক্ষেত্র যাতে সহজ হয়।’ 

হবিগঞ্জে জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘কোভিড যখন সব লকডাউন ছিলো চা বাগান একদিনের জন্যও বন্ধ ছিলো না।  প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মতো তারা স্বাস্থ্যবিধি মেনে কাজ করতে পেরেছে। তাদের আহারে বা কর্মসংস্থানের কোনো সমস্যা হয়নি। আমরাও চেষ্টা করে যাচ্ছি তাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য। তাদের যাতে কোনো ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি না হয়।’ 

করোনাকালে অনেক জায়গায় বেতন-ভাতা নিয়ে জটিলতা হয়েছে কিন্তু চা বাগানের ক্ষেত্রে সেরকম কোনো সমস্যা পোহাতে হয়নি জানিয়ে হবিগঞ্জের বাহুবলের উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) স্নিগ্ধা তালুকদার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় করোনাকালে একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি চা-বাগান। 

চা শিল্পের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ দৃষ্টির কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃ-জনগোষ্ঠীর অনেকে কিন্তু চা বাগানে কর্মরত আছেন।  প্রধানমন্ত্রী একসময়ে পঞ্চগড়ে গিয়ে যখন দেখলেন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে চমৎকার চা উৎপাদন হচ্ছে।  তখন তিনি কিন্তু তৎকালীন পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক রিবিউল ইসলামকে ডেকে এনে নির্দেশনা দিয়েছিলেন সেখানে যেন চায়ের উৎপাদন হয়। তখন থেকেই এখানে চা উৎপাদন শুরু হয়।  পঞ্চগড় এখন চায়ের একটি জেলা হয়ে গেছে।’

‘প্রধানমন্ত্রী তখন ওইখানে যারা ক্ষুদ্র কৃষক আছেন, তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন।  তাদের তিনি বিভিন্ন ধরনের ছোট ছোট গাছের চারা বিতরণ করেন, স্বল্পমূল্যে চারা দিয়েছিলেন।  এখানে একটি ফ্যাক্টরি ছিলো এখন সেখানে ৪/৫টি ফ্যাক্টরি হয়ে গেছে। সেখানে এই চায়ের গ্রীন লিফের মূল্য, ক্যারিং কস্ট তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। সব ধরনের ব্যাংক সুবিধা পেয়েছেন ফ্যাক্টরির মালিকরা।  এসব পদক্ষেপ নেওয়ার কারণেই কিন্তু চায়ের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে।”

তোফাজ্জেল হোসেন মিয়া বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী যে কাজটি ২০ বছর আগে শুরু করেছেন, সেটি এখন অনেক গ্রামের জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত করেছে। শুধু পঞ্চগড়েই আড়াইশ’র বেশি চা বাগান তৈরি হয়েছে।’

এ সময় তিনি জানান, আগে চা বাগানের ১০ টাকা-২০ টাকা মজুরি ছিলো। সেখান থেকে এটা বাড়তে বাড়তে একটা পর্যায়ে এসেছে। ভবিষ্যতে অন্য সেক্টরে যেভাবে মজুরি বৃদ্ধি পায়, এখানেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাজার মূল্যের সাথে সঙ্গতি রেখে নিশ্চয় আরও বৃদ্ধি পাবে।

আরও পড়ুন

উন্নয়নের ঢেউ পৌঁছেছে খাসিয়াদের জীবনেও

শেষ বয়সে শান্তির নীড়ে অশ্রুসজল শকুন্তলা

স্বামীহারা সঞ্চিতার কান্নার জল মুছে দিলেন প্রধানমন্ত্রী

নতুন ঘরে সুন্দর জীবনের গল্প বুনছেন তারা