ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

উন্নয়নের ঢেউ পৌঁছেছে খাসিয়াদের জীবনেও

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩৯, ৯ জুলাই ২০২১   আপডেট: ১৯:৪৩, ৯ জুলাই ২০২১

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘আশ্রয়ন প্রকল্পের’ মাধ্যমে গত ছয় মাসে জমির সঙ্গে স্থায়ী পাকা ঘরের মালিকানা পেয়েছেন এক লাখ ২৩ হাজার ২৪৪টি পরিবার। এছাড়া সমাজের পিছিয়ে পড়াদের নিয়ে রয়েছে সরকারের পৃথক প্রকল্প।  এসব প্রকল্পের আওতায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী পাচ্ছে ভালো থাকার নিশ্চয়তা। বদলে যাচ্ছে তাদের জীবনযাত্রার মানও। বাদ যাচ্ছে না সমতলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীও। তাদের জন্যও সরকারের রয়েছে নানা পদক্ষেপ, প্রকল্প।  রুপকল্প-২০৪১ কে সামনে রেখে পিছিয়ে পড়াদের এগিয়ে আনতে সরকারের নেওয়া এসব কর্মসূচির মাধ্যমে কীভাবে উপকারভোগী হচ্ছেন সুবিধাবঞ্চিত এই মানুষগুলো তা সরেজমিনে দেখেছেন রাইজিংবিডির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এসকে রেজা পারভেজ। ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে এসে পরিবর্তনের সেসব গল্পের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে চতুর্থ পর্ব।

চায়ের দেশ শ্রীমঙ্গলের মূল শহর থেকে ব্যক্তিগত গাড়িতে যেতে প্রায় ৪০ মিনিটের পথ।  ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের একাবারে লাগোয়া হোসনাবাদ ৬ নম্বর পানপুঞ্জি নামের এই এলাকায় থাকেন ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী খাসিয়া সম্প্রদায়। দেশের একেবারে শেষ প্রান্ত, দুর্গম এলাকা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল হলেও আধুনিক জীবনের ছোঁয়া লেগেছে এখানেও।

গত ১২ বছরে তাদের জীবনযাত্রায় এসেছে অভাবনীয় সব পরিবর্তন। বিদ্যুৎ এসেছে, রাস্তা হয়েছে, পাহাড়ি পথে হয়েছে সিড়ি, পড়ালেখা করে উচ্চ শিক্ষিত হচ্ছে এখানকার ছেলে-মেয়েরা, গ্রামের উৎপাদিত পান যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে এখানকার ব্যবসায়ীরা।

হোসনাবাদ ৬ নম্বর পানপুঞ্জি নামের এই এলাকার খাসিয়া সম্প্রদায়ের হেড ম্যান (মন্ত্রী) ওয়েলসুরাং। রাইজিংবিডিকে তিনি জানান, এখানে ৪০টি পরিবার থাকেন।  প্রায় সবাই পান শ্রমিক।  অর্থাৎ পান উৎপাদন এবং বিক্রিই তাদের প্রধান পেশা।  এর বাইরে অনেকে চা বাগানেও কাজ করেন। 

আরও পড়ুন: শেষ বয়সে শান্তির নীড়ে অশ্রুসজল শকুন্তলা

কয়েকবছর আগেও যোগাযোগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে জীবনযাত্রার মান নিয়ে দুর্ভোগের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিলো।  তাই অনেকটা দুর্গম রাস্তা দিয়ে অনেক ঘুরে চলাফেরা করতে হতো। সরকার এখন রাস্তা করে দিয়েছে।  ব্রিজ করে দিয়েছে।  আগে গাড়ি ছিলো না।  এখন গাড়ি চলে।  সহজেই তাদের উৎপাদিত পণ‌্য শহরে গিয়ে বিক্রি করতে পারেন। ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক অবস্থাও এখন বেশ ভালো তাদের। 

ওয়েল সুরাং জানান, বিদ্যুৎ না থাকায় অনেক কিছু থেকেই বঞ্চিত হতেন তারা।  সাত বছর আগে এখানে বিদ্যুৎ এসেছে।  বেকারত্ব ঘোচাতে আর্থিক সহযোগিতা দিচ্ছে সরকার।  শিক্ষাবৃত্তি টাকা দিচ্ছে।  প্রতিবন্ধীদের আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। নারীদের সেলাই মেশিন দিয়েছে।  এভাবেই বদলে গেছে এক সময়ে অবহেলিত খাসিয়াদের জীবন।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর একটি অনবদ্য উদ্যোগ হচ্ছে সমতলে যেসব ক্ষুদ্র নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী বসবাস করে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সেসব জনগোষ্ঠীর মানুষের জীবনযাপনের মান উন্নয়নের লক্ষ্যে এবং সেখানে যারা বসবাসরত আছেন, যাদের ঘরবাড়ি নেই তাদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর একটি বিশেষ উদ্যোগ আছে সেটি হচ্ছে ‘বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া)।  প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা হচ্ছে এই সমতলে বসবাসরত ক্ষু নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে কর্মসূচি গ্রহণ করা। তারই ভিত্তিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে একটি কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে।’

আরও পড়ুন: স্বামীহারা সঞ্চিতার কান্নার জল মুছে দিলেন প্রধানমন্ত্রী

জানা গেছে, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে ২০-২৫টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের বসবাস।  এর মধ্যে শ্রীমঙ্গলেই বাস খাসিয়া সম্প্রদায়ের সদস্য প্রায় ১১ হাজার।  শ্রীমঙ্গলের পানপুঞ্জি ৬ নম্বর ওয়ার্ড আশিদ্রোনে থাকে প্রায় ৪০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী খাসিয়া পরিবার।  তাদের আদিবাস ভারতের শিলং ও মেঘালয়ে।  প্রায় ৪০ বছর ধরে এখানে বসবাস করছেন বলে জানান ওয়েলসুরাং। 

একযুগ আগেও ক্ষুদ্র এই নৃ তাত্ত্বিক গোষ্ঠীর জীবনযাত্রা ছিলো দুঃখ আর কষ্টের।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ‘বিশেষ এলাকার জন্য উন্নয়ন সহায়তা (পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া)’ প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে নতুন জীবনের ছোঁয়া পাচ্ছেন প্রত্যন্ত এবং দুর্গম এলাকার এই বাসিন্দারাও।  সমাজের মূল ধারার সঙ্গেও তারা তাল মেলাচ্ছেন।  এখন তাদের ছেলে মেয়েরাও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছেন।  

ডিখার সুরাং মাস্টার্সে পড়ছেন।  তিনি বলেন, যাতায়াত ব্যবস্থা কতটা খারাপ ছিলো, সেটা বলে বোঝানো যাবে না। এটার খুব প্রয়োজন ছিলো। আর বিদ্যুৎ আসায় তো পুরো পরিস্থি্তিই পাল্টে গেছে। এখন সুপেয় পানি পাচ্ছি আমরা।  বিদ্যুৎ সুবিধা না থাকায় পান চাষেও অনেক সময় লোকসান গুনতে হতো।

একমাত্র বোন নিয়ে সংসার এমনভি পরমেন’র। পান চাষ করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী তিনি। পড়াশোনা করেছেন এইচএসসি পর্যন্ত। বাবা মারা যাওয়ার পর সংসারের হাল ধরার কারণে পড়াশোনাটা আর এগোতে পারেননি। 

আরও পড়ুন: নতুন ঘরে সুন্দর জীবনের গল্প বুনছেন তারা

তিনি বলেন, দুই একর জমির ওপর পান চাষ করে বছরে তিন-সাড়ে তিন লাখ টাকা আয় হয় তার।  খরচ পড়ে এক থেকে দেড় লাখ টাকা। তাতে তিন ভাই, এক বোন ও মাকে নিয়ে সংসার চলে যায় ভালোভাবে। প্রয়োজনে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প থেকে নিতে পারেন আর্থিক সহযোগিতা ঋণও।

খাসিয়া সম্প্রদায়ের প্রধান নেতা ওয়েলসুরাং’য়ের ছোট ভাই জন খাসিয়া। এসএসসি পাস করা জনও পান চাষ করে সফল ব্যবসায়ী। তিনি জানান, তাদের এই এলাকায় তারা ছোট আকারে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় করেছেন। নিজেরাই চালান। যাতে তাদের ভাষা-সংষ্কৃতি চর্চা করা যায়। এজন্য সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন তিনি।  

তাদের এলাকায় ছোট্ট ছেলে-মেয়েদের জন্য নিজস্ব ভাষায় বই পড়ার জন্য যে প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়েছেন সেখানে শিক্ষাকতা করেন অর্নিকা সুরাং। বিদ্যালয়ে ভেতরে গিয়ে দেখা যায় সেখানে, পাটিতে বসে নিজের ভাষায় ছড়া পড়ছেন ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা। 

অর্ণিকা জানান, ভারতের শিলং থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সমমান পড়াশোনা করেছেন তিনি। অনর্গল ইংরেজিতে কথা বলা অর্নিকা স্বপ্ন দেখেন এসব ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে উচ্চ শিক্ষিত হবে।  বাংলার পাশাপাশি বাঁচিয়ে রাখবে খাসিয়াদের নিজস্ব ভাষা-সংষ্কৃতিও। 

জীব সুরং লেখাপড়া করেছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত।  সরকারি অনুদানে একটি সেলাই মেশিন পেয়েছেন। সেলাই করে সংসার পরিচালনায় সহযোগিতা করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘এসব জনগোষ্ঠীর মেয়ে যারা স্কুলে পড়ে তাদের সাইকেল বিতরণ করা হয়েছে।  প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী এ বছর ২ হাজার ৬৭২ জনকে বাইসাকেল দেওয়া হয়েছে।  যাতে তারা নিয়মিত স্কুলে যায়। একই সঙ্গে স্কুল এবং কলেজে যারা অধ্যায়নরত আছে সেখানে তাদের শিক্ষা বৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এই শিক্ষাবৃত্তি টাকা তাদের মায়ের মোবাইল অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে।  এছাড়া প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে যারা পড়ে তাদের কিছু শিক্ষা উপকরণ লাগে যেমন ব্যাগ, খাতা, কলম পোশাক বা কোভিডকালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা উপকরণ আমরা দিয়েছি।’

‘এছাড়া তাদের পেশাভিক্তিক যে দক্ষতা বা সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রেরর আওতায় রেখে অনুদান বা ঋণ প্রদান করা হচ্ছে।  ক্ষু নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর সন্তান যারা উচ্চ শিক্ষা অর্জন করছেন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন, মেডিক‌্যাল বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ছেন, তাদের প্রত্যেককে এ বছর ২৫ হাজার টাকা করে ২ হাজার ৫০০ জনকে শিক্ষা বৃত্তি প্রদান করেছেন।  এই অর্থ সরাসারি তাদের অনলাইন অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে।’

খাসিয়াদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের অগ্রাধিকার ভিত্তিক সহযোগিতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানোর পাশাপাশি তারা কিছু দাবিও জানিয়েছেন। 

সম্প্রদায়ের প্রধান নেতা ওয়েলসুরাং বলেন, সরকার সবকিছু দিয়েছে।  বাড়ি করে দেবে বলেছে। সরকারি বিভিন্ন ভাতাও পান তারা। তবে দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়া চিকিৎসা নিতে সংকটে পড়েন। এজন্য একটি চিকিৎসাকেন্দ্র করার দাবি জানিয়েছেন তারা।  এছাড়া এলাকার খাস জমিতে তাদের ভূমি মালিকানা দেওয়ার দাবি করেছেন।

এ সম্পর্কে মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, ‘আমরা যদি সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা পাই, কোনো কারণে কারো যদি ভূমি মালিকানা পেতে সমস্যা হয়, আমরা সেখানে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে এটি সমাধান করতে পারবো।’

পারভেজ/সাইফ

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়