ঢাকা     রোববার   ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

কাউয়ামারা বাঁধে ভাঙন: টাঙ্গাইল ও জামালপুরের ৪০ গ্রাম প্লাবিত

শাহরিয়ার সিফাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৮, ১৭ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কাউয়ামারা বাঁধে ভাঙন: টাঙ্গাইল ও জামালপুরের ৪০ গ্রাম প্লাবিত

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি : যমুনার তীব্র স্রোতে জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার তারাকান্দি-গোপালপুর-ভূঞাপুর সড়কের কাউয়ামারা বাঁধটি ভেঙে গেছে।

১৯৮৮ সালের বন্যায় ভাঙনের স্থানেই আবারো ভাঙন দেখা দেওয়ায় আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন ওই এলাকার মানুষ। বৃহস্পতিবার টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার যোগারচরে যমুনা নদীর পানি বিপৎসীমার ১১৬ সেন্টিমিটার ও ভূঞাপুরের নলীন পয়েন্টে ১৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বুধবার দিবাগত রাত ১টার দিকে সরিষাবাড়ী উপজেলার আওনা ইউনিয়নের স্থল এলাকার নিকটবর্তী বাঁধের ১৫ থেকে ২০ মিটার অংশ ভেঙে যাওয়ায় বাঁধের পূর্ব পাশের ২৫টি গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। সম্ভাবনা রয়েছে আরো শতাধিক গ্রাম তলিয়ে যাওয়ার। বাঁধটি টাঙ্গাইলের গোপালপুর-ভূঞাপুরের সঙ্গে সংযোগ থাকায় এই দুটি উপজেলার আরো ১৫টিরও বেশি গ্রাম নতুন করে প্লাবিত হয়েছে।

গত তিনদিন ধরে জামালপুর ও টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ড, সড়ক ও জনপথ বিভাগসহ স্থানীয় মানুষজন সড়কটির ঝুঁকিপূর্ণ পয়েন্টগুলোতে বালির বস্তা ও জিও ব্যাগ ফেলে বাঁধ রক্ষা করার কাজ করছিলেন।

বাঁধটি ভেঙে যাওয়ার ফলে জামালপুর ও টাঙ্গাইল জেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বাঁধটি রক্ষা করতে সেনাবাহিনীর সদস্যরা এসে বালির বস্তা ও জিও ব্যাগ ফেলে প্রতিরোধমূলক কাজ শুরু করেছেন।

বুধবার দুপুর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব-জামালপুর রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। যমুনার পানি ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ায় বঙ্গবন্ধু সেতুপূর্ব-জামালপুর রেললাইনের সরিষাবাড়ি উপজেলার কালিবাড়ি রেললাইনের ওপর পানি ওঠে গিয়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়াও বৃহস্পতিবার তারাকান্দির কাউয়ামারা এলাকা ভেঙে রেললাইনে পানি প্রবেশ করেছে।  তারাকান্দি-টাঙ্গাইলের সঙ্গে সকল ধরনের যানবাহন চলাচল বৃহস্পতিবার থেকে বন্ধ রয়েছে।



তারাকান্দি-টাঙ্গাইল সড়কের কাউয়ামারা এলাকার রাস্তা যমুনার পানিতে ভেঙে সড়ক ও ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দক্ষিণ ও পশ্চিমাঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া তারাকান্দি সার কারখানা থেকে দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণাঞ্চলে সার সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।

এদিকে গত কয়েকদিনের প্রবল বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় টাঙ্গাইলে বন্যা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। এতে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। নিমজ্জিত হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল। বন্ধ হয়ে গেছে অর্ধশত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ভেঙে গেছে গ্রামীণ যাতায়াত ব্যবস্থা। অত্যন্ত মানবেতর জীবন-যাপন করছেন বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টাঙ্গাইল অংশের যমুনা ও ধলেশ্বরী নদীসহ কয়েকটি শাখা নদীর পানি ব্যাপক পরিমাণে প্রতিনিয়তই বাড়ছে। ফলে টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার দুর্গাপুর, গোহালিয়াবাড়ী, সল্লা, দশকিয়া ইউনিয়ন, এলেঙ্গা পৌরসভার কিছু অংশ, ভূঞাপুর উপজেলার গাবসারা, অর্জুনা, গোবিন্দাসী, নিকরাইল, অলোয়া ইউনিয়ন, পৌর এলাকার কিছু অংশ, টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাকুয়া, হুগড়া, গালা ইউনিয়ন, বাসাইল উপজেলার কাঞ্চনপুর, ফুলকি, কাউলজানী ইউনিয়ন এবং নাগরপুর উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে।

এতে জেলার কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। নিমজ্জিত হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন, আউশ, বীজতলা ও সবজি বাগান। ক্লাস রুমে পানি প্রবেশ করায় অর্ধশত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠদান বন্ধ হয়ে গেছে। স্থগিত করা হয়েছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চলমান দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষা। প্রতিদিনই প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা ও নিমজ্জিত হচ্ছে ফসলি জমি।

বন্যার পানিতে বসতবাড়ি তলিয়ে যাওয়ায় অনেকেই ঘরের মধ্যে উচু বাঁশের মাচা পেতে পরিবার পরিজন নিয়ে দুর্বিসহ জীবন-যাপন করছেন। হাজার হাজার মানুষ নিজ ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবার-পরিজন ও গবাদিপশু নিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ও অন্যের উঁচু জমি এবং বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে। এদের অধিকাংশই রয়েছে খোলা আকাশের নিচে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে সামান্য কিছু ত্রাণ সহযোগিতা দেওয়া হলেও বেশিরভাগ এলাকাতেই পৌঁছায়নি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের কোনো সাহায্য।



টাঙ্গাইল সদর উপজেলার কাকুয়া ইউনিয়নের চরপৌলী গ্রামের সবুজ সরকার নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমাদের সারা গ্রামের পাঁচ হাজার মানুষই পানিবন্দি। কমপক্ষে দুই শতাধিক বাড়ি-ঘর নদীগর্ভে চলে গেছে। মানুষ যে কি কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন তা বলে বুঝানোর উপায় নাই।

বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও শুকনো খাদ্যের তীব্র সংকট। বেশিবরভাগ এলাকাতেই বিশুদ্ধ পানির উৎস টিউবওয়েল ডুবে গেছে। ডুবন্ত টিউবওয়েলের পানি পান করে রোগে আক্রান্ত হচ্ছে বানভাসিরা। এখন পর্যন্ত সরকারিভাবে কোনো ওষুধ বা পানি বিশুদ্ধকরণের ট্যাবলেট পৌঁছায়নি বন্যা কবলিত মানুষের কাছে। যদিও প্রশাসন থেকে দাবি করা হয়েছে বন্যার্তদের জন্য মেডিক্যাল টিম গঠন করা হয়েছে। ওষুধ ও পানি বিশুদ্ধকরণের ওষুধ রয়েছে। কিন্তু সেগুলো বন্যা কবলিত মানুষের কাছে যাচ্ছে না বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সরেজমিনে ভূঞাপুর উপজেলার গাবসারা, অর্জুনা ইউনিয়নসহ বন্যা কবলিত এলাকায় গেলে স্থানীয়রা অভিযোগগুলো করেন। তারা বলেন, কোনো ডাক্তার বা স্বাস্থ্য সহকারী আমাদের খোঁজ নেয়নি। পানিতে বসবাস করে হাত-পায়ে ঘাঁ তৈরি হয়েছে। বিশুদ্ধ পানি ও শুকনা খাবার না থাকায় নদীর পানি ও ডুবন্ত টিউবওয়েল এর পানি পান করছি।

গাবসারা ইউনিয়নের রেহাই গাবসারা গ্রামের আব্দুল লতিফ বলেন, ‘ভাই ত্রাণ চাই না, খাবার পানি দেন, খাইয়া বাঁচি।’

অর্জুনা ইউনিয়নের শশুয়া গ্রামের আব্দুল হামিদের সঙ্গে কথা হলে তিনি তার পা ও হাতের ঘাঁ দেখিয়ে বলেন, পানিতে থেকে শরীরে ঘাঁয়ের সৃষ্টি হয়েছে। পানি বাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছি। ঘরে উঁচু মাচা করে কোনো রকমে থাকছি।



গাবসারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বলেন, হাজারও বন্যার্তদের মাঝে বিশুদ্ধ পানি ও শুকনা খাবার খুবই প্রয়োজন। পানি বিশুদ্ধকরণের জন্য কোনো ওষুধ পাওয়া যায়নি।

থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কর্মকর্তা মো. আবু সামার বরাত দিয়ে তিনি বলেন, মেডিক্যাল টিম গঠন করা আছে। প্রয়োজন হলে তাদের অবগত করতে বলা হয়েছে। ত্রাণের বিষয়ে তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার প্রশাসন থেকে মাত্র দুই টন চাল ডিও বরাদ্দ পেয়েছি। যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, ‘জেলা প্রশাসন থেকে পাঁচ টন চাল ও এক লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও উপজেলা পরিষদ হতে আরো পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুই হাজার পরিবারের মাঝে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করা হবে। শুক্রবার থেকে ত্রাণ বিতরণ শুরু হবে। ধারাবাহিকভাবে ত্রাণ কার্যক্রম চলবে।’

টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান সিরাজ বলেন, যমুনা নদীর পানি টাঙ্গাইলে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জোকারচর-তারাকান্দি বাঁধে ভূঞাপুর অংশের ১০ জায়গায় লিকেজ দেখা দেওয়ায় সংস্কার করা হচ্ছে। অর্জুনা ও পিংনায় লিকেজ বেশি দেখা যাওয়ায় সেখানে পাউবোর লোকজন সারাক্ষণ কাজ করছে। সরিষাবাড়ীর কাউয়ামারায় বাঁধ ভেঙে পানি বাঁধের পূর্ব পাশে ঢুকছে। সেখানেও পাউবো এবং সেনাবাহিনী কাজ করছে।

টাঙ্গাইলে জেলা প্রসাশক খান মো. নূরুল আমিন বলেন, আমি বন্যা কবলিত এলাকা পরিদর্শন করেছি। ভূঞাপুর ও টাঙ্গাইল সদর উপজেলায় জরুরি ভিত্তিতে শুকনা খাবার এবং চাল আজকের মধ্যে পৌঁছে যাবে। বন্যা কবলিত এলাকার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা করার জন্য ইউএনওদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তালিকা পাওয়ার পর তাদেরকে সাহায্য করার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলোতে পানি উন্নয়ন বোর্ড মেরামত কাজ চালাচ্ছে।




রাইজিংবিডি/টাঙ্গাইল/১৭ আগস্ট ২০১৭/শাহরিয়ার সিফাত/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়