ঢাকা     বুধবার   ১৬ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ৩১ ১৪৩১

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে হার্ডলাইনে আওয়ামী লীগ

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:৩৫, ৪ এপ্রিল ২০২৪  
উপজেলা নির্বাচন নিয়ে হার্ডলাইনে আওয়ামী লীগ

গ্রাফিক্স: রাইজিংবিডি

আসন্ন উপজেলা নির্বাচন সব ধরনের প্রভাবমুক্ত রেখে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও ভোটার অংশগ্রহণমূলক করতে জিরো টলারেন্সে নীতিতে এগোচ্ছে সরকার। এমপি-মন্ত্রী এবং স্থানীয় পর্যায়ের নেতারা যেন কোনভাবেই এই নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করতে না পারেন, সেজন্য হার্ডলাইনে হাঁটছে দলটি। দলের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ‘কেউ কোনও ধরনের অবৈধ হস্তক্ষেপ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ মূলত আ.লীগের এই বক্তব্যে উঠে এসেছে, এবারের উপজেলা নির্বাচন ‘ভোটার অংশগ্রহণমূলক’ করতে দলটি কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনের প্রায় এক মাস বাকি থাকলেও সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে এরইমধ্যে বেজে গেছে নির্বাচনের ডামাডোল। এবার দেশের ৪৮১টি উপজেলা পরিষদে ভোট হবে চার ধাপে। প্রথম ধাপের ভোট ৮ মে। ইতোমধ্যে প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলা পরিষদে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া যাবে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত। প্রচার শুরু ২৩ এপ্রিল থেকে। এছাড়া, চলতি সপ্তাহে দ্বিতীয় ধাপের তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন।

আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের উপজেলা নির্বাচন এমনভাবে করতে চায় দলটি, যা দেশের নির্বাচনের ইতিহাস পাল্টে দেবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা নির্বাচনও অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করে উদাহরণ সৃষ্টি করতে মরিয়া আ.লীগ। এজন্য এবারের উপজেলা নির্বাচনে কোনও প্রার্থীকেই নৌকা প্রতীক দিচ্ছে না ক্ষমতাসীন দলটি। উৎসাহিত করা হচ্ছে, ব্যাপক প্রার্থী যেন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এতে নির্বাচন যথেষ্ট অংশগ্রহণমূলক হবে বলে প্রত্যাশা দলের নেতাদের। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে সব ধরনের সহযোগিতা করার বিষয়ে দলটির পক্ষ থেকে জিরো টলারেন্স রয়েছে। এমনকি, বিভিন্ন জায়গায় মন্ত্রী-এমপিদের ‘নিজের লোককে’ দলীয় প্রার্থী হিসেবে পরিচিতি করানো বা ‘মাই ম্যান’ কালচার ভেঙে দিতে দলের স্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা।   

নির্বাচনে কোনও প্রকার অবৈধ হস্তক্ষেপ এবং নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বিনষ্ট করার কর্মকাণ্ডে জড়িত না থাকার জন্য মন্ত্রীসহ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দলীয় এমপি ও নেতাকর্মীদের প্রতি সাংগঠনিক নির্দেশনা দিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

উপজেলা নির্বাচনে কোনও প্রকার হস্তক্ষেপ সহ্য করা হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জনগণের মতামতের সুস্পষ্ট প্রতিফলন ঘটবে এবং ভোটাররা নির্বিঘ্নে নিজেদের ভোট প্রদান করবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার কাজে নিয়োজিত প্রশাসনও শতভাগ নিরপেক্ষতা বজায় রাখবে। কেউ কোনও ধরনের অবৈধ হস্তক্ষেপ করলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, উপজেলা নির্বাচনকে একটি মাইলফলক নির্বাচন করতে চাইছে ক্ষমতাসীন আ.লীগ। সেজন্য যে কোনও উপায়ে লক্ষ্য অর্জনে কঠোর পদক্ষেপের অংশ হিসেবে দলের সাধারণ সম্পাদকের এই কঠোর বার্তা। ঈদের পর যখন নির্বাচন ঘনিয়ে আসবে, তখন উপজেলায় এমপি-মন্ত্রীদের হস্তক্ষেপ বাড়তে পারে বলে মনে করছেন দলের কেন্দ্র। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শুধু নির্দেশনা নয়, এর বাস্তবায়নও করবে কেন্দ্র। দলটি চাইছে, একটি অসাধারণ নির্বাচন আয়োজন যেখানে ভোটার উপস্থিতি, ব্যাপক প্রার্থী অংশগ্রহণ এবং একটি উৎসবের নির্বাচন হোক। যাতে বিশ্বকে দেখানো যায় যে, বিএনপির নির্বাচন বর্জন একটি অবাধ, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে কোনও প্রভাব রাখে না; যেমনটি প্রমাণ হয়েছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। এজন্য বড় চ্যালেঞ্জ এমপি-মন্ত্রীরা। এরই মধ্যে বিভিন্ন জায়গা থেকে অভিযোগ আসতে শুরু করেছে। প্রকাশ্য হচ্ছে তাদের হস্তক্ষেপ। কিছু জায়গায় অভ্যন্তরীণ সংঘাতও হয়েছে। পারস্পরিক কাঁদা ছোড়াছুড়িতে বিনষ্ট হচ্ছে ঐক্য। এসব বিষয় দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও টাঙ্গাইল-১ আসনের সংসদ সদস্য আব্দুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। উপজেলা নির্বাচনে আব্দুর রাজ্জাক তার খালাতো ভাইকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন বলে অভিযোগ তোলা হয়। সম্প্রতি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মহিববুর রহমান পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা পরিষদে চেয়ারম্যান পদে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোতালেব তালুকদারকে প্রার্থী ঘোষণা করেন। এমন ঘোষণায় প্রার্থী হতে আগ্রহী অন্য নেতারা ক্ষোভ জানিয়েছেন। গত ৯ মার্চ বিশেষ বর্ধিত সভায় বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ওবায়দুর রহমানকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। তখন অন্য নেতারা নির্বাচনের মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়ে ওই সভা ছেড়ে চলে যান। ওই সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন জামালপুর-৩ (মাদারগঞ্জ-মেলান্দহ) আসনের সংসদ সদস্য মির্জা আজম। এ ঘটনার পর সেখানে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। সম্প্রতি ইসলামপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের এক বিশেষ বর্ধিত সভায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আব্দুস ছালামকে চেয়ারম্যান পদে একক প্রার্থী ঘোষণা করেন জামালপুর-২ (ইসলামপুর) আসনের সংসদ সদস্য ও ধর্মমন্ত্রী ফরিদুল হক খান। একক প্রার্থী ঘোষণার পরও চেয়ারম্যান প্রার্থী হওয়ার জন্য মাঠে ছিলেন উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও গাইবান্ধা ইউপি চেয়ারম্যান মাকছুদুর রহমান। পরে ১৬ মার্চ ধর্মমন্ত্রী ইসলামপুর উপজেলা ডাকবাংলায় এক বৈঠকের মাধ্যমে তাকে বসিয়ে দেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।  

মন্ত্রী-এমপিদের প্রভাব নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘গত ৭ জানুয়ারি শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নিরপেক্ষভাবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই নির্বাচন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় একটি মাইলফলক। নির্বাচন বানচালের বহুমুখী ষড়যন্ত্র ছিল। সেই প্রতিবন্ধকতা ডিঙ্গিয়ে ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে এসেছিল এবং নির্বাচনে সুস্পষ্টভাবে জনমতের প্রতিফলন ঘটেছে। ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন দুই ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে এবং ধাপে ধাপে উপজেলা পরিষদসমূহের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এই নির্বাচনও সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে। এখানে মন্ত্রী-এমপিদের কোনও প্রকার হস্তক্ষেপ করার কোনও সুযোগ থাকবে না।’

তিনি আরও বলেন, এই নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করলেও দলীয় প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফরউল্লাহ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বিষয়টি কেন্দ্রের নখদর্পণে আছে। দলের সাধারণ সম্পাদক বিষয়টি দেখভাল করছেন। তিনি যেভাবে দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন, বিভাগভিত্তিক টিমগুলো সে অনুযায়ী কাজ করছে।’

এমপি-মন্ত্রীদের প্রভাব স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এমপি-মন্ত্রী তাদের পছন্দের লোক চাইতেই পারেন কিন্তু সবসময় তাদের সেই চাওয়া তো পূরণ হবে না। আমরা দেখব শুধু দলের স্বার্থ। দলের স্বার্থ রক্ষা করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অবশ্যই দলীয় সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে চলতে হবে। এক্ষেত্রে দলের নির্দেশ কেউ ভাঙবে বলে বিশ্বাস করি না।’

/এনএইচ/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়