ঢাকা     শুক্রবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ডিপিডিসির দুর্নীতি

সফেদ চেহারার আড়ালে ‘ভয়ানক অসুন্দর’ হাদী

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৫২, ২৯ জুন ২০২৪   আপডেট: ২২:২৪, ২৯ জুন ২০২৪
সফেদ চেহারার আড়ালে ‘ভয়ানক অসুন্দর’ হাদী

ছবি: গ্রাফিক্স

সফেদ চেহারা, কাজে-কর্মে প্রথম দর্শনেই মনে হবে প্রজাতন্ত্রের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। অথচ, এই সুরতের আড়ালে দুর্নীতিতে তিনি যে এক ‘ভয়ানক অসুন্দর’ জাল ছড়িয়েছেন, সেটা ঘুণাক্ষরেও টের পাওয়া মুশকিল। বলছি, ঢাকা পাওয়ার ড্রিস্টিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) লিমিটেডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাজিবুল হাদীর কথা। এক সময় বিএনপির রাজনীতি করা হাদী রাজনৈতিক পরিচয়ের সাইনবোর্ড পাল্টে নিজেকে প্রভাবশালী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে নিয়ে গেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। কর্মজীবনে মাত্র ১৬ বছরের ব্যবধানে কীভাবে বিপুল অর্থ-বিত্ত আর বৈভবের মালিক হওয়া যায়—হাদীর এই কাণ্ড গবেষণারও দাবি রাখে! অপ্রতিরোধ্য সিন্ডিকেট গড়ে নিজেকে ডিপিডিসির ‘ত্রাসে’ পরিণত করলেও শেষ রক্ষা হচ্ছে না হাদীর। তার কর্মকাণ্ডের দস্তাবেজ পৌঁছে গেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) পর্যন্ত। যার তদন্তে বেরিয়ে আসতে পারে দুর্নীতির আরেক উপাখ্যান।

ডিপিডিসি ও দুদক সূত্রে জানা গেছে, রাজিবুল হাদী বর্তমানে ‘ডিপিডিসি এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছেন। হাদী যেখানেই যান, গড়ে তোলেন সিন্ডিকেট। এখানেও ব্যতিক্রম হয়নি। দেশের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করে অর্থের লোভে চীনাদের হয়ে কাজ করেন। যোগ্য ঠিকাদারের পরিবর্তে অযোগ্যদের সঙ্গে মিলে কাজ করেন। এজন্য কমিশন হিসেবে নেন বিপুল টাকা।

জিটুজি’র (সরকারের সঙ্গে সরকারের) মতো স্পর্শকাতর এবং ড্রিম প্রকল্পে দুর্নীতিবাজদের পদায়ন করা নিয়ে এখন জোরালো প্রশ্ন উঠছে প্রকৌশল সমাজে। তারা প্রকল্পের কাজের গুণগত মান, দেশের টাকা সাশ্রয়ের বিষয়েও প্রশ্ন তুলছেন। প্রকৌশলীরা বলছেন, ডিপিডিসিতে যোগ্য প্রকৌশলীদের জিটুজি প্রকল্পে পদায়ন না করাতে ভবিষ্যতে এই প্রকল্পের কাজের গুণগত মান টেকসই হবে না। এই প্রকল্পে গুটিকয়েক দুর্নীতিপরায়ণ প্রকৌশলীর কারণে কাজের ব্যয় আরও অনেক বেড়ে যাবে। ব্যয় বেড়ে গেলে তা রাষ্ট্রের জনগণের অতিরিক্ত করের বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডিপিডিসিতে গত ১৬ বছর ধরে কর্মরত আছেন হাদী। যশোরের নাজির সংকরপুর তার গ্রামের বাড়ি। ২০০৭ সালে তিনি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ডিজাইন পরিদপ্তরে সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করেন। ২০০৮ সালের ৯ জুলাই ডিস্ট্রিবিউশন প্লানিংয়ে (দক্ষিণ শাখা) সহকারী ম্যানেজার (নির্বাহী প্রকৌশলী) হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে ডিপিডিসিতে কাজ শুরু করেন। এরপর থেকেই বদলে যেতে থাকে তার ভাগ্য। ২০১৪ সালে সাব ডিভিশনাল ইঞ্জিনিয়ার (কোম্পানি সেক্রেটারিয়েট) হিসেবে কাজ শুরু করেন হাদী। রাজিবুল হাদী ডিপিডিসির খিলগাঁও ডিভিশনে নির্বাহী প্রকৌশলী হিসেবে ১৭ এপিল ২০১৮ থেকে ৪ জুলাই ২০১৯ পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। পরে তাকে ৪ জুলাই ২০১৯ তারিখে জিটুজি প্রকল্পে বদলি করা হয়।

খিলগাঁও ডিভিশনের একটি সূত্রে জানা যায়, তৎকালীন সময় তিনি গ্রাহকদের সঙ্গে অসদাচরণ, হয়রানি এবং নতুন বিদ্যুৎ সংযোগে গ্রাহকরা ঘুষ না দিলে সংযোগ না দিতে বিভিন্ন রকম টালবাহানা করতেন। পরবর্তীতে হাতে টাকা পেলে সে গ্রাহকের সংযোগ দিতেন। এমনকি, বিদ্যুৎ বিলের কিস্তি করাতে গেলেও তিনি সেখান থেকে উৎকোচ দাবি করতেন। 

খিলগাঁও ডিভিশনের তৎকালীন কর্মচারী এক সিবিএ নেতা হাদীর এসব বিষয়ে বলতে গিয়ে জানান, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর রেফারেন্সে এক বিদ্যুৎ গ্রাহক উচ্চচাপ বিদ্যুৎ সংযোগের জন্য আবেদন করলে ওই গ্রাহকের কাছ থেকেও সে পরবর্তীতে এক লাখ টাকা ঘুষ নেয়। এরপর তাকে সংযোগ প্রদান করে। এই নির্বাহী প্রকৌশলীর অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার কারণে তৎকালীন সময়ে কয়েকজন বিদ্যুৎ গ্রাহক তার বিরুদ্ধে বেশকিছু অনিয়মের অভিযোগ তুলে ডিপিডিসির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী বিকাশ দেওয়ানের কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। পরবর্তীতে প্রধান কার্যালয়ের কর্তাব্যক্তিরা বিশেষ কারণে তাকে অনিয়মের দায়ে বরখাস্ত না করে খিলগাঁও ডিভিশন থেকে প্রাইজ পোস্টিং দিয়ে জিটুজি প্রকল্পে বদলি করেন।

দুর্নীতির-অনিয়মের কারণে বদলি বা স্থানান্তর হওয়া হাদীর নতুন কিছু নয়। সংশ্লিষ্ট একটি দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, ২০০৮ সালে দক্ষিণ শাখা ডিস্ট্রিবিউশন প্লানিংয়ের সহকারী ম্যানেজার (নির্বাহী প্রকৌশলী) হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ঘুষ-দুর্নীতি, হুমকি ও অসদাচরণের জন্য রাজীবুল হাদীকে ওএসডি করে টঙ্গী স্টোরে সংযুক্ত রাখে ডিপিডিসি। রাজীবুল হাদীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ, তিনি জিটুজি প্রকল্পের সব গোপন নথি অর্থের বিনিময় চাইনিজ ও দেশীয় ঠিকাদারদের কাছে পাচার করে দেন। এ কারণে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রকল্প পরিচালক কয়েক দফায় তাকে মৌখিকভাবে সতর্কও করেন।

ছাত্রদলের ক্যাডার হাদী এখন বর্ণচোরা

হাদী সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এক সময়ে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বর্ণচোরা হন তিনি। এক-এগারোর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতেই তিনি অতীতের পরিচয় পাল্টে ফেলেন। এজন্য যশোরে সরকার দলীয় এক এমপির ভাগ্নে পরিচয় দিয়ে রাম-রাজত্ব কায়েম শুরু করেন ডিপিডিসিতে। সরকার দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবের ফাঁকা আওয়াজ দেখিয়ে রাজীবুল হাদী ডিপিডিসির কর্মকর্তাকে জিম্মি করে রাখেন। তিনি তার অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনেকের চাকরি খাওয়ার হুমকিও দিয়েছেন।

হাদীর পছন্দের ঠিকাদার ছাড়া কাজ পান না অন্যরা

ডিপিডিসির একটি সূত্র বলছে, রাজীবুল হাদীর অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্তে দুদকে তার বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ জমা পড়েছে। তার বিষয়টি এখন তদন্তের অপেক্ষায়। দুদকে জমা পড়া এমন একটি ডকুমেন্ট রয়েছে রাইজিংবিডির হাতে।

সূত্র বলছে, চীনের বেসরকারি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান তেবিয়ান ইলেকট্রিক অ্যাপারেটাস কোম্পানি লিমিটেডের (টিবিইএ) সঙ্গে মিলে তাদের পছন্দের অযোগ্য ঠিকাদারকে কাজ দেন। অথচ সাধারণ ও অভিজ্ঞ ঠিকাদাররা বছরের পর পর বছর ঘুরেও কাজ পায় না। রাজীবুল হাদী তার সহযোগীদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এই সিন্ডিকেট মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে প্রকল্পের বেশিরভাগ কাজ তাদের পছন্দ ও অযোগ্য ঠিকাদারদের দিচ্ছে। তার সিন্ডিকেটই ৫/৬টি কোম্পানি করে দরপত্র ফেলছে। অথচ তারা সবাই একই সিন্ডিকেট। 

নামে-বেনামে বিপুল সম্পদ হাদী ও তার স্ত্রীর

হাদীর অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনেও। সেখান থেকে জানা যায়, রাজিবুল হাদীর নামে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় একাধিক প্লট, রুপায়নে ফ্ল্যাট ও যমুনা ফিউচার পার্কে একাধিক দোকান রয়েছে। ঢাকা শহরে বিভিন্ন জায়গায় নামে-বেনামে রয়েছে ফ্ল্যাট রয়েছে। তিনি ডিপিডিসির কর্মকর্তা হয়েও টিবিইএ’র প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। তার ২টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে— এমা কনস্ট্রাকশন ও বেসিক। এই কোম্পানি অন্য নামে নামে থাকলেও মূল মালিক হচ্ছেন রাজীবুল হাদী। যশোরে ও ঢাকায় তার স্ত্রীর নামেও বিপুল পরিমাণ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে।

কত টাকা পাচার করেছেন হাদী?

রাজীবুল হাদী বিপুল পরিমাণ অর্থ আমেরিকা ও দুবাইতে পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মতিঝিলের এক হুন্ডি ব্যবসায়ীর মাধ্যমে তিনি এসব অর্থ পাচার করেন। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মাধ্যমে তদন্ত করলে বিস্তারিত তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে মনে করে ডিপিডিসির একটি সূত্র।

সূত্র বলছে, হাদী চাইনিজ বেসরকারি কোম্পানিগুলোকে বিভিন্ন কাজের নকশা, ড্রইং ডিজাইন করে দেন। ডিজাইনে নয়-ছয় করে প্রকল্পের শত শত কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করেন। তিনি সম্প্রতি সিনম নামে একটি চাইনিজ কোম্পানিকে দুই শত কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ পেতে সহায়তা করেন। যার বিনিময়ে তিনি সেখান থেকে ৫ ভাগ কমিশন নেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে রাজীবুল হাদীর সঙ্গে গত তিন দিন এই প্রতিবেদক চেষ্টা করেছেন। তার মুঠোফোনে কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি। এমনকি, ক্ষুদেবার্তা পাঠালেও কোনও উত্তর আসেনি। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ‘খোঁজখবর নিয়ে তদন্ত করার কথা’ জানান বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং ডিপিডিসি’র পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মো. হাবিবুর রহমান। তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখাতে চাই আমরা। বিষয়টি নোট রাখছি।’

বিদ্যুৎ বিভাগের উপসচিব এবং ডিপিডিসি’র পরিচালনা পর্ষদের সদস্য এরাদুল হক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘দুর্নীতি হলে অবশ্যই এই বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হবে।’

হাদীর দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে ডিপিডিসি’র নির্বাহী পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) মোরশেদুল আলম খান মুঠোফোনে রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমি এখানে নতুন এসেছি। খোঁজখবর নিচ্ছি। দুর্নীতি হলে অবশ্যই অ্যাকশনে যাব। দায়িত্বশীল যারা আছেন, অবশ্যই এই বিষয়ে দেখবেন। সে যেই কেউ হোক না কেন, যত প্রভাবশালী হোক না কেন ছাড় পাবে না।’

/এনএইচ/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়