ঢাকা     শনিবার   ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ||  পৌষ ৫ ১৪৩২

Risingbd Online Bangla News Portal

দুঃসাহসিক প্রাবন্ধিক ড. আহমদ শরীফ

শহীদুল ইসলাম (শুভ) || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:১৫, ২৩ জুন ২০২৪   আপডেট: ১৮:১৭, ২৩ জুন ২০২৪
দুঃসাহসিক প্রাবন্ধিক ড. আহমদ শরীফ

আহমদ শরীফ (১৯২১-১৯৯৯) একজন ভাষাবিদ, খ্যাতনামা মনীষী এবং বিংশ শতাব্দীর শেষভাগের অন্যতম প্রতিভূ। তিনি শৈশব থেকেই পরিবার প্রযত্ন পেয়েছেন। সাহিত্য ও জ্ঞানচর্চার ঋদ্ধ পরিবেশ পেয়েছেন।

তার জ্ঞান অভিলাষী চেতনা জগতের পথ প্রদর্শক আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য ও প্রেরণায় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মুসলিমদের অবদান, কৃতিত্ব ও গৌরবের উপর বিপুল তত্ত্ব সমৃদ্ধ গবেষণা করেছেন। এ গবেষণা তাকে দিয়েছে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্থায়ী অভিধা। তবে সমসাময়িক সাহিত্য, সাহিত্য-ব্যক্তিত্ব, সাহিত্যচর্চা, শিক্ষানীতি ও ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তার মূল্যায়ন বিশেষ গুরুত্ববহ। কারণ তীক্ষ্ণ সমাজচেতনা ও রাজনীতিবোধ আহমদ শরীফের ভাবনায় প্রাধান্য পায়।

পঞ্চাশের দশকে মহান ভাষা আন্দোলন পরবর্তীকালে বাঙালির ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার গ্রহণ-বর্জন প্রশ্নে জাতীয়তাবোধের স্ফটিকায়ন, দেশ-রাজনীতি ও সমাজ চেতনা তাকে আগ্রহী করে তুলেছিল জাতীয় সাহিত্য ও ভাবনা নির্মাণের গতিপথ অনুসন্ধানে। পরবর্তী অর্ধ-শতাব্দীকাল তিনি বিপুল মননশীল প্রবন্ধ রচনা করেছেন।

তার প্রত্যেকটি প্রবন্ধে তিনি তুলে এনেছেন পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, ধর্মনীতি, জাতীয়তাবাদ, শিক্ষা। বাংলা সাহিত্যের প্রবন্ধে আহমদ শরীফ ভিন্নমাত্রার সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।

আহমেদ শরীফ ব্যক্তি জীবনে কোনো ধর্মীয় অনুশাসন মান্য করতেন না। ধর্মীয় অনুশাসনের প্রতি তার কোন আস্থা ছিল না। ধর্মকেন্দ্রিক জীবন ভাবনার বৃত্ত থেকে তিনি বেরিয়ে এসেছিলেন এবং নিজেকে নাস্তিক বলে দাবি করেছেন। তবে তিনি সারাজীবন ধর্মকেন্দ্রিক জীবন প্রতিবেশের মধ্যে বাস করেছেন।

ধর্মের বিশ্বব্যাপী অবস্থান ও সভ্যতার বিকাশে ধর্মের অবদান নিয়ে অধ্যাপক আহমদ শরীফ মাথা ঘামাতেন না। কতগুলো জিজ্ঞাসার আলোকে প্রথানুগত বিশ্বাসের সংগঠনের তথা ধর্মের অন্তঃসারশূন্যতা দেখাতে চেষ্টা করতেন। মনের মধ্যে লালিত দ্বিধা ও সংশয়কে তিনি যুক্তির আলোকে বের করে আনার চেষ্টা করতেন। তিনি তার স্বনির্মিত যৌক্তিক ছকের মধ্যে ঈশ্বর, ধর্ম, ধর্মগ্রন্থ, ধর্মবিশ্বাসীকে টেনে এনে মীমাংসায় অবতীর্ণ হতেন। তার যৌক্তিক ছকের মধ্যে বিশ্বাস বা ধর্মের কোনো অবস্থান ছিল না। তাই তিনি ধর্মীয় উপাখ্যানগুলো নিয়ে যুক্তিশাস্ত্র সম্মত প্রশ্ন উপস্থাপন করতেন।

বিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার প্রবর্তন ও পূর্বতন ধর্মবিশ্বাসের উপাখ্যানকে তছনছ করে দিয়েছে। ফলে উপাখ্যানগুলোকে বর্তমান যুগের ধার্মিকেরা সাংকেতিক অর্থে গ্রহণ করে পরিতৃপ্ত থাকে। আহমদ শরীফ এসব ধর্মীয় উপাখ্যানগুলোকে আক্ষরিক অর্থে ব্যাখ্যা করতেন। ফলে উপাখ্যানগুলোর মৌল সংগঠন অটুট থাকত না।

নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমি জাত, ধর্ম, বর্ণ, নিবাস ভাষা প্রভৃতি কোনো কিছুর মূল্য ও পরিচিতি স্বীকার করি না। মানুষ হওয়াই লক্ষ মনে করি এবং এজন্য আজ অবধি তিনটি পন্থার যেকোনো একটি গ্রহণীয় বলে মনে করি। ১. স্রষ্টা স্বীকার করেও শাস্ত্র না মানা, ২. নাস্তিক হওয়া, ৩. কমিউনিস্ট বা সাম্যবাদী কিংবা ইহজাগতিক সর্বপ্রকার পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রিক ভাবনাচিন্তা কর্ম আচরণে সেক্যুলার হওয়া।’

আহমদ শরীফ সম্পর্কে ড. হুমায়ুন আজাদ বলেন, ‘ড. আহমদ শরীফ ছিলেন বোশেকের দুপুরের রোদের মতো সুস্পষ্ট মানুষ। তিনি নিজের চারপাশে সন্ধ্যার আলো-আঁধারি সৃষ্টি করে তৈরি করতে চাননি নিজের রহস্যময় ভাবমূর্তি, মাথার চারপাশে তৈরি করেননি কোন জ্যোতিশ্চক্র। তিনি মেজাজে ছিলেন প্রচণ্ড, নিজেকে প্রকাশ করতেন তীব্রভাবে চেতনায়। তিনি ছিলেন প্রগতিশীল, ব্যক্তি স্বতন্ত্রবাদী, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন, অতীত প্রথা ও ধর্মবিমুখ।’

অদৃষ্টবাদকে তিনি মানব জীবনের সবচেয়ে বড় ব্যাধি ও চরম শত্রু গণ্য করেছেন। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষকে তিনি দেখেছেন অদৃষ্টবাদের গ্রাসে অসহায়। সেই সঙ্গে তিনি লক্ষ্য করেছেন আধিপত্যবাদী ও শোষণবাদীরা নিজেদের কর্তৃত্ব ও ঐশ্বর্যের তাগিদে গণমানুষের মধ্যে অদৃষ্টবাদ প্রতিষ্ঠিত রাখতে তৎপর। আহমদ শরীফের মতে অদৃষ্টবাদের প্রধান অবলম্বন অলৌকিকে বিশ্বাস।

তিনি বলেন, ‘জ্ঞানের অনুপস্থিতিতে বিশ্বাসের জন্য। বন্ধ্যা মানেই বিশ্বাসের লালন, যুক্তিহীনতায় বিশ্বাসের বিকাশ। কাজেই যুক্তি দিয়ে বিশ্বাসকে প্রতিষ্টিত করার চেষ্টা পুতুলে চক্রবর্তী বসিয়ে দৃষ্টিশক্তি দানের অপপ্রয়াসের ওই নামান্তর।’ (বাঙালির মনন বৈশিষ্ট্য)

বাঙালি দৈশিক জাতীয়তায় দীক্ষিত হয়নি, গ্রহণ করেছে ধর্মীয় জাতীয়তা। জাতীয়তা বাঙালির কাছে স্থান-কালহীন স্বধর্মীর সংহতি মাত্র। এ প্রসঙ্গে আহমদ শরীফ বলেন, ‘য়ুরোপ দেখলো রাষ্ট্রিক জাতীয়তা আর নিজেদের জন্য কামনা করলো ধর্মীয় জাতিসত্তা। তাই বাঙ্গালী হিন্দু শিক্ষিত হয়ে হিন্দু হয়েছে, মুসলিম হয়েছে মুসলিম- কেউ বাঙালি থাকেনি।’ (বাঙালির মনন বৈশিষ্ট্য)

ড. শরীফের মতে যাদের নীতিজ্ঞান কেবল ধর্ম বিশ্বাসের উপর নির্ভরশীল, তাদের নৈতিক ভিত্তি ভয় ও বেহেস্তের লোভে সৎ হওয়ার চেষ্টা করেন। আহমদ শরীফ দার্শনিক ইবনে রুশদ'র মতো মনে করতেন যে, মানুষ সৎ ও ন্যায়পরায়ণ হবে নিজের আনন্দ অনুভবের জন্য, কল্পিত ঈশ্বরের আদেশে নয়।

আহমদ শরীফের এমন দুঃসাহসিক প্রবন্ধ একজন চিন্তাশীল, মননশীল, সৃজনশীল ব্যক্তিকে আকৃষ্ট করে একটি ভিন্ন জগতে প্রবেশ করায়। তিনি মনে করেন জ্ঞান, বুদ্ধি ও প্রজ্ঞা প্রয়োগেই বিদ্যার সার্থকতা। শিক্ষা সার্থক হয় জীবনযাত্রায় তার রূপায়ণে। তিনি বলেন, ‘যা জানা যায় তাই জ্ঞান, যা জানতে হয় তাই বিদ্যা, আর যা শেখা বা শেখানো হয় তাই শিক্ষা। যে জ্ঞান তাৎপর্য বিরহী, তা বন্ধ্যা।’ (বিদ্যার ক্রমবিকাশ ও নারীশিক্ষা)

সেক্যুলারিজম নিয়ে কেউ সরাসরি কথা বলেনি। আহমদ শরীফ এমন ব্যক্তি, যিনি তার প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন। তার সাহিত্য ভাবনা গণমানুষ, সেক্যুলারিজম এবং মানবতাবাদ- এ তিনটি আদর্শিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। তলস্তয়ের মতো সাহিত্যের সর্বজনীনতা তাকে আকৃষ্ট করেছে; সর্বমানবিকা ও আন্তর্জাতিকতা হয়েছে তার পাথেয়। তার সাহিত্যভাবনা শুরু থেকেই উপযোগবাদ এবং শ্রেয়োগচিন্তার সম্মিলন।

মার্কসবাদ আহমদ শরীফের প্রেরণা ঔশক্তি হিসেবে কাজ করেছে সর্বত্র, কিন্তু তিনি কখনো সেখানে বাধা পড়েননি। তাই সাম্প্রদায়িকতা ও স্বাতন্ত্রের নামে ভেদ-বুদ্ধির সাহিত্য তিনি বর্জনীয় মনে করেছেন। 

নানান বিষয়ে আহমদ শরীফ প্রবন্ধ লিখেছেন। অন্ধ ধর্মের প্রতি তার কোনো আস্থা ছিল না। প্রবন্ধে তিনি তুলে ধরেছেন নানান অসঙ্গতি, অন্ধ বিশ্বাসকে করেছেন কোণঠাসা। তাই তার প্রবন্ধ শুধু সাহসী নয় বরং দুঃসাহসী।

লেখক: শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
 

/মেহেদী/

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়