ঢাকা     শুক্রবার   ১১ অক্টোবর ২০২৪ ||  আশ্বিন ২৬ ১৪৩১

ফেলে দেওয়া পশুর হাড়-শিংয়ে কোটি টাকার বাণিজ্য

আসাদ আল মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২২:২৩, ২৪ জুন ২০২৪   আপডেট: ২২:২৩, ২৪ জুন ২০২৪
ফেলে দেওয়া পশুর হাড়-শিংয়ে কোটি টাকার বাণিজ্য

ছবি: গ্রাফিক্স

এক সময় ময়লা হিসেবে ফেলে দেওয়া হতো কোরবানির পশুর হাড়, শিং, অণ্ডকোষ, নাড়ি-ভুঁড়ি, মূত্রথলি, পাকস্থলী, চর্বি ও দাঁত। তবে কালের বিবর্তনে এগুলো থেকেই হচ্ছে কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য। বর্তমানে কোরবানির পশুর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রক্রিয়াজাতের পর বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হচ্ছে। জানা গেছে, পশুর হাড়, শিং, অণ্ডকোষ, নাড়ি-ভুঁড়ি, মূত্রথলি, পাকস্থলী, চর্বি, দাঁত থেকে ক্যাপসুলের কাভার, সুতা, সাবান, সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল, ওষুধসহ বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল, বুতাম, চিরুনি এবং কিছু দেশে ‘প্রিয় খাবার’ তৈরি করা হয়। তবে, দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এর গুরুত্ব না থাকায় যত্ন সহকারে এগুলো সংরক্ষণ করা হয় না।

রাজধানীর গাবতলী, মিরপুর, মোহাম্মদপুর, কলাবাগান, ধানমণ্ডি, ফার্মগেট, উত্তরা, বনানী ও যাত্রাবাড়ীসহ বিভিন্ন এলাকায় পথশিশুদের এসব সংগ্রহ করে বিক্রি করতে দেখা গেছে। রাজধানীর ওয়েস্ট কালেকশন সার্ভিসি প্রোভাইডারের (পিসিএসপি) সদস্যরা ডাস্টবিনের পাশে দাঁড়িয়েছিল এসব সংগ্রহ করতে দেখা গেছে।

পশুর হাড়, শিং, অণ্ডকোষ, নাড়ি-ভুঁড়ি, মূত্রথলি, পাকস্থলী, চর্বি, দাঁত রাজধানীসহ সারা দেশের কসাই, হকার, পথশিশুরা সংগ্রহ করে ভাঙারির দোকানে কিংবা মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। কোরবানির পর থেকে পশুর এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহে ব্যস্ত ছিল অনেকেই।  

ঢাকা দক্ষিণ সিটির ওয়েস্ট কালেকশন সার্ভিসি প্রোভাইডারের (পিসিএসপি) শ্যামল কান্তিকে সিক্কাটুলী ডাস্টবিনের কাছ থেকে গরুর মাথার হাড়, শিং ও নাড়ি সংগ্রহ করতে দেখা গেছে। তিনি রাইজিংবিডিকে জানান, পাকস্থলীকে তারা সাতপর্দা, ষাঁড়ের অণ্ডকোষসহ যৌনাঙ্গকে পইক্যা, রগ বা গোল্লা বলে। প্রতি বছরের মতো এবারও হাড় সংগ্রহ করছেন। আবার কেউ বিক্রি করলে তাও ক্রয় করছেন। 

নয়া বাজারের মাংস ব্যবসায়ী জসিম উদ্দীন বলেন, কোরবানির সময় বিভিন্ন এলাকায় মানুষ দিয়ে দিয়ে হাড় ও পশুর অণ্ডকোষ, পাকস্থলী ও নাড়িভুঁড়ি কিনে ফ্রিজে সংরক্ষণ করেছি। পাশাপাশি টোকাই ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকেও কিনেছি। এ সপ্তাহের মধ্যে এগুলো বিক্রি করবো। মাথার হাড় ৭ থেকে ১০ টাকা কেজি, সাধারণ হাড় ৮ থেকে ১১ টাকা। এ ছাড়া প্রতিটি অণ্ডকোষ ২৫ থেকে ৪০ টাকায় কেনা হয়েছে। আমি ঘুরে ঘুরে দেখছি, তারা কিনছেন। এগুলো হাজারীবাগ বা কামরাঙ্গীরচর এলাকায় গিয়ে বিক্রি করব। রান্না করা মাংসের হাড়ও কেনা হয়। এই হাড়ের আরও বেশি দাম পাওয়া যায়।

রাজধানীর হাজারীবাগের গজমহল রোড ও কালুনগর রোড এলাকায় ৭০ থেকে ৮০টি হাড় কেনার দোকান রয়েছে। এ ছাড়া, কামরাঙ্গীরচরে বেশ কিছু দোকান রয়েছে। কোরবানি উপলক্ষে এসব হাড়ের আড়তে শিশুসহ নারী-পুরুষরা হাড় বিক্রি করছে। শনিবার (২২ জুন) ট্রাকে ও পিকআপ ভ্যানে করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে হাড়, শিং ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আসতে দেখা গেছে।

হাজারীবাগের মেসার্স আকরাম অ্যান্ড ব্রাদার্স আড়তের মালিক মনির হোসেন বলেন, হাড় কেনার পর ধুয়ে রোদে শুকানো হবে। তারপর ট্রাকে করে পাঠাবো। দেশে ১৮০টি ওষুধ কোম্পানি ও হারবাল কোম্পানির ব্যবহারের জন্য প্রতিমাসে ৪০ থেকে ৪৫ কোটি ক্যাপসুল সেলের চাহিদা রয়েছে। ক্যাপসুল কোম্পানি গুঁড়া করা হাড় থেকে ক্যাপসুলের সেল তৈরি করে। এসব কাজে প্রতি মাসেই প্রয়োজন হয় কয়েক শ’ টন পশুর হাড়। দুটি ওষুধ কোম্পানির সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা প্রতিবছর আমার কাছ থেকে হাড় নিয়ে যায়। সংগৃহীত হাড় গাড়িতে করে কারখানায় পাঠাব। প্রতি কেজি হাড় ১২ থেকে ২০ টাকায় কিনেছি। প্রক্রিয়াজাত ও পাঠানো পর্যন্ত প্রতি কেজিতে আমার ১৮ টাকা খরচ হবে। তারা প্রতি কেজি ২২ থেকে ২৫ টাকায় কিনে নেবে।

তিনি আরও বলেন, পশুর নাড়ি দিয়ে অপারেশনের সুতা, রক্ত দিয়ে পাখির খাদ্য, চর্বি দিয়ে সাবান, পায়ের খুরা দিয়ে অডিও-ভিডিও’র ক্লিপ হয়। এ ছাড়া, অণ্ডকোষ দিয়ে জাপান, কোরিয়া, চীন, জার্মানির সবচেয়ে জনপ্রিয় খাদ্য সুসেড রুলসহ বিভিন্ন ধরনের খাবার তৈরি হয়। হাড় সিরামিক শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ ছাড়া জার্মানি ও ইতালিতে পশুর শিংয়ের ব্যাপক চাহিদা। শিং দিয়ে বুতাম, চিরুনি বানানো হয়।
 
কামরাঙ্গীরচরের ব্যবসায়ী হাজি চান মিয়া বলেন, হাড় সাধারণত মাছের খাবার, সার, চিরুনি ও পোশাকের বোতাম তৈরির কাজে ব্যবহৃত হয়। সাতপর্দার (পাকস্থলী) অনেক দাম। কিন্তু আমরা পাই না। বিদেশে এগুলো অনেক দাম দিয়ে কেনা হয়। পশুর রগ, অণ্ডকোষ জাপান, চীন ও কোরিয়া, মায়ানমার ও হংকংয়ে রপ্তানি করা হয়। এটা দিয়ে একটি পাউডার বানায় তারা। গরু ও মহিষের অণ্ডকোষ ২৩ থেকে ৩০ হাজার টাকা টনে বিক্রি হয়। ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, যশোর, বরিশাল, রাজশাহীসহ বড় শহরগুলো থেকে কেনার পর এখানে পাঠানো হয়। রপ্তানিকারকরা আমাদের কাছ থেকে (আড়তদার) থেকে নিয়ে যায়।

তিনি আরও বলেন, গরু, মহিষ ও ছাগলের শিং ভারতে রপ্তানি হয়। শিং দিয়ে চিরুনি, বোতাম, এক্স-রে ফিল্ম, ক্যামেরার ফিল্ম, ঘর সাজানোর দ্রব্যসহ বিভিন্ন কারুপণ্য তৈরি করা হয়। সাবান তৈরিতে ব্যবহার হয় চর্বি। রক্ত শুকিয়ে মুরগি ও পাখির খাবার তৈরি করা হয়। মাথার হাড় মেলামাইন তৈরিসহ অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা হয়।
 
জানা গেছে, সারা দেশে হাড় গুঁড়ো করার ৩০-৩৫টি কারখানা রয়েছে। রাজধানীর হাজারীবাগ, কামরাঙ্গীরচর ছাড়া যাত্রাবাড়ী, কেরানীগঞ্জ, চিটাগাং রোডে হাড় ভাঙার কারখানা রয়েছে। চট্টগ্রামের কালুরঘাট শিল্প এলাকায় গড়ে উঠেছে কয়েকটি হাড় ভাঙার কারখানা। খুলনা মহানগরীর লবণচরা এলাকায় রূপসা নদীর তীরঘেঁষে গড়ে উঠেছে আরও কয়েকটি কারখানা। এ ছাড়া সৈয়দপুর, বরিশাল, যশোরসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরেও এসব কারখানা গড়ে উঠেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পশুর হাড়কে গুঁড়া করে তৈরি হয় ‘নিটবন’ নামের এগ্রো খাবার। এটি লেয়ার-ব্রয়লার মুরগির খাবারে প্রতি কেজিতে ১৮-২০ শতাংশ মেশানো হয়। প্রতি বছর এই নিটবন এবং  হাড়ের গুঁড়া আমদানিতে আনুমানিক ২৫০ কোটি ডলার খরচ হয়। তাছাড়া পশুর হাড় দিয়ে ক্যাপসুলের নমনীয় মোড়ক ও ক্যামেরার ফিল্ম, চিরুনি, পুঁতি, বিশেষ এক ধরনের লাঠি, মূল্যবান মেলামাইন সামগ্রী, অপারেশন পণ্য তৈরি করা হয়। পশুর শিং দিয়ে উন্নত মানের বোতাম তৈরি করা হয়। পশুর খুরা দিয়ে পশুপাখির জন্য তৈরি হচ্ছে ক্যালসিয়াম জাতীয় খাবার। লেজের চুল দিয়ে সুতা, ব্রাশ তৈরি করা হয়। রক্ত দিয়ে মুরগির খাবার, হাড় থেকে শুরু করে শিং, নাড়ি-ভুঁড়ি, মূত্রথলি, রক্ত, চর্বি, পিত্ত বা চামড়ার অব্যহৃত অংশসহ সবই রপ্তানি করা যায়।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর পবিত্র ঈদুল আজহায় সারা দেশে মোট ১ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৯১৮টি গবাদিপশু কোরবানি হয়েছে। গত বছর কোরবানিকৃত গবাদিপশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২ টি। ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৯৯ লাখ ৫০ হাজার ৭৬৩টি। গত বছরের তুলনায় এবার ৩ লাখ ৬৭ হাজার ১০৬টি গবাদিপশু বেশি কোরবানি হয়েছে। কোরবানি হওয়া গবাদিপশুর মধ্যে ৪৭ লাখ ৬৬ হাজার ৮৫৯টি গরু, ১ লাখ ১২ হাজার ৯১৮ টি মহিষ, ৫০ লাখ ৫৬ হাজার ৭১৯টি ছাগল, ৪ লাখ ৭১ হাজার ১৪৯টি ভেড়া এবং ১ হাজার ২৭৩টি অন্যান্য পশু। ৪৭ লাখ ৬৬ হাজার ৮৫৯টি গরু, ১ লাখ ১২ হাজার ৯১৮টি মহিষপ্রতি গড়ে ১৫ কেজি করে হাড় হলে, ৫০ লাখ গরু থেকে ৭ কোটি ২০ লাখ কেজি হাড় হওয়ার কথা। ৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলে এসব হাড়ের দাম হয় ৫৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা। যদিও সব গরু-মহিষর হাড়ই যে বিক্রি করা হচ্ছে, তা নয়।

গরু–মহিষের হাড়, শিং দিয়ে বোতাম তৈরি করছে নীলফামারীর সৈয়দপুরের অ্যাগ্রো রিসোর্স কোম্পানি লিমিটেড। তারা জার্মানি, স্পেন, চীনে বছরে ১৮ কোটি থেকে ২০ কোটি টাকার হাড় ও শিংয়ের বোতাম রপ্তানি করে। এসব বোতাম শার্ট, কোট, প্যান্ট, সাফারিসহ বিভিন্ন পোশাকে ব্যবহার করা হয়। ছোট পরিসরে শুরু করা কোম্পানিটির এখন তিনটি কারখানা। মোট ৩২ কোটি টাকার বিনিয়োগ থেকে তারা বছরে বোতাম রপ্তানি করে ২০ কোটি টাকার।

ঢাকা মেট্রোপলিটন মাংস ব্যবসায়ী সমিতির মহাসচিব রবিউল আলম বলেন, পশুর হাড়, শিং, চামড়া, ভুঁড়ি, অণ্ডকোষ, মূত্রথলি, চর্বি, রক্ত সবই রপ্তানিযোগ্য। অধিকাংশই রপ্তানি হয় চীন, মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডে। হাড় ও শিং ফেলে না দিয়ে সেগুলো আড়তে বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, বিদেশে পশুর ফেলনা এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রচুর চাহিদা। কিন্তু সে সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এসব অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বাজার সম্পর্কে পেশাদার কসাইরা অবগত আছেন। তারা এগুলো সংরক্ষণ করে বিক্রি করে। কিন্তু গ্রাম-গঞ্জের লোকজন বা নগরবাসীর অনেকেই এসব নিয়ে তেমন ওয়াকিবহাল নয়। একমাত্র সচেতনতা এবং কার্যকর উদ্যোগের অভাবে দেশের হাড়গুলো পচে নষ্ট হয়ে যায়। শুধু কোরবানির পশুর হাড়, শিং, খুরা, দাঁত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রপ্তানি করে শত কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।


 
জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর ড. এসএম নজরুল ইসলাম বলেন, কোরবানির পশুর রক্ত নিয়ে অনেকেই ঝামেলায় থাকেন। রক্ত শুকিয়ে বিক্রি কর‍া যেতে পারে। পোলট্রি ফিডসহ মাছের খাবার এবং এমন নানা কাজে ব্যবহার করা যায় রক্ত। এতে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি পরিবেশও দূষিত রোধ হবে। দেশে যে শতভাগ হালাল সাবান উৎপাদন করা হয়, তার উৎস আমাদের গরু ও খাসির চর্বি। এজন্য চর্বিকেও গুরুত্ব দিতেই হবে। পশুর শিং ও হাড় ফেলে দেওয়া উচিৎ নয়। প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করলে লাভবান হবেন।  
 
স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ’র পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ডিন ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক  ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, পশুর নাড়িভুঁড়ি, পাকস্থলীর বর্জ্য মাছের উপাদেয় খাদ্য। রক্তে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন। রক্ত থেকে পুষ্টিকর পশুখাদ্য তৈরি সম্ভব। অপরদিকে, হাড়ের গুঁড়া হাঁস-মুরগির উৎকৃষ্ট খাদ্য এবং এটি সার হিসেবেও জমিতে ব্যবহার করা যায়। হাড়, শিং থেকে বোতাম, তৈজসপত্র, ওষুধ, গৃহসজ্জার সামগ্রী ইত্যাদি প্রস্তুত করা যায়। আকারভেদে একটি গরুতে ১৫ থেকে ২৫ কেজি হাড় উচ্ছিষ্ট হয়। পশুর এসব বর্জ্যকে কাজে লাগাতে হবে।  

/এনএইচ/


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়