ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

শিশুদের ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই: মামুন হোসাইন

স্বরলিপি || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০২, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩   আপডেট: ১৫:২২, ৩ মার্চ ২০২৩
শিশুদের ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই: মামুন হোসাইন

চিত্রশিল্পী মামুন হোসাইন। কর্মসূত্রে বসবাস ঢাকায়। তবে বুকের ভেতর রাখেন নিস্তব্ধ এক গ্রাম আর ধীরে চলা কপোতাক্ষের ছোট-ছোট ঢেউ। শৈশবে মামুন হোসাইনের দেখা প্রিয় দৃশ্যগুলোর একটি হলো, রাতে কুপি বাতি জ্বালিয়ে মা মাহমুদা বেগম খুকু নকশি কাঁথা বুনছেন। কুপির আলো ছড়িয়ে পড়েছে মায়ের মুখে। সেই দৃশ্যে রং, রূপের নির্জনতা, একটি পাখির পেছনে পুরো দুপুর কাটিয়ে দেওয়া আর মফস্বলের বাজারের কোলাহল- সবই রয়েছে তাঁর শৈশব স্মৃতিতে। সব মিলিয়ে মামুন হোসাইনের চিত্রকল্পে নিস্তব্ধতা আর কোলাহলের একত্র বসবাস। শিশুতোষ বই অলঙ্করণ করে খ্যাতি অর্জন করেছেন তিনি। শিশুদের জন্য লিখেছেন ‘পাখি রাঙানো বুড়ো’ এবং ‘পাতার পাখি’ নামে দুটি বই। মামুন হোসাইনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি স্বরলিপি।

স্বরলিপি: পাখির প্রতি আপনার আলাদা মায়া আছে। তো পাখির প্রতি এতো ভালোবাসা কেন?

মামুন হোসাইন: শৈশব থেকেই পাখি ভালোবাসি আমি। পাখির পেছনে দৌড়ানোর অনেক স্মৃতি আছে আমার। খুঁজে আনতাম ডাহুকের ডিম। বড় হওয়ার পর পাখির প্রতি প্রেম আরো বেড়েছে। এর পেছনে একজনের অবদান আছে। তিনি আন্তর্জাতিক পাখিবিশারদ ইনাম আল হক। তাঁর সঙ্গে অনেক বার পাখি দেখার জন্য বেড়িয়ে পড়েছি। ঢাকা থেকে দূরে কোথাও চলে গেছি পাখি দেখতে। তিনি পাখি দেখতে দেখতে সেই পাখির সম্পর্কে বিস্ময়কর সব গল্প বলেন। আমি মুগ্ধ হতাম।

স্বরলিপি: শিশুতোষ বইয়ের অলঙ্করণ করার সময় কোন বিষয়টি আপনার ভাবনায় থাকে? 

মামুন হোসাইন: শিশুতোষ বইয়ের অলঙ্করণ করা আনন্দের কাজ। কিন্তু সহজ কাজ নয়। একটি শিশু যখন পড়বে, ছবির মধ্যে দিয়ে আগে পড়াটা বুঝে নিতে চাইবে। আবার পড়ার একটা একঘেঁয়েমি থাকে, এই একঘেঁয়েমি কাটানোর মধ্যে বইয়ের পাতায় ইলাস্ট্রেশন দরকার হয়। শিশুদের ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। ওদের পৃথিবীটা রঙিন। ওদের পছন্দ-অপছন্দ আছে। শুধু তাই নয়, সেই সব ভাবনার পেছনে বিস্তর যুক্তিও আছে । ছবির সঙ্গে তারা একাত্ম হতে চায়। একটি বই অলঙ্করণ করার সময় বা কোনো চরিত্র ফুটিয়ে তোলার সময় ভাবি- এই ছবিটা দেখেই যেন ওদের ভালোবাসার ইচ্ছা জাগে। ওরা যেন আদর করতে চায়। সেক্ষেত্রে কোন বয়সের পাঠকের বই, সেই অনুযায়ী চরিত্র অঙ্কণ করা হয়। একটি চার বছরের শিশুর চরিত্র কোনোভাবেই এগারো বছরের শিশুর ভেতর দিয়ে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি না। ধরেন লেখক একটা চরিত্র তৈরি করেছেন, সেই চরিত্র কেমন হবে? সেই চরিত্রের সঙ্গে শিশুকিশোর পাঠক সম্পর্ক তৈরি করতে পারবে কিনা- সেটা গুরুত্ব দিয়ে চিন্তা করার প্রয়োজন আছে। সেই অনুযায়ী চরিত্র তৈরি করতে হবে। মোটকথা পাঠকের সাইকোলজি বুঝে অলঙ্করণ করার চেষ্টা করি।

স্বরলিপি: প্রচ্ছদশিল্পী ও কথাশিল্পী ধ্রুব এষের কয়েকটি বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করেছেন আপনি। অভিজ্ঞতা জানতে চাই।

মামুন হোসাইন: এই সৃষ্টিশীল মানুষটি একদিন আমাকে বললেন- তাঁর বইয়ের প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করতে। তাঁর বইয়ের কাজ করা কি পরিমাণ চ্যালেঞ্জিং এবং প্রেসারের- বলে বোঝাতে পারব না। তারপর আবার ধ্রুবদা শর্ত দিলেন, বই প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত তিনি আমার কাজ দেখবেন না। ঠিক তাই-ই করেছিলেন। ধ্রুবদার ভাষ্য অনুযায়ী প্রচ্ছদ আর  অলঙ্করণ নিয়ে একজন প্রচ্ছদশিল্পীকে লেখক ও প্রকাশের অনেক কথা শুনতে হয়। একটা শেষ হওয়া কাজও অনেক সময় দ্বিতীয়বার করতে হয়। এই প্যারা তিনি অন্য কাউকে দিতে চান না। যে কারণে তিনি এমন শর্ত দিয়েছিলেন।   

স্বরলিপি: দৃশ্যজুড়ে রং আর মায়া থাকে। মফস্বলের বাজারে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থাকলে আপনি জানেন, সেখানে অনেক রকম কোলাহল আর রঙের পসরা বসে? কেমন দেখেছেন সেই পরিবেশ?

মামুন হোসাইন: গ্রামে আমার বেড়ে ওঠা। ফলে প্রকৃতি বা আশপাশের পরিবেশ, সেই রং আমার খুব আপন। খুব চেনা। গ্রামের বাজারে কি দেখা যায়- বিচিত্র মানুষের আনাগোনা। একেক জনের একেক বয়স, পোশাক। চারপাশে অনেক ধরনের সবজি থরে থরে সাজিয়ে রাখা। এতো ভ্যারাইটি কালার, এতো সতেজ সেই রং দেখে মুগ্ধ না-হয়ে উপায় থাকে না। এখনো বাজারের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে মুগ্ধ হয়ে সেই রং দেখি, সতেজ সবজি দেখি। আর কোলাহল? কোলাহল আমার খুব একটা পছন্দ না। নিজের মতো করে থাকতেই ভালো লাগে। যখন কোলাহলের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাই, তখনও আমি আমার মতো করেই ভাবি এবং সামনে এগিয়ে যাই। সেটা মাছের বাজার হোক কিংবা সবজি বাজার।

স্বরলিপি: রং আর চিন্তার মিশেলে একটি ছবি পূর্ণতা পায়। সব অলঙ্করণ কি শিশুর মনোজগতে ইতিবাচক প্রভাব রাখতে সক্ষম?

মামুন হোসাইন: না, কিছু কাজ আছে একেবারে হতাশাজনক। দেখা যাচ্ছে যে, লেখক চার বছর বয়সের একটি চরিত্র নির্মাণ করেছেন। দেখা গেল শিল্পী চরিত্রটি নিষ্প্রতিভ করে আঁকলেন। বা লেখক বর্ণনা করছেন চার বছরের এক ছোট্ট মেয়ে শিশুর চরিত্র, শিল্পী আঁকছেন এগারো-বারো বছরের চরিত্র। এতে শিশুপাঠক মেলাতে পারে না। তার চিন্তার ভারসাম্য নষ্ট হয়। এর একটা মারাত্মক প্রভাব আছে। যা একজন সচেতন শিল্পী করেন না। তিনি ভারসাম্যকে প্রাধান্য দেন।

স্বরলিপি: আপনার চোখে এই সচেতন শিল্পীদের নাম জানতে চাই।

মামুন হোসাইন: আমার পছন্দের তালিকায় অনেকেই আছেন। অসাধারণ সব কাজ করছেন তারা। তাদের মধ্যে মেহেদি হক, নাসরিন সুলতানা মিতু, বিপ্লব, তীর্থ, রোমেলসহ অনেকেই খুব ভালো কাজ করছে।

স্বরলিপি: শুরুতে কথা হচ্ছিল যে, শিশুদের ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। এই যুক্তিতে কীসের ভিত্তিতে পৌঁছালেন?

মামুন হোসাইন: আমি আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা ‘রুম টু রিড’র একটি কাজ করতে গিয়ে ‘ফিল্ড টেস্ট’ করেছি। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার একটি স্কুলে আমাদের আঁকা বইগুলো শিশুদের দিয়ে, ওদের এক্সপ্রেশন দেখেছি। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ওরা ছবি দেখলো, গল্প শুনলো। এরপর প্রশ্ন করা হলো- গল্প কেমন লেগেছে? ইলাস্ট্রেশন কেমন লেগেছে? আপনি বিশ্বাস করতে পারবেন না, ওরা যা বললো সব যৌক্তিক। আমরা তো একটা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছি কিন্তু ওরা মজার মজার সব সমালোচনা করল। আরো কি কি থাকলে ছবিটা সুন্দর হতো, ওরা সেসবও বলে দিল এবং সেগুলো পুরোপুরি লজিক্যাল। তার মানে ওদের ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নাই।

//তারা//

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়