ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

প্রত্যাখ্যানের নীরব অহঙ্কারে উজ্জ্বল সন্ধ্যা ও বুদ্ধদেব

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৮:১৩, ২৬ জানুয়ারি ২০২২   আপডেট: ১৮:৩৩, ২৬ জানুয়ারি ২০২২
প্রত্যাখ্যানের নীরব অহঙ্কারে উজ্জ্বল সন্ধ্যা ও বুদ্ধদেব

মঙ্গলবার রাতে বুদ্ধদেব বিবৃতি দিয়ে বলেন, ‘পদ্মভূষণ পুরস্কার নিয়ে আমি কিছুই জানি না। আমাকে এ নিয়ে কেউ কিছু বলেনি। যদি আমাকে পদ্মভূষণ পুরস্কার দিয়ে থাকে, তা হলে আমি প্রত্যাখ্যান করছি।’ ২০১১ সালে তৃণমূলের কাছে বড় হারের আগ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনি ওই রাজ্যের শেষ কমিউনিস্ট মুখ্যমন্ত্রী।

এদিকে পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের বিষয়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেন, ‘এভাবে কেউ পদ্মশ্রী দেয়? আমি বলে দিয়েছি- আমার পদ্মশ্রীর দরকার নেই। শ্রোতারাই আমার সব।’ 

পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি রাজ্য। সাতচল্লিশে দেশভাগের নামে যে দুটি রাজ্য সবচেয়ে বেশি আক্রোশ আর অবিবেচনার শিকার হয়েছিল তার একটি পাঞ্জাব, আরেকটি বাংলা। দেশভাগের ৭৫ বছর পর ফিরে তাকালে মনে হয় এ জন্য দায়ী বাঙালিদের বিদ্রোহ আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মানসিকতা। বাংলায় চট্টগ্রামের সন্তান সূর্য সেন যখন সশস্ত্র বিপ্লবের পরিকল্পনা করেছিলেন এবং আত্মাহুতি দিয়েছিলেন তখন বাকী ভারত স্বাধীনতার স্বপ্নও সেভাবে দেখতে শুরু করেনি। প্রীতিলতা থেকে বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী- সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম বা বাংলাই ছিল বিপ্লবের সূতিকাগার।

পরবর্তীকালে সুভাষ বোস কিংবা স্বাধীন হবার আগে যুক্ত বাংলার শেরে বাংলা- কাউকেই পছন্দ করতো না ইংরেজ। অন্যদিকে পাঞ্জাবের মানুষ সাহসী আর লড়াকু। শহিদ ভগৎ সিং থেকে জালিয়ানওয়ালাবাগের রক্ত ইংরেজকে নিশ্চিতভাবেই ক্রোধী করে রাখার নমুনা। সে যাই হোক, বাংলা ভাগের অনিয়মতান্ত্রিক খড়গে ভাগ হয়ে যাওয়া পশ্চিম বাংলা আর আমাদের বাংলাদেশের আসলে কোনো ভৌগলিক সীমারেখা নেই। মানুষই তা বানিয়ে নিয়েছে। একটা বড় গাছ বা ছোট খাল কংবা ধানের জমিনের এ-পাশকে বাংলাদেশ আর ও-পাশ ভারত বা পশ্চিম বাংলা বলার রাজনীতি যাই হোক, আমাদের সমাজের মিলও চোখে পড়ার মতো। ভাষা পোশাক খাবার সিনেমা নাটক গান কবিতা সবকিছুই এক। দীর্ঘ ঐতিহ্য আর বর্তমানের আর্ন্তজাল সংস্কৃতি দুই বাংলাকে এতোটা কাছে রেখেছে যে, এখন সীমান্ত যেন একটা নিয়ম বা বাধার বিষয়।

কিন্তু মজার বিষয়, এই উভয় বাংলার মানুষের আচার আচরণ সংস্কৃতি আর রাজনীতিতে ঘটে গেছে ব্যাপক পরিবর্তন। আমাদের সমাজে পুরস্কার পদক বা কিছু পাবার জন্য মানুষ মরিয়া। রাজনীতি বাজারে কতোটা আছে বা নেই সেটা বড় বিষয় না। বড় বিষয় রাজনীতি বা দল নিয়ন্ত্রিত পদক পুরস্কার। দু’একজন মানুষ মাঝে মাঝে এর ব্যতিক্রম বা তাঁদের কথা আলাদা। কিন্তু তাঁরা তো ব্যতিক্রমই। মূলধারাটা এখন বদলে গেছে; যা তোষামোদী লবিং আর স্তাবকতায় পরিপূর্ণ। এমন একটা বাস্তবতায় কেউ কোনো পদক বা পুরস্কার হাতছাড়া করবেন এমন ভাবা যায় না। কীভাবে সেটা হবে? যেখানে একটা পদকের দামের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করে পুরস্কার নেয়ার কথা বাজারে চালু সেখানে প্রত্যাখ্যান করার মতো বুকের পাটা আসবে কোথা থেকে? এমন না যে আমাদের দেশে তেমন মানুষ নেই। বদরুদ্দীন উমর ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার বর্জন করেন; এমন আরো কেউ কেউ আছেন। কিন্তু বিগত কয়েক দশক ধরে সবগুলো সরকারের আমলেই এসব পদক প্রাপ্তি লবিং ও সরকারি আনুকুল্য না থাকলে কারো ভাগ্যে জোটেনি। এমনও দেখা গেছে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পুরস্কার ঘোষণা করার পর সেই মানুষটির নাম প্রত্যাহার বা বাদ দেয়া হয়েছে। এবং সেই মামুষটি তারপর মারাও গেছেন। এতো বড় একটা সম্মান নিয়ে এমন নাটক আমাদের সমাজেই সম্ভব।

যে দুজন মানুষের কথা দিয়ে লেখাটির শুরু তাঁরা কে বা কেন বিখ্যাত আমাদের অজানা নয়। বিশেষ করে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় আপামর বাঙালির ঘরে ঘরে পরিচিত এক গায়িকা। সঙ্গীতের পেছনে ব্যয় করেছেন গোটা জীবন। গান গেয়েছেন একাধিক ভাষায়। অথচ এত কালেও সম্মান পাওয়ার যোগ্য মনে করা হয়নি তাঁকে। তাই নরেন্দ্র মোদী সরকারের চতুর্থ সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ‘পদ্মশ্রী’ প্রত্যাখ্যান করলেন প্রবাদপ্রতিম এই সঙ্গীতশিল্পী। তাঁর বয়স ৯০ পেরিয়েছে। তাঁর চেয়ে কম বয়সিরাও সম্মান পেয়েছেন। তাই এখন আর সম্মানের প্রয়োজন নেই বলে কেন্দ্রীয় সরকারকে ফোনেই জানিয়ে দিয়েছেন বলে শিল্পীর পরিবার সূত্রে খবর।

মঙ্গলবার ‘পদ্মশ্রী’ প্রাপকদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। তাতে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের নাম রয়েছে। তালিকা প্রকাশের পর এ দিন শিল্পীর লেক গার্ডেন্সের বাড়িতে ফোন আসে দিল্লির তরফ থেকে। ‘পদ্মশ্রী’ সম্মানে তাঁকে সম্মানিত করা হচ্ছে বলে জানানো হয়। কিন্তু অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তিকে শিল্পী সরাসরি জানিয়ে দেন- তিনি ‘পদ্মশ্রী’ প্রত্যাখ্যান করছেন। এই সম্মান নিতে অপারগ তিনি।

এই আভিজাত্য বা সম্মান বোধ মানুষের মেরুদণ্ডের পরিচায়ক। বায়োলজিক্যাল মেরুদণ্ড সবারই থাকে। কিন্তু ‘শিরদাঁড়া’ না থাকলে মানুষ মানুষ হয় না। কী হতো যদি সন্ধ্যা এই পদ্মশ্রী নিতেন? তাঁর বয়স এখন ৯০ এর ওপরে। মৃত্যুর পর পদ্মশ্রী যুক্ত হতো নামের সঙ্গে- এই তো? কিন্তু তার কি আদৌ প্রয়োজন আছে তাঁর? পদ্মশ্রীর চাইতে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় অনেক আগেই বাঙালির মন মাতিয়েছে, প্রাণ জাগিয়েছে। তাঁর জন্য মোদী সরকারের এই পদ্মশ্রী তুচ্ছ। বরং বলবো অজস্র পদ্মশ্রীর ভিড়ে নাম মনে থাকবে দুজনের। এর একজন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, যিনি আশির দশকে পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন, আর থাকবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের নাম।

বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য রাজনীতিবিদ। তাঁর কাকা বাঙালির প্রিয় বিদ্রোহী বিপ্লবী কবি সুকান্ত। বাম রাজনীতির পুরোধা বুদ্ধদেব বাবুর সততা গল্পের মতো। না আছে তাঁর কোনো বিত্তবৈভব না হাঁকডাক। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পরিবার সূত্রে জানিয়ে দেওয়া হয় মোদী সরকারের দেওয়া পদ্মভূষণ প্রত্যাখ্যান করছেন তিনি। এ ব্যাপারে তিনি জ্যোতি বসুর দেখানো পথেই হাঁটলেন। এর আগে ২০০৮ সালে জ্যোতি বসুকে ভারতরত্ন প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছিল। তখন জ্যোতি বসু জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁকে ভারতরত্ন দেওয়া হলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করবেন।

এবার বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে পদ্মভূষণ সম্মান প্রদান করার কথা জানানো হলে তিনিও তা প্রত্যাখ্যান করলেন। সারা জীবন বিজেপি নামক বিপদ থেকে বারবার রাজ্যকে সাবধান করে এসেছেন তিনি। তাই তিনি চান না বিজেপি সরকারের দেওয়া কোনো সম্মান গ্রহণ করতে। বুদ্ধদেব বাবু নিজেই জল্পনার অবসান ঘটালেন পদ্ম-পুরস্কার ফিরিয়ে দিয়ে।

পাশের বাংলার রাজনৈতিক নেতা, শিল্পী চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেও আমাদের কি ঘুম ভাঙবে? আমাদের ঝিমিয়ে পড়া নির্জীব রাজনীতি মুখ লুকানো সংস্কৃতি প্রতিবাদ ভুলেই গেছে প্রায়। ভুলে গেছে না-বলার সংস্কৃতি। মাঝে মাঝে তার দরকার পড়ে বৈকি। পড়ে না?

সিডনি
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়