ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

ঘরে ঘরে দুর্গা গড়ে তোলো

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২২, ২৩ অক্টোবর ২০২০   আপডেট: ১৪:৩১, ২৩ অক্টোবর ২০২০
ঘরে ঘরে দুর্গা গড়ে তোলো

এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আঙ্গিকে ভিন্ন বিশ্ব বাস্তবতায় উদযাপন হবে শারদীয় দুর্গাপূজা। পূজার আমেজ কবেই সর্বজনীন হয়ে এর নাম পাল্টে দিয়েছে। এখন আমরা বলি- শারদ উৎসব। শারদ উৎসব যে বলি, এর কারণ কী? কখন একটি সম্প্রদায়ের উৎসব সবার হয়ে ওঠে? কীভাবে তা হয়? ঈদ-উল ফিতর যেমন আমাদের দেশে সবার উৎসবে পরিণত হয়েছে তেমনি দুর্গাপূজাও সেই কবে রূপ লাভ করেছে শারদীয় উৎসবে।

এর সঙ্গে সাহিত্য, সংস্কৃতি শিল্প যোগ হওয়ায় উৎসব হয়েছে সর্বজনীন। পূজা সংখ্যাই ছিল তখনকার সাহিত্যের অন্যতম অবলম্বন। আমরা যদি এই উৎসবকে ‘বাঙালির উৎসব’ বলি তাহলে বাংলা ভাষায় যা প্রকাশ হয় বা করা হয় সেটাই এখানে বিবেচ্য। তাই অনিবার্যভাবেই দেশ, আনন্দবাজার, সানন্দা থেকে আনন্দলোক-এর কথা চলে আসে। আমাদের মনে পড়ে, বিখ্যাত বহু লেখকের কথা। যাঁদের জন্ম হয়েছে এই শারদীয় সংখ্যার গর্ভে। ধীরে ধীরে তার প্রভাব পড়েছে আমাদের বাংলায়। যারা আমাদের দেশ ও সমাজে খালি সাম্প্রদায়িকতা আর ধর্মান্ধতা দেখেন তাদের বলি, পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয় কোনো সংবাদপত্রে ঈদসংখ্যা বলে কিছু আছে কিনা তা আমার জানা নাই। কিন্তু আমাদের বাংলার প্রায় সবগুলো সংবাদপত্র সাময়িকী পূজার সময় কোনো না কোনোভাবে এই উৎসবের মেজাজ ও চেতনার সঙ্গে মিলে বিশেষ সংখ্যা বাজারে আনে। সে সংখ্যাগুলো কি কেবলই পূজার বন্দনা আর মন্ত্র ইত্যাদিতে ভরা? বরং এর ভেতরে থাকে বহু গবেষণালব্ধ লেখা ইতিহাস ও আলেখ্য। বাংলাদেশের শারদীয় উৎসব অনেক আগেই ঢুকে গেছে আমাদের অন্দর মহলে।

আরো যে বিষয়গুলো বাঙালিকে যুক্ত করে তার ভেতরে আছে আনন্দ উৎসব। হিন্দু ধর্মের উৎসবগুলোর একটা বড় সুবিধার দিক এতে প্রবেশাধিকার বা আনন্দ অংশগ্রহণে কোনো সীমাবদ্ধতা নাই। যার ইচ্ছা সেই অংশ নিতে পারে। মণ্ডপে মণ্ডপে আপনি দেখবেন সর্বধর্মের তারুণ্যের ভিড়। তাদের নাচ গান আর স্বপ্রাণ অংশগ্রহণ পাঁচদিন এই উৎসবকে করে রাখে জমজমাট। মাঝে মাঝে এমনও হয়, যাদের পূজা তারা কেউ নাই মণ্ডপ আগলে পাহারা দিয়ে রাখছে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ। এই ঐক্য আর সম্প্রীতিই আমাদের মেলবন্ধন।

আমি বিদেশে আসার আগে ভাবতাম- জীবন হয়তো কেটে যাবে; থাকবো তাদের মতো করে। কোথায় পাবো বাঙালি খাবার, কোথায় মিলবে বাঙালি পোশাক আর উৎসব? জেনে নিশ্চয়ই অবাক হবেন না, দুনিয়ার প্রায় সব দেশে বাঙালিরা আছে বাংলানন্দে। বাংলা নামের আনন্দ তাদের সঙ্গী। সিডনিতে খুব বেশি বাঙালি থাকেন না। ধারণা করি লাখ খানেকের কম। তার ভেতরেও পূজার আনন্দ জমজমাট। আমি যখন এলাম তখন দুই থেকে তিনটি পূজা হতো। তাও একদিনের জন্য। আর এখন ডজনেরও বেশি পূজা। এর ভেতর কারো কারো পূজার মেয়াদও পাঁচদিন। কী হয় না? শারদীয় পূজার সাময়িকী, বার্ষিকী থেকে গান নাচ আরতি সব এমনভাবে হয় যে আপনি বুঝতেই  পারবেন না কোথায় আছেন। এটাও ব্যাপার যে, আর্থিক স্বচ্ছলতা একটি বড় বিষয়। যেহেতু এখানে তা আছে তাই জৌলুসও বেশি।

দেশের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়ে বাঙালির শারদ উৎসব হয় কোনো দেশে শীতকালে, কোথাও বসন্তে, কোথাও-বা প্রচণ্ড গরমে। কিন্তু শারদ উৎসবের আমেজ একটুও ম্লান হয় না। এবারের কথা বলছিলাম, এই করোনাকালে বিদেশে যেখানে হাজার ডলার জরিমানার ভয়, যেখানে আইন কঠোর। নিয়ম না মানলে শাস্তি নিশ্চিত, সেখানে এবারও কিন্তু মহা আগ্রহে উদযাপন হবে দুর্গাপূজা- কোথাও মন্দিরে, কোথাও স্বাস্থ্যবিধি মেনে, নিজেদের পছন্দের অডিটরিয়ামে। করোনার কঠিন সময়ে সবাই যখন ভাবছিলেন আদৌ পূজা হবে কিনা, তখন সব হিসাব নিকেশ বদলে দিয়ে পূজার আগমনী বাজছে প্রবাসী বাঙালির দুয়ারে।

দেশের পূজায় এবার সর্বোচ্চ সতর্কতা ও স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে বাংলার নারীরা ভালো নেই। তাদের জীবন আজ দস্যুদের কারণে, লোলুপ মানুষদের কারণে ঘরে-বাইরে অসহায়। এতো ধর্ষণ, এতো শ্লীলতাহানী আগে দেখিনি আমরা। গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে কোথাও ভালো থাকতে পারছে না আমাদের মা-বোনেরা। এমন সময় দুর্গাপূজা মানে শক্তির আরাধনা। সেই কবে আমাদের জাতির জনক বলেছিলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।’ আজ সে-কথার রেশ ধরে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে- ঘরে ঘরে দুর্গা গড়ে তোলো। সেই দুর্গা যে সর্বংসহা কিন্তু অসুর বিনাশে সংকল্পবদ্ধ। যিনি ত্রিনয়নী। যাঁর এক নয়নে ভরসা, এক নয়নে স্নেহ-ভালোবাসা আর ললাটের নয়নে আছে তেজ। সে তেজরশ্মি জ্বালিয়ে ছারখার করে দিক অসুরের অশুভতা। বাংলার নারীদের সহায় ও শক্তি হয়ে উঠুন দেবী দুর্গা।

জীবন ও মানুষের কল্যাণে নিবেদিত হোক এবারের শারদীয় উৎসব। আমরা যেন করোনামুক্ত হয়ে সবাই মিলে বলতে পারি: তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে...।

সিডনি, ২০ অক্টোবর, ২০২০

আরো পড়ুন:

* অপরাজিতা পুষ্পে অপরাজিতার অর্চনা ॥ বিপ্রদাশ বড়ুয়া
* দুর্গাদেবীর উৎস সন্ধানে || অজয় রায়
* দুর্গোৎসবের সর্বজনীন ও বৈপ্লবিক তাৎপর্য || যতীন সরকার
* দুর্গাপূজার উদ্ভব ও বিকাশ || তপন চক্রবর্তী

ঢাকা/তারা

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়