ঢাকা     রোববার   ১৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  অগ্রহায়ণ ২৯ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

ক্যারিয়ার ও জীবন ধ্বংস করছে সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি 

মো. সোহান হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:২৫, ২২ জুন ২০২৪  
ক্যারিয়ার ও জীবন ধ্বংস করছে সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি 

একটা সময় মানুষ একে অপরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করতো। পরবর্তীতে চিঠিপত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ শুরু হলো। চিঠিপত্রের যোগাযোগের বাধা দূরীকরণের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতির আবিষ্কার হয় এবং সেখানে যোগাযোগের বিভিন্ন উপকরণ আবিষ্কার হয়। পরবর্তীতে সোশ্যাল মিডিয়া নামে এক মিডিয়ার আবিষ্কার ঘটে। এতে যোগাযোগের ব্যয় কমেছে, সময় বেঁচেছে এবং অল্প সময়ে দ্রুত গতিতে তথ্য সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে।

বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া বলতে ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ইত্যাদিকে বোঝায়। এর মধ্যে ফেসবুক জনপ্রিয়তার শীর্ষে আছে। শিশু থেকে বয়স্ক- সবাই এর প্রতি আসক্ত। দিনের শুরু হয় ফেসবুক দিয়ে এবং শেষও হয় ওই ফেসবুক দিয়েই। বর্তমানে যুব সমাজের মধ্যে মাদকের মতো বেড়েছে ফেসবুক আসক্তি।

ফেসবুকে কে কি পোস্ট দিয়েছে, কে কমেন্ট করছে, কে কি রিঅ্যাক্ট দিয়েছে- এসব দেখে দিনের সূচনা ঘটে। আবার কেউ কেউ সব কাজকর্ম ফেলে রাখে সারাদিন ফেসবুকে পড়ে থাকে। যেখানে অকার্যকর ভিডিও দেখে নষ্ট হচ্ছে মানুষের মূল্যবান সময়। এসব ভিডিও’র বেশিরভাগেই বিভ্রান্তমূলক তথ্য তুলে ধরা হয়, যা দেখে নারী-পুরুষের মধ্যে তৈরি হয় নতুন এক ভার্চুয়াল জগত। অনেকেই আবার এসব ভিডিও দেখার মাধ্যমে নিজেকে ভার্চুয়াল জগতের একজন মনে করেন। যখন তারা বাস্তব জীবনের সঙ্গে মিলাতে যান, তখন অনেক পার্থক্য দেখতে পান। ফলে নষ্ট হয় স্বাভাবিক মানসিকতা, পারিবারিক বন্ধন, সামাজিক মর্যাদা।

যখন একজন ছেলে বা মেয়ে ফেসবুকে বিভিন্ন রিলস্ ভিডিও দেখেন, তার মধ্যে অন্যরকম উত্তেজনা কাজ করে ।সেই ভিডিও থেকে অনেকেই ভিডিও তৈরি করার আগ্রহ পায়। নিজের পড়াশোনা, কাজকর্ম সবকিছু বাদ রেখে এতে লেগে পড়ে। কয়েকদিন ভিডিও করার পর বুঝতে পারেন, আসলে এর তেমন কোনো মূল্য নেই। ততক্ষণে সময় নষ্ট হয়ে গেছে, অন্যরা তার থেকে এগিয়ে গেছে। আবার অনেক মেয়ে যখন ফেসবুকের এই সৌখিন জীবন নিজের জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে চায়, তখন নিজের বাবার বাড়িতে কিছুটা প্রয়োগ ঘটাতে পারলেও স্বামীর বাড়িতে পারেন না। এতেই ঘটে বিপত্তি। শ্বশুর-শাশুড়ি ও স্বামীসহ সবার সঙ্গে তৈরি হয় মতের অমিল। একপর্যায়ে সেটা বিচ্ছেদ পর্যন্ত গড়ায়।

সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে ফলে তৈরি হচ্ছে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তর ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ। অপরিচিত নারী-পুরুষের মধ্যে তৈরি হয় অনৈতিক প্রেমের সম্পর্ক, পরকীয়া সম্পর্ক। সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারী নিউজ ফিড দেখতে দেখতে নিজেকে বোর ফিল করে অনেক সময় অপরিচিত ব্যক্তিকে কথা বলার জন্য এসএমএস দিয়ে থাকে। এই এসএমএস এর উত্তর দিতে গিয়ে সম্পর্কের সূত্রপাত হয়। ফলে ধ্বংস হচ্ছে হাজারো পরিবার, নষ্ট হচ্ছে সবার সঙ্গে মেলবন্ধন ও পারিবারিক সম্মান। 

এছাড়া সবসময় ফেসবুক ব্যবহারের কারণে এক ধরনের আসক্তি তৈরি হয়। এতে ক্যারিয়ার থেকে তারা অনেক দূরে সরে যায়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেককেই ক্লাসরুমে স্যারের লেকচার না শুনে সোশ্যাল মিডিয়াতে সময় কাটাতে দেখা যায়। একটা সময় পড়াশোনায় একদমই মনোযোগ থাকে না এবং পরীক্ষার রেজাল্ট ক্রমাগত খারাপ করতে থাকে। পরবর্তীতে চাকরি পরীক্ষাতেও ভালো ফলাফল করতে পারে না, যা ওই শিক্ষার্থীকে বেকারত্বের দিকে নিয়ে যায়। 

আবার পেনসিলভানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, সোশ্যাল মিডিয়ার বেশি ব্যবহার একাকিত্বের অনুভূতি হ্রাস করার পরিবর্তে আরও বৃদ্ধি করে। ব্যক্তিগত সম্পর্কের তুলনায় সোশ্যাল মিডিয়াকে বেশি প্রাধান্য দিলে তত বেশি উদ্বেগ এবং বিষণ্নতার মতো মানসিক ব্যাধিগুলো নিজের অজান্তেই বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ। এতে যুবসমাজের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। অনেকে আবার এতো পরিমাণে আসক্ত যে, সোশ্যাল মিডিয়াকে তাদের জীবন মনে করছেন‌। 

বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর একটি বড় অংশেরই বয়স ১৮-এর নিচে। এ বয়সী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া বেশ শক্তিশালী প্রভাব রাখতে সক্ষম। যুক্তরাজ্যে ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের ওপর ২০১৯ সালে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে তিনবারের বেশি সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা ধীরে ধীরে কমছে। মোট ১২ হাজার জনের ওপর এই গবেষণা করা হয়।

২০১৬ সালে এমআইটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘন ঘন উপস্থিতির ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গুরুতর বিষণ্নতা ৭% এবং উদ্বেগজনিত ব্যাধি ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে।

গ্লোবাল ডেটা ফার্ম স্ট্যাটিস্টার তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৪ কোটি ৪৭ লাখ। মোট ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে দশম। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৬৫ লাখ ৪৮ হাজার ৩০০ জন। ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ কোটি ৩৯ লাখ ৫৫ হাজার ১০০ জনে। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে ১ কোটি ৭৪ লাখ ৬ হাজার ৮০০ জন।

নেপোলিয়ন ক্যাটের তথ্য বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে ফেসবকু ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬ কোটি ৩৯ লাখ ৫৫ হাজার ১০০ জন। যা দেশের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশেরও বেশি। এর মধ্যে ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী ব্যবহারকারী ৩ কোটি ১৪ লাখেরও বেশি। তাদের মধ্যে পুরুষ ২৯.১ শতাংশ এবং নারী ২০ শতাংশ। আর ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের মধ্যে ২১.৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৯.৫ শতাংশ নারী।

উপরোক্ত গবেষণা থেকে দেখা যায়, শিশু থেকে শুরু করে পূর্ণবয়স্ক সবাই এখন ফেসবুক আসক্তির মধ্যে আছেন। সেখান থেকে পরিত্রাণ না হলে ধ্বংস হতে পারে হাজার হাজার মানুষের জীবন। মহামারীর পর থেকে মানুষের মধ্যে বেড়েছে আবেগপ্রবণতা। যেখানে মানুষ চাকরি বা ক্যারিয়ারের উপর প্রাধান্য না দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ার উপরে সব থেকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে।

ফোনের অবাধ ব্যবহারের কারণে বাড়ছে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা এবং অল্প বয়সেই তৈরি হচ্ছে আসক্তি, যা কমিয়ে দিচ্ছে অন্যান্য কাজের প্রতি মনোযোগ। দীর্ঘমেয়াদী কোনো কাজের প্রতি আসক্তি ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। যেটা দেশ ও জাতির জন্য অকল্যাণকর। তাই পরিবারের বড়দের উচিত নিজেরা ফেসবুকের আসক্তি কমিয়ে আনা ও অন্যান্যদের এ বিষয়ে সচেতন করা।

লেখক: শিক্ষার্থী, ট্যুরিজম  অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়

/মেহেদী/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়