ঢাকা     সোমবার   ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

ড্রেনেই রুজি খোঁজেন তিনি

মুহাম্মদ নূরুজ্জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৫৮, ১৪ জুন ২০২১   আপডেট: ১০:১৫, ১৪ জুন ২০২১
ড্রেনেই রুজি খোঁজেন তিনি

ড্রেন-নর্দমা থেকে বোতল সংগ্রহ করছেন বৃদ্ধ তাহসেন গাজী 

তার নজর ড্রেনের দিকে। অপলক তাকিয়ে আছেন। কি যেন হারিয়েছেন। খুঁজে ফিরছেন। কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি পেলে ঠোঁটের ইষৎ কোণে ফুটে ওঠে মৃদু হাসির রেখা। না পেলে মুখটি মোলিন। দু’ বছর ধরে এভাবেই চলছে তার খোঁজা-খুঁজির পালা। 

বলছি এক অশীতিপর বৃদ্ধের কথা। যার নাম মো. তাহসেন গাজী। বয়স আশির কোঠায়। বসবাস খুলনা মহানগরের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের লবণচরা এলাকায়।

দেশের বয়োজ‌্যৈষ্ঠ এই নাগরিক কি খোঁজেন ড্রেনে- এ প্রশ্নের উত্তর জানতে রাইজিংবিডি’র এ প্রতিবেদক তার সঙ্গী হন। 

জানা যায়, দারিদ্রতার কাছে হার মেনে ভিক্ষার ঝুলি হাতে না নিয়ে আত্মমর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার নেপথ্যের কাহিনী।  
মূলত: মানুষের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল ড্রেন থেকে তুলে তিনি তা পরিষ্কার করে বিক্রি করেন। আর এ অর্থ দিয়েই চলে তার জীবন-জীবিকা। বয়সের ভারে ন্যূয়ে পড়লেও ড্রেন থেকে সংগৃহিত বোতলের কঠিন বোঝা তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে এখনও। এভাবে তার যৎ সামান্য প্রয়োজন মিটলেও নিজের অজান্তেই তিনি খুলনা নগরবাসীর স্যুয়ারেজ বা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার একটি বড় উপকার করে চলেছেন। যে কাজ খুলনা সিটি কর্পোরেশনের কঞ্জারভেন্সি বিভাগের ওপর ন্যাস্ত।

বৃদ্ধ তাহসেন গাজী জানান, তার জন্ম পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার জোসখোলাহাট-খালবুনিয়া গ্রামে। মৃত. মোমিন গাজীর ২ সন্তানের মধ্যে তিনি বড়। ৫-৬ বছর বয়সে বাবার মৃত্যুর পর ইয়াতিম তাহসেন মা ও সৎ ভাইয়ের সঙ্গে খুলনার পথে পা বাড়ান।

গল্পের শুরু এখানেই। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশু তাহসেনের জীবন সংগ্রামও শুরু হয়। কিছুদিন সৎ ভাইয়ের ঘরে খাবার জুটলেও নিজেকেই কাজের খোঁজে নামতে হয়। কাজের সন্ধানে ভয়ে ভয়ে খুলনার রূপসা মোড়ের তৎকালীন কোকোনাট অয়েল মিলে ঢুকে পড়েন। সেখানেই পেয়ে যান হেলপারের কাজ। বেশ কিছুদিন পর মেশিনম্যান হিসেবে এই মিলেই পার করেছেন কয়েক বছর। বিবাহ-শাদী করে সংসারি হন। দুই ছেলে ও এক মেয়ের বাবা  তিনি।


 স্ত্রী ও ছেলের সঙ্গে তাহসেন গাজী

এরপর মিল বন্ধ হয়ে গেলে তিনি হোটেল ব্যবসা ও দিন মজুরিসহ ছোট-খাটো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে থাকেন। কিন্তু এখন বয়স ও আর অসুস্থতার কারণে পরিশ্রমের কাজ করতে পারেন না।

বড় ছেলে বাবুল গাজীর সঙ্গেই থাকেন তিনি। ছোট ছেলে কাবুল গাজী দেনায় জর্জরিত হয়ে নিরুদ্দেশ। অভাবের সংসারে ঠেলা গাড়ি চালানো ও মাটি কাটা কাজের সঙ্গে যুক্ত বাবুলের সংসারই ঠিকমত চলতে চায়না, তাই বৃদ্ধ মা-বাবাকে চালানো তার পক্ষে কষ্ঠকর।

আর এ কারণেই বৃদ্ধ বাবা তাহসেন গাজী ঘরে বসে বসে খেতে চাননি। লোকলজ্জা ও আত্মমার্যাদার কারণে ভিক্ষার ঝুলিও হাতে নেননি। কিন্তু যা পারেন- যেভাবে পারেন- সৎ পথে কাজ করে তাকে অর্থ উপার্জন করতেই হবে- এ ব্রত নিয়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন। সংগ্রহ করতে থাকেন পথে-ঘাটে, ফুটপাথে-পথের ধারে-ড্রেনে পড়ে থাকা মিনারেল ওয়াটার ও কোমল পানীয়ের প্লাস্টিকের বোতল। বৃদ্ধ বয়সে এসে বিশ্রামের পরিবর্তে এভাবেই শুরু হয় তার নতুন জীবনযুদ্ধ।

তাহসেন গাজীর কাছে এ ধরনের কাজ বেছে নেওয়ার কারণ জানতে চান-এ প্রতিবেদক। জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ, শরীর দুর্বল। কঠিন বা শক্ত পরিশ্রমের কোনো কাজ করতে পারি না। আর অমর্যাদাকর মনে হওয়ায় ভিক্ষাবৃত্তিও করতে পারি না। তাই কষ্ঠের হলেও নিজের স্বাধীনমত এ কাজ করি। যেদিন পারি বের হই, শরীর না চললে বের হই না। কারও কাছে হাত পাতি না।’

তাহসেন গাজী আরও বলেন, ‘২-৩ মাস ধরে এক-দেড়মণ বোতল জোগাড় করতে হয়। পরে তা রূপসা সেতু এলাকায় নিয়ে বিক্রি করি। এতে যে টাকা হয়- তা দিয়ে প্রতি সপ্তাহে ৪শ’-৫শ’ টাকার ওষুধ কিনতে হয়। এছাড়া অন্যান্য খরচ আছে- কে দেবে? তাই কষ্ঠ করে উপার্জন করি।’

তাহসেন গাজীর ছেলে বাবুল গাজী বলেন, ‘তার স্ত্রী ও ৩ ছেলে-মেয়ে নিয়ে ৫ জনের সংসার। এর ওপর মা-বাবা। তার সামান্য আয়ে সবাইকে নিয়ে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। তাই বাবা কষ্ঠ করে কিছু আয় করলেও তিনি তাতে বাধা দেন না।’

বোতল সংগ্রহ শেষে বৃদ্ধ তাহসেন গাজী দক্ষিণ মোল্লাপাড়া ক্ষেত্রখালী খালপাড়ের ইমাম হোসাইন হোটেলে সকালের নাস্তা করেন। কোনদিন পরাটা-ডাল বা রুটি-ভাজি খান। কোনদিন শুধুই পরাটা।

হোটেল মালিক মো. বাবুল রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ড্রেনের ময়লা-আবর্জনার মধ্য থেকে বোতল সংগ্রহ করেন। অনেক কষ্ট করে অর্থ আয় করছেন। কিন্তু তাকে সহযোগিতা করার মত সাধ্যতো আমার নেই। তারপরও অনেক সময় কম মূল্যে তাকে নাস্তা করাই।’

খুলনা সিটি কর্পোরেশনের স্থানীয় ৩১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আরিফ হোসেন মিঠু রাইজিংবিডিকে জানান, বৃদ্ধ তাহসেন গাজী ড্রেন থেকে বোতল তুলে একদিকে নিজে কিছু অর্থ আয় করলেও অন্যদিকে তিনি পয়:নিষ্কাশনে সহযোগিতা করছেন। তিনি কেসিসিতে সাহায্যের জন্য আবেদন করলে সুপারিশ করে দেবেন বলে জানান।

খুলনা/নূরুজ্জামান/বুলাকী

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়