ঢাকা     শনিবার   ০৪ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২১ ১৪৩১

কী ঘটছে মন্ত্রী-এমপিদের ভাগ্যে

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ২৩ এপ্রিল ২০২৪  
কী ঘটছে মন্ত্রী-এমপিদের ভাগ্যে

ছবি: গ্রাফিক্স

উপজেলা নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভরপুর ও অংশগ্রহণমূলক করতে দলীয় এমপি-মন্ত্রীদের তাদের আত্মীয়স্বজনকে নির্বাচনের মাঠ থেকে তুলে নিতে আওয়ামী লীগের নির্দেশনা আমলে নেয়নি বেশিরভাগ জনপ্রতিনিধি। দলের ‘সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া’ কিংবা ‘বহিষ্কারের’ মতো কঠোর পদক্ষেপের জোরালো হুমকিকে ‘বুড়ো আঙুল’ দেখিয়ে শুধু ভোটের মাঠেই থাকেননি, বরং অনেক জায়গায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় নিশ্চিত করেছেন কেউ কেউ। এতে প্রত্যক্ষভাবে বা প্রচ্ছন্নভাবে প্রভাব বিস্তার করেছেন মন্ত্রী-এমপিরাই। বিষয়টি নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ কেন্দ্র তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ভাবছে। চলতি মাসের শেষে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় ‘কঠিন পদক্ষেপ’ আসতে পারে বলে জানিয়েছেন দলের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো।

দলীয় সূত্রগুলো বলছে, গত ১৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার রাজনৈতিক কার্যালয়ে তার নির্দেশে দলের সাধারণ সম্পাদক যেসব জায়গায় মন্ত্রী-এমপিদের আত্মীয়স্বজন উপজেলা নির্বাচন করছেন, তাদের নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন। দায়িত্বশীল সাংগঠনিক সম্পাদকরা সংশ্লিষ্ট এমপি-মন্ত্রীদের দলীয় সিদ্ধান্তের কথা পর্যায়ক্রমে জানিয়ে দেন। বিষয়টি নিয়ে প্রার্থীদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভব তৈরি হলেও যে শঙ্কা রয়ে যায়, শেষ পর্যন্ত সেটিই বাস্তবে দেখা দিলো। অর্থাৎ, উপজেলা থেকে মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা ভোটের মাঠ ছাড়েননি। উপরন্তু ২৬ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হলেন। যেখানে দল প্রত্যাশা করছে একটি তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক উপজেলা নির্বাচন; সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার মানে হচ্ছে নির্বাচনকে ‘বিতর্কিত’ করা। এজন্য বিষয়টি নিয়ে ত্যক্ত-বিরক্ত কেন্দ্র।

পড়ুন: চতুর্থ ধাপে ৫৫ উপজেলা ও ঝিনাইদহ-১ উপনির্বাচন ৫ জুন

নির্বাচনের প্রথম ধাপের তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল সোমবার (২২ এপ্রিল)। এই ধাপে ১৯৮ জন প্রার্থী তাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৯৫, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৭৯ এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৪ জন প্রার্থী রয়েছেন। প্রত্যাহার শেষে চেয়ারম্যান পদে ৫৫৪, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৬০৪ এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ৪২৯ জন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী টিকে রইলেন। এতে এখন পর্যন্ত এই ধাপে তিন পদে চূড়ান্ত লড়াইয়ে টিকে রইলেন ১৫৮৮ জন। এই ধাপে প্রার্থীদের মধ্যে মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ হবে ৮ মে।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে ৭ জন চেয়ারম্যান, ৯ জন ভাইস চেয়ারম্যান এবং ১০ জন মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছেন। চূড়ান্ত তালিকা এলে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। যেসব উপজেলায় প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন সেগুলো হচ্ছে- বালিয়াডাঙ্গী (ঠাকুরগাঁও) উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, হাকিমপুর (দিনাজপুর) উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, সাঘাটা (গাইবান্ধা) উপজেলার চেয়ারম্যান, বেড়া (পাবনা) উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, সিংড়া (নাটোর) উপজেলার চেয়ারম্যান ও কুষ্টিয়া সদরের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া, বাগেরহাট সদরে তিনটি পদে, মুন্সীগঞ্জ সদরে তিনটি পদে ও শিবচর (মাদারীপুর) তিনটি পদে প্রার্থীরা বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।পাশাপাশি, বড়লেখা (মৌলভীবাজার) উপজেলার মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান, পরশুরাম (ফেনী) উপজেলায় তিনটি পদে, সন্দ্বীপ (চট্টগ্রাম) উপজেলায় ভাইস চেয়ারম্যান, কক্সবাজার সদরে ভাইস চেয়ারম্যান, রোয়াংছড়ি (বান্দরবান) উপজেলার চেয়ারম্যান পদ ও কাউখালী (রাঙ্গামাটি) উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান বিনা ভোটে নির্বাচিত হয়েছেন।

পড়ুন- উপজেলা নির্বাচন: প্রথম ধাপের ভোটে ২৬ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সিলেট বিভাগের ১১ উপজেলার মধ্যে একমাত্র মৌলভীবাজারের বড়লেখায় প্রার্থী হয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু বিষয়ক সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান এমপি শাহাব উদ্দিনের ভাগ্নে শুয়েব আহমদ। নরসিংদী জেলার পলাশের এমপি ডা. আনোয়ারুল আশরাফ খান দিলীপের সম্বন্ধী শরিফুল হকও চেয়ারম্যান পদে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। মাদারীপুর সদর উপজেলায় এমপি শাজাহান খানের ছেলে আসিবুর রহমান খান প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলায় এমপি সাহাদারা মান্নানের ভাই ও ছেলে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। সারিয়াকান্দিতে প্রার্থী হয়েছেন এমপির ছেলে উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য শাখাওয়াত হোসেন সজল। সোনাতলায় প্রার্থী হয়েছেন এমপির ভাই উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি বর্তমান চেয়ারম্যান মিনহাদুজ্জামান লিটন।

চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের এমপি আলী আজগার টগরের ভাই আলী মুনছুর বাবু দামুড়হুদায় প্রার্থী হয়েছেন। কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও সদর আসনের এমপি মাহবুব উল-আলম হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান আতাও মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। রাজশাহীর তানোরে চেয়ারম্যান প্রার্থী লুৎফর হায়দার রশীদ ময়না আওয়ামী লীগের স্থানীয় এমপি ফারুক চৌধুরীর চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। তিনি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেননি। পাবনার বেড়ায় ডেপুটি স্পিকার অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকুর ছোট ভাই বেড়া পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুল বাতেন ও ভাতিজা আবুল কালাম সবুজ প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেননি। সুবর্ণচরে এমপি একরামুল করিম চৌধুরীর ছেলে আতাহার ইশরাক সাবাব চৌধুরীও ভোট থেকে সরেননি।

পড়ুন: উপজেলা প্রতি ২-৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন

সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘দলীয় নির্দেশ অমান্য করা ঠিক হয়নি। বিষয়টি নিয়ে কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে আলোচনা হতে পারে।’

দলের আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘যারা দলের নির্দেশ মেনে নিকটাত্মীয়দের নির্বাচন থেকে সরিয়ে নিয়েছেন তাদের ধন্যবাদ। আর যারা নির্দেশ মানেননি, বিষয়টি দুঃখজনক।’   

দলীয় সূত্র বলছে, যেসব মন্ত্রী-এমপিদের নিকটাত্মীয় নির্বাচনের মাঠে আছেন তাদের বিষয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাচ্ছেন না দায়িত্বশীলরা। কারণ, এর মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটির দায়িত্বশীল নেতাও রয়েছেন। তবে এমপি-মন্ত্রীরা দলীয় নির্দেশ অমান্য করায় বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি কেন্দ্র। বিশেষ করে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিষয়টি নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা কেউ কেউ এটাকে দলের বিরুদ্ধে যাওয়ার অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করছেন। বুধবার দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাইল্যান্ড সফরে যাচ্ছেন। ২৯ এপ্রিল তিনি দেশে ফিরবেন। পরদিন দলের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা হবে। বিষয়টি নিয়ে সেখানেই আলোচনা এবং পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। এর আগে কোন কোন মন্ত্রী-এমপি দলীয় নির্দেশ অমান্য করেছেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নির্দেশে দপ্তর সেল একটি তালিকা প্রস্তুত করছে।

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘নিকটাত্মীয়দের নির্বাচন থেকে সরে যেতে আওয়ামী লীগ সভাপতির নির্দেশ দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের জানিয়েছিলেন। না সরলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলেছিলেন। কিন্তু সেটি অনেকে মানেননি। বিষয়টি নিয়ে ৩০ এপ্রিল কার্যনির্বাহী কমিটির মিটিং হবে। সেখানে সিদ্ধান্ত হবে।’

/এনএইচ/

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ