ঢাকা     রোববার   ০৫ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২২ ১৪৩১

‘বোটানিক্যাল গার্ডেনের আরো রক্ষণাবেক্ষণ করা জরুরি’ 

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৭, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৩:৩২, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩
‘বোটানিক্যাল গার্ডেনের আরো রক্ষণাবেক্ষণ করা জরুরি’ 

মো.আজহারুল ইসলাম

জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যান বা বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্বেরিয়াম বাংলাদেশে উদ্ভিদ প্রজাতি সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রদর্শনের সবচেয়ে বড় কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। কেন্দ্রটি ‘ন্যাশনাল বোটানিক্যাল গার্ডেন’ নামে পরিচিত। ঢাকার মিরপুরে বাংলাদেশ জাতীয় চিড়িয়াখানার পাশেই এর অবস্থান। ঢাকার আরেকটি উদ্যান বলধা গার্ডেন প্রশাসনিকভাবে এই উদ্যানের অংশ। প্রতি বছর প্রায় ১৫ লাখ দর্শনার্থী উদ্যানটি দেখতে আসেন।

জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে বর্তমানে ১১৭টি গোত্রভুক্ত ৯৫২ প্রজাতির গাছ রয়েছে। আছে বিভিন্ন আকারের মোট ৭টি জলাশয়। একটি জলাশয়ের পাশে রয়েছে কৃত্রিম জলপ্রপাত ও ডেক। আরও রয়েছে শাপলা পুকুর ও গোলাকৃতির পদ্মপুকুর। উদ্যানের ১.৫ একর জুড়ে রয়েছে মৌসুমী ফুলের বাগান। বাগান ঘিরে রয়েছে একটি আঁকাবাঁকা কৃত্রিম লেক। ১৯৮০ সালে প্রায় ৩.৫ একর জায়গার উপর নির্মিত হয় উদ্যানের গোলাপ বাগান। দু'টি পৃথক বাগানে প্রায় ২০০ প্রজাতির গোলাপ রয়েছে। উদ্যানের ক্যাকটাস গ্রিন হাউজে ৮০ প্রজাতির ক্যাকটাস এবং সাকুলেন্ট সংরক্ষিত রয়েছে। গ্রিন হাউজটি ১৯৯৪ সালে নির্মিত হয়। উদ্যানে বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ নিয়ে ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক এলাকা নামে একটি শাখা সৃষ্টি করা হয়। এই শাখায় রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার সিলভার ওক, জ্যাকারান্ডা ও ট্যাবে বুইয়া, জাপানের কর্পূর গাছ, মালয়েশিয়ার ওয়েল পাম, থাইল্যান্ডের রামবুটান। এ ছাড়াও উদ্যানের প্রায় ৫ একর জায়গাজুড়ে একটি নার্সারি রয়েছে। সরকার নির্ধারিত মূল্যে এই নার্সারি থেকে চারা কেনা যায়।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে উদ্যান। বিশেষ করে প্রাতঃভ্রমণকারীদের প্রিয় জায়গা এটি। আমরাও নগরীর আরেক প্রান্ত থেকে মাঝেমধ্যে সেখানে যাই। আমাদের উদ্দেশ্য ফটোগ্রাফি। কিছুদিন আগেও গিয়েছিলাম, সঙ্গে ছিলেন সমুদ্রগামী জাহাজের ক্যাপ্টেন কাওছার আহমেদ, চিত্রশিল্পী ফরিদী নোমান এবং ব্যবসায়ী ফারুক আহমেদ। সবাই ওয়াইল্ড ফটোগ্রাফার। 

২০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে আমরা মেইন গেইট পেরিয়ে গোলাপ বাগানের দিকে যাচ্ছি, হঠাৎ মাঝবয়সী এক ভদ্রলোককে একটা গাছের কাছে দেখা গেল। তিনি গাছের পাতা উল্টেপাল্টে দেখছেন। গাছের গায়ে আঙুল বুলিয়ে কি যেন পরীক্ষা করছেন। এগিয়ে গিয়ে পরিচিত হলাম। তিনি উদ্ভিদ নিয়ে এ সময়ের জনপ্রিয় ভিডিও ক্রিয়েটর ও উদ্ভিদপ্রেমী মো.আজহারুল ইসলাম। ফেসবুকে ইতোমধ্যে তার ভিডিও ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বৃক্ষপ্রেমীদের কাছে তিনি পরিচিতি একটি নাম। 

প্রকৃতির প্রতি তার নিগুঢ় ভালোবাসা সবাইকে মুগ্ধ করে। তাঁর ভিডিও যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন যে কোনো গাছের পরিচয় দেওয়ার সময় প্রকৃতি ও সাহিত্য মিশিয়ে তিনি চমৎকার বর্ণনা দেন। তার কথায় কখনো কবিগুরু, কখনো কবি নজরুল উল্লেখযোগ্যভাবে স্থান পায়। আজহারুল ইসলামের সঙ্গে আলাপচারিতার কিছু অংশ তুলে ধরছি: 

রাইজিংবিডি : আপনি কি কবিগুরুর ভক্ত?

আজহার : বাংলা সাহিত্যের প্রবাদ পুরুষ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অনেক উদ্ভিদ ও ফুলের বাংলা নামকরণ করেছেন। একজন কবি যদি প্রকৃতিকে ভালো না বাসেন তাহলে তাঁর কলমে এমন করে প্রকৃতি উঠে আসতে পারে না।  

রাইজিংবিডি : এটা কী রকম?  

আজহার : যেমন ধরুন কবিগুরু লিখেছেন মাধবী হঠাৎ কোথা হতে এলো ফাগুন দিনের স্রোতে। এসেই বলে যাই যাই যাই। কি অপূর্ব তাঁর লেখা যা একটা ফুলের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যায়।

রাইজিংবিডি : বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করেন?  

আজহার : বিদ্রোহী কবি যা রচনা করে গেছেন তার মধ্য দিয়ে আমাদের সাহিত্য ভাণ্ডার যেমন সমৃদ্ধ হয়েছে তেমনি তাঁর সেই সাহিত্য যেন প্রকৃতির গলে হীরার হার হয়ে ঝলমল করছে। যেমন ধরুন কবি লিখেছেন ‘বকুল চাঁপার বনে কে মোর চাঁদের স্বপন জাগালে।’ কবি নজরুলের শক্তিশালী কলমে প্রকৃতি ও প্রেম নিয়ে এ রকম অনেক গান প্রকাশিত হয়েছে। যা আমাকে বিমোহিত করে।

রাইজিংবিডি : উদ্ভিদ ও প্রকৃতির প্রতি আপনার ভালোবাসা কীভাবে হলো?

আজহার : আসলে প্রকৃতি প্রেম বিষয়টা কারো মধ্যে জাগ্রত করা যায় না, বা কারো মধ্যে জাগিয়ে তোলা যায় না। প্রকৃতিপ্রেমী তৈরি করার কোন স্কুল কলেজ আছে বলে আমার জানা নেই। প্রকৃতি প্রেম সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত। এটা যার থাকবে তো থাকবেই। আর যার মধ্যে থাকবে না আপনি চাইলেও সৃষ্টি করে দিতে পারবেন না। আমার ব্যাপারে বলতে পারেন আমার জিনের মধ্যেই প্রকৃতি প্রেমের একটা বীজ বপন করা আছে।

রাইজিংবিডি : আপনি এত উদ্ভিদের নাম জানেন কীভাবে?

আজহার : আসলে আমি একজন বোটানিস্ট। আমি এ বিষয় নিয়েই পড়াশোনা করেছি। এ ছাড়াও আমি এখনো নিজেকে একজন শিক্ষানবিশ মনে করি। যে সব উদ্ভিদ সনাক্ত করতে অসুবিধে হয় সেগুলির জন্য বন্ধু-বান্ধব ও আমার শিক্ষকদের সাহায্য নেই।

রাইজিংবিডি : এ বিষয়ে আপনি সাধারণত কাদের কাছে সাহায্য চান?

আজহার : সাহায্য নিতে আমার কোন রকম লজ্জাবোধ নেই। এটা যেমন একজন ছোট বাচ্চাও হতে পারে আবার কোনো টেক্সোনমিস্ট হতে পারেন, একজন অধ্যাপকও হতে পারেন। যেমন আমি যখনই কোনো উদ্ভিদের নাম সনাক্তকরণের সমস্যায় পড়ি, তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের আব্দুর রহিম ভাইয়ের দারস্থ হই। এ ছাড়া তাপস বর্দ্ধন দাদা, মোস্তাক কাদরী ভাই, কানাডা প্রবাসী উদ্ভিদ বিজ্ঞানী তিমির মোস্তফা ভাই, ক্যাপ্টেন কাওসার মোস্তফা ভাই। এ ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সোনমির প্রফেসর মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন ভাইয়ের কাছ থেকে আমি অনেক সাহায্য পাই। তাঁদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ।

রাইজিংবিডি :উদ্ভিদের ভিডিও করার আগে কি আপনি স্ক্রিপ্ট করে নেন কিনা?

আজহার :  স্ক্রিপ্ট তৈরি করে নিতে পারলে ভালো হয়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সেই সুযোগ পাওয়া যায় না। ধরুন ঢাকা শহরে কোথাও পার্থেনিয়াম নেই। আমি কোনো একটা কাজে মানিকগঞ্জ যাচ্ছি। হঠাৎ রাস্তার পাশে পার্থেনিয়াম পেয়ে গেলাম। এই অবস্থায় ভিডিও না করে আমি যেমন ফিরে আসতে পারব না, তেমনি স্ক্রিপ্ট তৈরি করারও কোন সুযোগ নেই। সুতরাং তাৎক্ষণিকভাবে ভিডিও করতেই হয়। এ ক্ষেত্রে সীমিত জ্ঞান থাকলে ভুল হওয়ার আশঙ্কা বেশী।

রাইজিংবিডি :গাছ চিনতে আপনার কখনো ভুল হয় না?

আজহার :  মানুষ মাত্রেই ভুল হয়। সুতরাং আমারো ভুল হয়। তবে ভুল কমানোর একটা পদ্ধতি আছে। সেটা হলো সবসময় নিজেকে আপডেট রাখতে হয়। আমি নিয়মিত পড়াশোনা করি। এটা আমার কাছে এখন জীবনের অংশ হয়ে গেছে। 

রাইজিংবিডি : একটা বিষয় জানতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। নতুন প্রজন্মকে উদ্ভিদ ও প্রকৃতি নিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে কোন প্রতিষ্ঠান করার স্বপ্ন দেখেন কি না? 

আজহার : এটা একটা বিশাল ব্যাপার। নতুন প্রজন্মকে এ বিষয়ে আগ্রহী করতে হলে উদ্ভিদের উপকারী বিষয়গুলো জানানোর জন্য নিয়মিত ক্যাম্পেইন করতে হবে। তারপর ধীরে ধীরে এমন একটা কাজ করা যেতে পারে। বোটানিক্যাল গার্ডেন আমাদের জন্য উদ্ভিদের জীবন্ত সংগ্রহশালা। এই উদ্যানের আরো রক্ষণাবেক্ষণ করা জরুরি। সাধারণ দর্শনার্থীদের সতর্ক করা প্রয়োজন যেন কোন অবস্থাতেই তারা উদ্ভিদের ডালপালার ক্ষতি না করেন।

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ