ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

বিদায় মুনীরুজ্জামান, শ্রদ্ধা অশেষ

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:৫১, ২৫ নভেম্বর ২০২০   আপডেট: ১৬:০৮, ২৫ নভেম্বর ২০২০
বিদায় মুনীরুজ্জামান, শ্রদ্ধা অশেষ

খন্দকার মুনীরুজ্জামান

করোনা আমাদের আর কত সর্বনাশ করে ছাড়বে? কাল রাতে খবর পেলাম দৈনিক ‘সংবাদ’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুনীরুজ্জামান পরলোকে পাড়ি জমিয়েছেন। তাঁর কি মৃত্যুর বয়স হয়েছিল? যদিও জন্ম-মৃত্যুর হিসাব বা সময় বলে কোনো কথা চলে না। তবুও গড়পড়তা হিসেবে তাঁর যাবার কথা ছিল না। সুস্থ, স্বাভাবিক কর্মমুখর একজন মানুষকেও অকালে টেনে নিয়ে গেলো ভয়াবহ করোনা। ‘সাবধানতার মার নাই’ কথাটা এখন আর খাটে না। মানুষ সাবধান হতে হতে, একা হতে হতে এখন বিরক্ত আর বেপরোয়া। দুনিয়ার অনেক দেশে করোনা লকডাউন বা একা থাকার বিরুদ্ধে মিছিল মিটিংও হচ্ছে। কিন্তু একেক ঘটনা একেকবার আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- সময় বড় বৈরী। আমরা যেন আরো সচেতন, আরো সাবধান হই।

মুনীর ভাইকে আমি চিনি ‘যায় যায় দিন’র সোনালি সময় থাকে। এরশাদবিরোধী উত্তাল বাংলাদেশে সামরিক শাসকের অপসারণ দাবি যখন তুঙ্গে তখনকার শফিক রেহমানের ‘যায় যায় দিন’ ছিল অনন্য। জামার ভেতর লুকিয়ে আমরা এই ম্যাগাজিন পাঠ করতাম। বিলিও হতো। সে সময় মুনীরুজ্জামান কলাম লিখতেন সেখানে। তখন থেকেই বোঝা যেত কতটা আপোসহীন আর আদর্শবাদী মানুষ তিনি। আদর্শ তো থাকারই কথা। না তিনি আওয়ামী লীগ করতেন, না বিএনপি। এ দুই দলে লাখো আদর্শবাদীদের ভেতর ঘাপটি মেরে আছে কোটি স্তাবক আর আদর্শহীন কর্মী নামের উটকো লোকজন। বামধারার দলগুলো আকারে জনবলে ছোট হলেও, তাদের বুকের ভেতর আছে আদর্শের রূপালি আগুন। সে আগুন ছিল তাঁর বুকে। তিনি পথভ্রষ্ট ছিলেন না। আজীবন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নীতি মেনে তার সঙ্গে থেকেছেন। আমি ঢাকা গেলেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে বা ‘সংবাদ’ অফিসে যেতাম। তখন আমি সংবাদের নিয়মিত লেখক। এই কাগজের কাছে আমার ঋণ অপরিশোধ্য। আমি যখন সিডনিতে অভিবাসন নিয়ে আসি তখন না ছিল কোনো মোবাইল, না ইন্টারনেট। কম্পিউটার তখন সোনার হরিণ। আর্ন্তজালে পত্রিকা পাওয়া স্বপ্নের ব্যাপার। তবুও চলমান লেখার নেশায় মত্ত আমাকে থামায় কে? এদেশে এসে গোড়ার দিকে কয়েকমাস সরকারি অনুদানের ওপর নির্ভরশীল ছিলাম। সে অনুদানের টাকায় বাঙালিরা যখন টিভি, ফ্রিজ বা গাড়ি কিনছিল; আমি একদিন মাথায় করে নিয়ে এলাম একটা ফ্যাক্স মেশিন। বাসায় বেড়াতে আসা কতজন যে এনিয়ে ব্যঙ্গ তিরস্কার করেছেন। কেউ কেউ দীপাকে সাফ জানিয়েছিলেন আমার মাথার ঠিক নাই। কিন্তু যার জন্য এই কষ্ট সেই ‘সংবাদ’ আমাকে বুঝতে কসুর করেনি। তারা তিন বছর রোজ আমাকে একখানা সংবাদ পোস্ট করত। সময় তারিখ বা দিন না মিললেও আগে-পরে সব দিনের কাগজ পেয়ে যেতাম আমি। এই ঋণ কি শোধ করা সম্ভব? বলাবাহুল্য এর পেছনে ছিলেন সোহরাব হাসান, পরে মুনীর ভাই।

তাঁকে প্রথম দেখি চাটগাঁয়। কাজীর দেউড়িতে তখন ‘সংবাদ’ অফিস। জসীম চৌধুরী সবুজ ছিলেন দায়িত্বে। ঢাকা থেকে আমাকে বলা হয়েছিল যেন দেখা করি। এক সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে পরিচয়, তারপর তাঁকে রাতের ট্রেনে তুলে দিয়ে আসি ঢাকার পথে। ত্রিশ বছর আগে সে সময়ও মুনীর ভাই ছিলেন স্মার্ট। কেডস আর জিনসের প্যান্ট তখন এত চলত না। সাধারণত ঢাকার সাংবাদিক, তার ওপর যদি সফরে আসেন তো পোশাক হবে কোট টাই। তিনি তার আশেপাশেও থাকেননি।

আমার মনে আছে, এক সকালে শীত শীত চমৎকার রোদে আমি হাজির হয়েছিলাম ‘সংবাদ’ অফিসে। রাতে সম্ভবত কলকাতা যাবার ফ্লাইট। তারপর ওখান থেকে সোজা সিডনি। চা বিস্কিট আড্ডার পর প্রয়াত সন্তোষ গুপ্তের স্মৃতিধন্য রুমটি দেখলাম। মিলিত হয়েছিলাম সম্প্রতি প্রয়াত আরেক গুণী মানুষ সম্পাদক আবুল হাসনাতের সঙ্গে। কিন্তু মুনীর ভাই ছাড়েন না। তাঁর এক কথা- আপনি এসে চলে গেছেন শুনলে বজলু ভাই মন খারাপ করবে। আরেকটু বসেন। এমন করতে করতে ঘণ্টাখানেক পর হলুদ কোট চাপিয়ে ঢুকেছিলেন প্রয়াত বজলুর রহমান। এ সব কথা লিখতে লিখতে মন হু হু করে উঠছে। এসব কিংবদন্তিতুল্য মানুষ কত আপন আর সরল ছিলেন। একটু পরেই ডাক পড়েছিল মতিয়া চৌধুরীর স্বামী আমাদের যৌবনের সেরা সম্পাদক বজলুর রহমানের রুমে। কোথা থেকে যে ঘণ্টা পার হয়ে গেল। তখন ক্যামেরার যুগ ছবি তুলবে কে? ডাক পড়ল মুনীর ভাইয়ের। আবার সবাই মিলে আড্ডা আর ছবি তোলা। এরপর কিছুদিন পর আমি কলকাতা থেকে সিডনি এসে শুনি বজলুর রহমান পাড়ি জমিয়েছেন অনন্তলোকে। আজ এঁদের কেউ নেই, আছে শুধু মন খারাপ করা অমূল্য যত স্মৃতি।

মুনীরুজ্জামানের সম্পাদনায় অজস্র লেখা ছাপা হয়েছে আমার। প্রতি সপ্তায় একটা করে কলাম লিখেছি বছরের পর বছর। ভরসা আর হাতখুলে লেখার জায়গা করে দিয়েছিলেন তিনি। ‘সংবাদ’ মানেই এক অনন্য আদর্শের নাম। তার প্রচার সংখ্যা যত কম আর বেশি হোক না কেন, আমি মনে করি ‘সংবাদ’ হচ্ছে লেখক তৈরির আঁতুর ঘর। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নামে পরিচিত পত্রিকার সম্পাদক কয়েকটি লেখা ছাপানোর পর শর্ত দিয়েছিলেন আর কোথাও লেখা যাবে না। আমার বুকে এখনো আমার দেওয়া উত্তর বজ্রের মতো বাজে। আমি সাহস করে বলেছিলাম, আর যাই করি না কেন ‘সংবাদ’ ছেড়ে আসব না। সম্পাদককে বিনয়ের সঙ্গে জানিয়েছিলাম তিনিও ‘সংবাদ’ এবং ‘একতা’র প্রডাক্ট।

মুনীর ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ হতো ফোনে। মাঝে মাঝে কথা দীর্ঘ হতো। যখনই ফোন করতাম তিনি আমাকে বলতেন, ‘একটু রাখেন’, তারপরই বারান্দায় গিয়ে ফোনটা রাস্তামুখি করে বলতেন ‘শুনুন এবার’। রাস্তায় চলমান হকার, ফেরীওয়ালাদের ডাক শোনাতেন। তারা সুর করে ডেকে ডেকে তাদের পণ্য বিক্রি করছে, আর সে সুর আমাকে শুনিয়ে তিনি বলতেন- বিদেশে থাকেন এগুলো তো শুনতে পান না। শোনেন এবার। এই সারল্যই তাঁর শক্তি ছিল। বাইরে থেকে যত কঠিন মনে হোক না কেন, অন্তর্গতভাবে ছিলেন ভালো নরম মনের মানুষ। সাংবাদিকতার নামে আহামরী জীবন বা কোনো ধরনের ঝামেলায় ছিলেন না কোনোকালে। পড়াশোনা কতটা জানতেন সেটা তাঁর কথা বা টকশোতে মার্জিত ভদ্র আচরণ ও যুক্তিতেই ছিল প্রকাশ্য। রাত জেগে হৈ হৈ করার লোক তিনি ছিলেন না।

দূর প্রবাসে সিডনিতে মনটা ভারী হয়ে গেছে পাথরের মতো। এই কঠিন করোনাকাল যে আর কি কেড়ে নেবে কে জানে? পরপারে ভালো থাকবেন শুদ্ধ মানুষ মুনীর ভাই। শুভ বিদায়।

লেখক: প্রাবন্ধিক

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়