ঢাকা     শুক্রবার   ০১ নভেম্বর ২০২৪ ||  কার্তিক ১৭ ১৪৩১

তলস্তয়ের ‘ক্রয়টজার সোনাটা’: অসহ্য আয়না

জাকির তালুকদার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ২৭ জুন ২০২০   আপডেট: ১০:৩৯, ২৫ আগস্ট ২০২০
তলস্তয়ের ‘ক্রয়টজার সোনাটা’: অসহ্য আয়না

স্ত্রী সোফিয়ার সঙ্গে লিও তলস্তয়

একজন অভিজাত পুরুষ সন্দেহ করছিল তার স্ত্রী একজন ভায়োলিন-বাদকের সাথে প্রেম করছে। সেই সন্দেহের বশেই একদিন সে স্ত্রীকে হত্যা করে।

কাহিনী বলতে গেলে এটুকুই। কিন্তু তলস্তয়ের মতো মহান লেখকের গল্প শুধু কাহিনীতে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং পাওয়া যায় গল্পনির্মাণশৈলির অনবদ্য পরিচয়, পাওয়া যায় ব্যক্তি এবং সামাজিক মনস্তত্ত্ব। সেইসব কারণেই ‘ক্রয়টজার সোনাটা’ পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের কাছে হয়ে ওঠে এক অপরিহার্য টেক্সটবুক।

তলস্তয়-পত্নী সোফিয়া কখনোই চাননি এই লেখাটি প্রকাশিত হোক। ‘ক্রয়টজার সোনাটা’, বড়গল্প বা নভেলা; তলস্তয় লিখেছিলেন ১৮৮৯ সালে। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলো ১৮৯১ সালে। এবং প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই নিষিদ্ধ হলো রাশিয়াতে। সোফিয়ার ইচ্ছা কিছুটা হলেও পূর্ণ হলো। লেখাটি পড়তে পারল না বেশি মানুষ। তবে সোফিয়াই আবার পরে জারের সাথে দেখা করে অনুমতি আদায় করেন যে যখন তলস্তয়ের রচনাবলী প্রকাশিত হবে, তখন সেখানে অন্তর্ভূক্ত করা যাবে ‘ক্রয়টজার সোনাটা’।

সোফিয়ার আপত্তির কারণ কী?

কারণ এই লেখাটিতে ব্যক্তি তলস্তয় নিজে প্রকটভাবে উপস্থিত। এবং উপস্থিত সোফিয়াও। উপস্থিত তাদের দাম্পত্যজীবনের শুরুর দিকের ঘটনাগুলিও।

তলস্তয়ের অন্য লেখাগুলোর মতো ‘ক্রয়টজার সোনাটা’রও ফ্রেশ কপি করতে হয়েছিল সোফিয়াকে। সেটি করতে গিয়ে অনেকবারই তিনি চেয়েছেন পাণ্ডুলিপিটি আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনুলিপি প্রস্তুত করতে হয়েছে তাকে সাশ্রুনয়নে।

০২.

লেখাটি শুরু হয় এই প্রশ্ন দিয়ে- ভালোবাসা জিনিসটি কি আমাদের কাছে পরিষ্কার?

‘ক্রয়টজার সোনাটা’ উত্তম পুরুষে লেখা। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে প্রথমে যে চরিত্র কথক হিসাবে আবির্ভূত হয়, সেই চরিত্রটি একটু পরেই পরিণত হয় স্রেফ শ্রোতায়। এই চরিত্রটির কোনো নামও দেননি লেখক।

দুইদিন ধরে একটানা ছুটে চলছে ট্রেন। সব স্টেশনেই যাত্রীর ওঠানামা আছে। কিন্তু যাত্রার শুরু থেকে ট্রেনের একই কামড়ায় আছে কেবলমাত্র চারজন নারী-পুরুষ। তাদের মধ্যে একজন এই গল্পের কথক। অন্য তিনজনের বর্ণনা পাচ্ছি কথকের মুখে- ‘মাঝবয়সী, দেখতে ভালো নয় স্ত্রীলোক একজন, আধা-পুরুষালি কোট ও টুপি পরিহিতা, সিগারেট খেয়ে চলেছে, মুখটা ক্লিষ্ট; আর একজন তার পরিচিত, বছর চল্লিশের বকুনতুরে মানুষ। ... তৃতীয় ভদ্রলোকটি নিজেকে তফাতে রাখছেন; লম্বায় মাঝারি গোছের, নড়নচড়ন ছটফটে, বুড়ো নন বটে কিন্তু কোঁকড়ানো চুলে অকালে পাক ধরেছে; চোখ দুটো অস্বাভাবিক চকচকে, খালি এ জিনিসে ও জিনিসে অস্থির তাদের দৃষ্টিপাত। ... ভদ্রলোকটির একটি অদ্ভুত ব্যাপার আছে; থেকে থেকে তিনি উদ্ভট আওয়াজ করছিলেন, গলা খাঁকারি দেবার মতো কিংবা হঠাৎ হেসে উঠে তক্ষুনি হাসি চেপে যাবার মতো।’

তবে দুইদিন ধরে একই কামড়ার সবাইকে এড়িয়ে চলা এই ভদ্রলোকটি কথা বলে উঠলেন কামড়ার স্ত্রীলোকটির প্রেম ও বিবাহ সম্পর্কিত কথাবার্তা কানে আসাতে। ভদ্রমহিলা তার সঙ্গীর সাথে কথা বলার সময় খুব জোর গলায় দাবি করছিলেন যে- ‘ভালোবাসা না থাকলে বিয়ে বিয়ে নয়, বিয়ে পূত হয় একমাত্র ভালোবাসার জোরে, ভালোবাসায় পূত বিয়ে হলো সত্যিকারের বিয়ে।’

তখন হঠাৎ-ই কথা বলে উঠলেন নিজেকে সবকিছু থেকে সরিয়ে রাখা লোকটি- ‘সে ভালোবাসাটা- যেটা বিয়েকে পূত করে- সেই ভালোবাসা জিনিসটা কী?’

ভদ্রমহিলার উত্তর- ‘সত্যিকার ভালোবাসা... পুরুষ ও নারীর মধ্যে যে ভালোবাসা থাকলে বিয়ে সম্ভব।’

- ‘বেশ, কিন্তু সত্যিকারের ভালোবাসাটি কী, বুঝব কী করে?’

স্ত্রীলোকটি আলোচনার ইতি টানতে চাইলেন। বললেন- ‘সবাই জানে ভালোবাসাটা কী।’

কিন্তু লোকটি নাছোড়বান্দা- ‘আমি কিন্তু জানি না। আপনার ধারণাটা স্পষ্ট করা দরকার।’

একটু ভেবে নিয়ে স্ত্রীলোকটি উত্তর দিলেন- ‘ভালোবাসা? সবাইকে ছেড়ে কেবল একজনের ওপর টান হওয়াটা হলো ভালোবাসা।’

এবারের প্রশ্নটি আরো বিব্রতকর- ‘টানটা কতদিনের জন্যে? এক মাস? দুই দিন? আধা ঘণ্টা?’

ভদ্রমহিলার সঙ্গী একটু বিস্তারিতভাবে বলার চেষ্টা করলেন শুরুর কথাগুলোই- ‘বিয়ে হওয়া উচিত প্রথমত অনুরাগ থেকে- প্রেম বলতে পারেন ইচ্ছে হলে- আর সেটা থাকলে তখনই শুধু বিয়েকে বলা যায়... ইয়ে... পবিত্র আর কি। দ্বিতীয়ত- পরস্পরের প্রতি স্বাভাবিক অনুরাগের ভিত্তিতে বিয়ে না হলে, বিয়ের কোনো নৈতিক বাধ্যবাধকতা থাকে না।’

কিন্তু এই ব্যাখ্যা সন্তুষ্ট করতে পারল না প্রশ্নকারীকে। পুরনো প্রশ্নই আবার উঠল- ‘আমি ঠিক সেই কথাটাই বলছি। সবাইকে ছেড়ে কোনো বিশেষ নারী বা পুরুষের প্রতি আকর্ষণের কথা। কিন্তু আমি শুধু জিজ্ঞেস করি- কতদিনের জন্য?’

স্ত্রীলোকটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে- ‘কত দিন? মাঝে মাঝে সারা জীবন।’

সরাসরি তার কথা অস্বীকার করে ভদ্রলোকের উক্তি- ‘নাটক নভেলে ওটা ঘটে, জীবনে কখনো নয়। অন্যদের ছেড়ে একজনের ওপর টান জীবনে কয়েক বছর টেকে কদাচিৎ, বরং তার আয়ু মাস কয়েক, মাঝে মাঝে মাত্র কয়েক সপ্তাহ, কয়েকদিন বা কয়েক ঘণ্টা মাত্র।’

এভাবেই প্রেম ও বিয়ে সম্পর্কিত রোমান্টিক ধারণার ওপর বাজ ফেলেন সেই অমিশুক মানুষটি। জানা যায়, তার নাম পজদনীশেভ। এই লোকটি তার স্ত্রীকে ব্যভিচারের অভিযোগে হত্যা করেছেন। কিন্তু উপযুক্ত সাক্ষী-প্রমাণের অভাবে মুক্তিও পেয়ে গেছেন।

ক্রয়টজার সোনাটা: প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই নিষিদ্ধ হয়েছিলো

০৩.

কেন অবিশ্বাস স্ত্রী’র প্রতি?

তলস্তয় সেই সময়ের রুশসমাজের ওপরতলার মানুষ। অভিজাতদের মধ্যেও প্রায় সর্বোচ্চে অবস্থান ছিল তার পরিবারের। উপাধি ছিল ‘কাউন্ট’। জার বা সম্রাটের পারিবারিক অনুষ্ঠানগুলোতে ছিল তাদের যাতায়াত। এই অভিজাত সমাজকে পুঙ্খানুপুঙ্খ চিনতেন তলস্তয়। অন্যদের মতো অভিজাত হিসাবে গতানুগতিক ভোগী, অলস, কদর্য জীবনযাপনের পরিবর্তে সেই জীবনকে ঘৃণা করতে শিখেছিলেন তিনি। কেননা দেখতে পেয়েছিলেন সেই সমাজে আন্তঃমানবিক, পারিবারিক, সামাজিক- সব ধরনের সম্পর্কই ফাঁপা এবং মেকি। তলস্তয়ের মতো বড় শিল্পীরা এটি দেখতে পান। যেমন দেখতে পেয়েছিলেন বালজাক। অভিজাততন্ত্রের সমর্থক হয়েও বালজাক অভিজাত সমাজের কুৎসিত দিকগুলোকে তুলে ধরেছিলেন নিজের উপন্যাসগুলিতে। তলস্তয় দেখান যে, এই রকম সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যকার দাম্পত্য সম্পর্ক নিরতিশয় মিথ্যা এবং অভিনয়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। স্বামীরা তাদের স্ত্রীদের অবিশ্বাস করে, কারণ তারা তাদের সমাজ চেনে, চেনে পুরুষদের ‘লাম্পট্য’ এবং নারীদের ‘ছেনালিপনা’। পজদনীশেভের জবানিতে লেখক জানান- ‘ঠকে কেবল হতভাগ্য কুমারীরাই। মায়েরা সবকিছু জানে, বিশেষ করে স্বামীদের কাছ থেকে যারা শিখেছে, তারা ভালোভাবে জানে। পুরুষের শুচিতায় বিশ্বাসের ভান তারা করে বটে, কিন্তু আচরণ তাদের একেবারে অন্য ধরনের। নিজেদের জন্য, নিজেদের মেয়েদের জন্য পুরুষ ধরার কী টোপ ফেলা উচিত, তাদের জানা।’

আর ‘আমরা পুরুষেরা শুধু জানি না, জানতে চাই না বলে জানি না, মেয়েরা কিন্তু খুব ভালো করে জানে যে তথাকথিত মহান কাব্যিক প্রেমের উৎস নৈতিক গুণ নয়, শারীরিক সান্নিধ্য, কেশবিন্যাস, ফ্রকের রং ও কাটছাট।... আর সেজন্যেই এ সব ন্যাক্কারজনক জার্সির বাহার, পেছন-ফাঁপানো ফ্রক, খোলা কাঁধ আর হাত আর প্রায় নগ্ন বুক।’

যে ব্যক্তি তখনকার অভিজাত সমাজকে পুরোপুরি চিনত তার কাছে ‘এটা একটা অন্তহীন বেশ্যালয়।’ প্রমাণ হিসেবে পজদনীশেভ বলে- ‘যে সব দুর্ভাগা মেয়েদের আমরা ঘৃণার চোখে দেখি, তাদের দিকে চেয়ে দেখুন, তারপর দেখুন সমাজের সর্বোচ্চ স্তরের মহিলাদের; সেই এক প্রসাধন, সেই এক কায়দা, সেই সেন্ট, সেই নগ্ন হাত, কাঁধ আর বুক, হীরে জহরত আর দামী গয়নাগাটির ওপর সেই লোভ, সেই এক আমোদপ্রমোদ, নাচ আর গানবাজনা। পুরুষ পটাবার পদ্ধতি দু’ শ্রেণীর মধ্যে সমান, কোনো হেরফের নেই।’

এসব জেনেও পজদনীশেভ বিয়ে করেছিল। বিয়ের আগে বাগদত্তা স্ত্রীকে পড়তে দিয়েছিল নিজের ডায়েরিগুলো, যেখানে তার প্রথম যৌবনের সমস্ত অন্যায় এবং ব্যভিচারের বর্ণনা আছে। সেগুলো পড়ে খুবই ভেঙে পড়েছিল তার বাগদত্তা। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, তারপরেও বিয়েতে সম্মতি জানিয়েছিল মেয়েটি। বিয়ের কিছুদিন পরেই পজদনীশেভ আবিষ্কার করে, শারীরিক মিলন ছাড়া আর কোনো ভালোবাসার চিহ্ন নেই তাদের দাম্পত্য জীবনে। খুব কষ্টদায়ক আবিষ্কার, কিন্তু এর ব্যতিক্রম তো জানা নেই তাদের। তার তখন এই বোধ জাগ্রত হয়নি যে, মেয়েরা সেভাবেই নিজেদের বিসর্জন দেয়, যেভাবে পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্র চায়। এই অবস্থাতেই তাদের কেটে গেল পনেরো বছর। পাঁচ সন্তানের পিতা-মাতা হলো তারা। সেই সময় আবিষ্কৃত হলো সন্তান না নেবার নিরোধক, যাকে আমরা বলি জন্ম নিয়ন্ত্রণ সামগ্রী।

তখন থেকেই স্ত্রীর মধ্যে একটি পরিবর্তন স্পষ্ট দেখতে শুরু করল পজদনীশেভ। তার ভাষায়- ‘আমার স্ত্রী একেবারে ভরন্ত হয়ে উঠল, চেহারা আরো খুলল, যেন শেষ হেমন্তের মাধুরী। সেটা জেনে আত্মচর্যাটা আরো বেড়ে গেল তার। উগ্র গোছের, লোককে বিচলিত করা গোছের কী একটা ছিল ওর রূপে। তিরিশ বছর বয়স, ভরাট যৌবন, বাচ্চাকাচ্চা আর হয় না। দেখলে মন উচাটন হয়। লোকের মাঝে গেলে সবায়ের দৃষ্টি পড়ে ওর ওপর।’

স্ত্রীর তখনকার মানসিক অবস্থাটাও বুঝতে পারছিল পজদনীশেভ- ‘ওর অবস্থাটা হলো অনেকটা নেশার ঘোর কাটিয়ে উঠে হঠাৎ চারপাশে আনন্দভরা পৃথিবী দেখার মতো, যে পৃথিবীর কথা সে ভুলে গিয়েছিল। ... জীবনের একটামাত্র উদ্দেশ্য সে জানত- প্রেম। সেই প্রেমের জন্য চাঙ্গা হয়ে উঠল আবার। কিন্তু হিংসা আর বিদ্বেষে জীর্ণ স্বামীর সঙ্গে প্রেম নয়। আলাদা গোছের প্রেমের, নতুন ও পূত ধরনের প্রেমের স্বপ্ন দেখতে শুরু করল সে। আর চারিদিকে তাকিয়ে দেখতে লাগল ও, যেন কার প্রত্যাশায় আছে।’

পজদনীশেভের স্ত্রী পিয়ানো বাজানো ছেড়ে দিয়েছিল। আবার শুরু করল বাজানো। এই পিয়ানো বাজানো থেকেই সূত্রপাত ঘটল সর্বনাশের।

আবির্ভূত হলো সেই লোকটি। নাম ত্রুখাচেভস্কি। ভায়োলিন বাদক। নিপাট ভদ্রলোক। কিন্তু যেহেতু একই সমাজের পুরুষ, তাই তার ভেতরটাকে পরিষ্কার দেখতে পায় পজদনীশেভ। পারিবারিক এবং সামাজিক অনুষ্ঠানগুলোতে পরস্পরের দেখা হয় তাদের। তার স্ত্রী’র সাথে পিয়ানো বাজায় কোনো কোনো অনুষ্ঠানে। সাথে ভায়োলিন নিয়ে সঙ্গত করে নতুন লোকটি। তার স্ত্রী এবং ত্রুখাচেভস্কির মধ্যে কথা-বার্তা সব সৌজন্যমূলক, আনুষ্ঠানিক এবং নিরীহ। দুইজনে বাজানোর সময় মাঝে মাঝে একে অপরের দিকে তাকিয়ে সুর বুঝে নেবার ব্যাপার থাকে। কিন্তু সেই তাকানোর মধ্যেও থাকে কথা বিনিময়। সেটি প্রথম পরিচয়ের দিনেই খেয়াল করেছে পজদনীশেভ। ‘দেখলাম, স্ত্রীর দিকে দৃষ্টিপাত করার প্রথম মুহূর্ত থেকেই সমাজ ও শোভনতার সমস্ত আইনকানুন জলে দিয়ে ওদের ভেতরকার সেই পশু জিজ্ঞেস করছে, “কী, হবে নাকি?” আর উত্তর আসছে, “হ্যাঁ, হবে না কেন?”

নিজেকে, স্ত্রীকে, ত্রুখাচেভস্কিকে, এবং তাদের অভিজাত সমাজকে খুব ভালো করে চেনা পজদনীশেভের মনের ভাবটা তখন এই রকম- ‘এই লোকটাকে যে আমার স্ত্রীর পছন্দ হবে তাই নয়, নিঃসন্দেহে লোকটি অক্লেশে জয় করবে তাকে, ধামসাবে, মোচড়াবে, দড়ি পাকাবে, যা খুশি করবে তার সঙ্গে; সেটা করবে বাইরের চাকচিক্য ও অভিনবত্বে, বিশেষ করে সঙ্গীতে তার অসাধারণ দক্ষতায়, একসঙ্গে বাজানোর ফলে যে ঘনিষ্ঠতা হয়, তার জোরে।’

এই নভেলার নাম সেই সঙ্গীতের সূত্র ধরেই ‘ক্রয়টজার সোনাটা’। 

স্ত্রীকে কেন পুরুষ সন্দেহ করে? তলস্তয় জানিয়ে দিচ্ছেন কারণটি মূলত সামাজিক।

পজদনীশেভ অহঙ্কারী পুরুষ। অহঙ্কারের পেছনে যুক্তিটা অদ্ভুত হলেও বাস্তব- ‘অহঙ্কার না থাকলে আমাদের সমাজে বেঁচে থাকার মতো আর কী আছে?’

এই অহঙ্কারের বশেই সে ত্রুখাচেভস্কি এবং তার স্ত্রীর মনোভাব জেনেও তাদের ওঠাবসাতে বাধা দেয় না। তবে ঈর্ষার আগুনে জ্বলতে জ্বলতে অপেক্ষাও করে হাতেনাতে ধরার। একবার সে আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিল। কিন্তু সেখানেও প্রতিশোধের অহঙ্কারই তাকে বিরত রাখে- ‘আত্মহত্যা করা চলবে না, তাহলে তো ও ছাড়া পাবে; ওকেও অন্তত খানিকটা যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে, আমি যে যন্ত্রণা ভোগ করেছি টের পেতে হবে।’ আর সেইসাথে চিরকালীন পুরুষতান্ত্রিক অধিকারবোধ- ‘আমার স্ত্রীর দেহের উপর একচ্ছত্র, অবিসম্বাদিত মালিকানার দাবি আমার, যেন ওটা আমার দেহ।’ তাই কোনো ছাড় নয়।

অবশেষে পজদনীশেভ প্রমাণ করতে পারল তার ধারণা ঠিক। সমাজটাকে সে ভালোমতোই চেনে। তার স্ত্রী এবং ত্রুখাচেভস্কি সত্যিসত্যিই পরস্পরের প্রতি অনুরক্ত। দুই দিনের জন্য অন্য শহরে গিয়েছিল সে। কিন্তু একদিন পরেই বাড়ির পথ ধরল। বাড়িতে যখন এলো তখন প্রায় মাঝরাত। যা সে ধারণা করেছিল, সেটাই দেখল। বাড়িতে ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ড্রয়িং রুমে তার স্ত্রী এবং ত্রুখাচেভস্কি। পজদনীশেভ দরজা খুলল নিঃশব্দে। তাকে দেখামাত্রই দু’জনের মুখের ভাবটি কেমন হয়েছিল? ‘আমাকে দেখার প্রথম মুহূর্তটিতে ওদের মুখের মরিয়া আতঙ্কের সেই ভাবটা জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মনে থাকবে। লোকটা বোধহয় বসেছিল টেবিলের পাশে, কিন্তু আমাকে দেখে বা আমার আওয়াজ পেয়ে লাফিয়ে উঠে আলমারিটার দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়ায়। ওর মুখে ছিল শুধুই বিভীষিকার একটা নিঃসন্দেহ ভাব। আমার স্ত্রীর মুখের ভাবটাও বিভীষিকার। কিন্তু বিভীষিকার সঙ্গে অন্য কিছু ছিল। শুধু বিভীষিকা হলে হয়ত যা ঘটল, তা ঘটত না। ওর মুখে, অন্তত প্রথম সেই মুহূর্তটিতে মনে হয়েছিল, আরো ছিল হতাশার বিরক্তির একটা ছাপ, প্রেম করার সুখে বাধা পড়েছে বলে। ওর সুখে যেন বাধা না পড়ে, এ ছাড়া দুনিয়ায় আর কিছু চায় না সে। মুখভাবটা ক্ষণিক মাত্র। লোকটার বিভীষিকার ভাব কেটে গিয়ে তক্ষুনি এলো জিজ্ঞাসার একটা ভাব; মিথ্যে বলা সম্ভব কি না? সম্ভব হলে এখনি শুরু করতে হবে। সম্ভব না হলে, একটা কিছু ঘটল বলে। কিন্তু সেটা কী? ও আমার স্ত্রীর দিকে তাকাল জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। লোকটার দিকে তাকিয়ে হতাশা ও বিরক্তির ভাবটা কেটে গিয়ে স্ত্রীর মুখে এলো ওর জন্য উৎকণ্ঠার ছাপ।’

ওরা বাজানোর কথা বলতে চাইল। যদিও কোনো বাদ্যযন্ত্র সেখানে ছিল না। ঘরে ঢোকার সময় কোনো যন্ত্রের সুর শোনেনি পজদনীশেভ। কিন্তু কথার চাইতে ওদের দুজনের এই মুখভাবই পজদনীশেভকে উদ্বুদ্ধ করল তার স্ত্রীর হৃদপিণ্ড বরাবর ধারালো ছুরি আমূল বসিয়ে দিতে।

০৪.

প্রকাশের সাথে সাথেই কেন নিষিদ্ধ হয়েছিল ‘ক্রয়টজার সোনাটা’?  

নারীবাদ তখন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল রাশিয়ায়। কিন্তু নারীবাদীরা এই উপন্যাসের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ আনেনি। যারা প্রেম, ভালোবাসা, স্নেহ, মাতৃত্ব, নীতি-নৈতিকতার কথা বলে, তারাও কেউ উপন্যাসের বিরুদ্ধে অনৈকতার অভিযোগ আনেনি। ‘ক্রয়টজার সোনাটা’ নিষিদ্ধ হয়েছিল রাশিয়ার তৎকালীন অভিজাত সমাজের দ্বারা। নিজেদের এমন সত্যিকারের চেহারা দেখা তাদের কাছে ছিল অসহনীয়।

তলস্তয়ের এই নভেলাটির কোনো উল্লেখ যে আমাদের শিক্ষিত সমাজে হয় না, তার পেছনের কারণও সম্ভবত আমাদের উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত সমাজের নারী-পুরুষের নিজেদের সত্যিকারের চেহারা দেখার অনিচ্ছাই।

 

ঢাকা/তারা

রাইজিংবিডি.কম


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়