ঢাকা     রোববার   ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৫ ১৪৩১

আড়াই বছরে এনটিআরসি’র আয় ২০০ কোটি টাকা, নিয়োগ শূন্য

আবু বকর ইয়ামিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৪, ২৪ জুন ২০২১   আপডেট: ১৮:০৮, ২৪ জুন ২০২১
আড়াই বছরে এনটিআরসি’র আয় ২০০ কোটি টাকা, নিয়োগ শূন্য

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন চাকরিপ্রার্থীরা। ২০১৮ সালে নিয়োগের পর গত আড়াই বছরে কোনো নিয়োগ কার্যক্রম শেষ করেনি বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ)। তবে এ সময়ের মধ্যে আবেদন ফি বাবদ ২০০ কোটি টাকার বেশি আয় করেছে প্রতিষ্ঠানটি। 

বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এনটিআরসিএ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তির মাধ‌্যমে নিয়োগ সম্পন্ন করার পর দীর্ঘ আড়াই বছরে আর কোনো নিয়োগ দিতে পারেনি। এই আড়াই বছরে ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধনের আবেদন ফি বাবদ প্রায় ৩১ কোটি, ১৬তম শিক্ষক নিবন্ধনের আবেদন ফি বাবদ ৪১কোটি, ১৭তম শিক্ষক নিবন্ধনের আবেদন ফি বাবদ প্রায় ৪১ কোটি এবং সর্বশেষে তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তিতে চূড়ান্ত নিয়োগের জন্য আবেদন ফি বাবদ প্রায় ৯০ কোটি টাকা পেয়েছে এনটিআরসিএ। কিন্তু এ সময়ের মধ্যে নতুন করে কাউকেই নিয়োগ দেওয়া হয়নি।

সারা দেশে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শূন‌্য পদের বিপরীতে এন্ট্রি লেভেলের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া এনটিআরসিএর কাজ। শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রার্থীদের প্রিলিমিনারি, লিখিত, মৌখিক পরীক্ষায় পাস করে জাতীয় সম্মিলিত মেধা তালিকায় স্থান পেতে হয়। নিয়োগের জন্য গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদন নেওয়া হয়। চূড়ান্ত ধাপে মেধাতালিকা অনুসরণ করে প্রত্যেকটি শূন‌্য পদের বিপরীতে একজনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়।

শিক্ষক নিয়োগের দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তির কাজ সমাপ্তির আড়াই বছর পর প্রতিষ্ঠানটি তাদের শিক্ষক নিয়োগ কার্যক্রমের ধারাবাহিক কাজের অংশ হিসেবে গত ৩০ এপ্রিল ৫৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগের গণবিজ্ঞপ্তি  প্রকাশ করে। ৩ মে পর্যন্ত চূড়ান্ত আবেদন নেয়। দ্বিতীয় গণবিজ্ঞপ্তির পর চূড়ান্ত আবেদনের অল্প সময়ের মধ‌্যেই চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হলেও আইনি জটিলতায় তা নিয়োগ দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে নিয়োগ প্রার্থীরা বলছেন, এ মামলা সংক্রান্ত জটিলতা অনেক পুরনো। এছাড়া, এনটিআরসিএর কিছু তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত ও মামলাগুলোকে অবহেলা করার জন্য এ অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এনটিআরসিএ বলছে, তারা হাইকোর্টের একটি আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করবে, তার পর ফল প্রকাশ করবে। এরকম বক্তব্য তাদের কাছ থেকে বহুবার পাওয়া গেছে। বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে কালক্ষেপণ করা যেন তাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নিয়োগ প্রার্থী বলেন, ‘এনটিআরসিএ যেহেতু মামলা সংক্রান্ত জটিলতার মধ্যেই গণবিজ্ঞপ্তি দিয়েছে, আবেদন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে, তাহলে ফল দিতে পারছে না কেন? হাজার হাজার টাকা দিয়ে আবেদন করে এসব অসহায় নিবন্ধিত শিক্ষকরা আর ধৈর্য ধরতে পারছেন না। তারা মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে রিটকারীদের দোষারোপ করে। কিন্তু আবার কোনো মামলায় জিততেও পারে না।’

আরেক প্রার্থী শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘এই অসহায় বেকারদের কাছ থেকে ২০০ কোটি টাকা আয়ের বিপরীতে নিয়োগ দিয়েছে কয়জনকে? তাহলে তাদের কাজ কী? তারা অফিসে করে কী? শিক্ষা মন্ত্রণালয় কি তাদের ইনকাম করার জন্য বসিয়ে রেখেছে? মন্ত্রণালয় চুপ কেন? বেকারদের সাথে এরকম অমানবিকতা ও নিষ্ঠুরতা দেখার কী কেউ নেই এই দেশে?’

এনটিআরসিএর নিয়োগ প্রক্রিয়ার কিছু দিক হচ্ছে—বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর স্কুল বা কলেজ ক্যাটাগরিতে প্রার্থীরা আবেদন করেন। একটি আবেদনের ফি ৩৫০ টাকা। চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর অর্থাৎ জাতীয় মেধাতালিকায় স্থান করে নেওয়ার পর আবার নিয়োগের জন্য নতুন করে আবেদন করতে হয়। এতে প্রত্যেক শূন‌্য পদের বিপরীতে আবেদন ফি দিতে হয় ১০০ টাকা। এক্ষেত্রে একজন চাকরিপ্রার্থী তার বিষয়ে সারা দেশে যতগুলো শূন‌্য পদ থাকবে সবগুলোর জন‌্য আবেদন করতে পারবেন।

শাহজালাল নামের এক চাকরিপ্রার্থী বলেন, ‘একটি পদে নিয়োগের জন্য প্রার্থীদের প্রথমে আবেদন ফি বাবদ ৩৫০ টাকা এবং পরে একটি পদে চাকরি নিশ্চিত করার জন্য শূন্য পদভেদে সারা দেশে ২৫০-৩০০ পদে আবেদন করতে হয়। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ২৫-৩০ হাজার টাকা। অনেক প্রার্থীকে দেখা যায় ৫০-৬০ হাজার টাকারও আবেদন করে। যা নিবন্ধনধারীদের জন্য অনেক কষ্টের। সব চাকরিতে তো একবারই আবেদন ফি নেওয়া হয়। তাহলে এনটিআরসিএ-তে ব্যতিক্রম কেন?’

তিনি আরও বলেন, ‘সাধারণ প্রার্থী হিসেবে বলতে চাই, আমরা প্রিলি, রিটেন ও ভাইভা পাস করে হাজার হাজার টাকা খরচ করে নিয়োগের জন্য আবেদন করেছি। আর আমরা ধৈর্য ধরতে চাই না। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। পরিবার ও সমাজে নিগৃহীত হচ্ছি চরমভাবে। বেকারদের সাথে তামাশা আর দেখতে চাই না। অতি দ্রুত ফল প্রকাশ করে আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠাগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হোক।’

এনটিআরসিএ’র সব কার্যক্রম প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও জবাবদিহিতার আওতায় আনার দাবি জানান শাহজালাল। 

রাশেদুল ইসলাম নামের এক প্রার্থী বলেন, ‘শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা, দক্ষ ও মানসম্মত শিক্ষক তৈরি এবং শিক্ষাক্ষেত্রের ব্যাপক উন্নয়নের সঙ্গে এনটিআরসিএর কার্যক্রম প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাই এ প্রতিষ্ঠানকে সবার কাছে জনপ্রিয় ও বিশ্বস্ত করে তুলতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘সারা দেশের বেকার যুবকদের একটা বড় অংশের এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ আছে। মেধাবী ও দক্ষ শিক্ষকদের আকৃষ্ট করতে এনটিআরসিএ-কে যুগোপযোগী, স্বচ্ছ ও সক্রিয় প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা অত্যন্ত জরুরি বলে আমরা মনে করি। তা না হলে ভবিষৎ প্রজন্ম ও মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশার প্রতি আগ্রহ হারাবে। এর ফলে দেশ ও জাতি উভয়েই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

এ বিষয়ে এনটিআরসিএর সচিব ড. এটিএম মাহবুব-উল করিম বলেন, ‘বেকারদের কষ্ট আমরা বুঝি। কিন্তু বর্তমানে যারা এ পরিস্থিতি তৈরি করে রেখেছে, তাদের জন্যই মেধাবী নিয়োগ প্রার্থীদের কষ্ট করতে হচ্ছে। আমরা আশা করছি, আগামী ২৭ জুন হাইকোর্টের রায় এনটিআরসিএর পক্ষে হবে। আমরা প্রকৃত মেধাবীদের দ্রুত নিয়োগ দিতে পারব।’

ইয়ামিন/রফিক

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়