ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পদক পুরস্কার তর্ক-বিতর্কের নয়া সংস্কৃতি

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:২৭, ১৬ মার্চ ২০২২   আপডেট: ১২:২৯, ১৬ মার্চ ২০২২
পদক পুরস্কার তর্ক-বিতর্কের নয়া সংস্কৃতি

পদক বা পুরস্কার যদি অপ্রত্যাশিত আর আচমকা না আসে তো ঠিক জমে না। যেমন এক নোবেলজয়ীর গল্পটা এমন। তিনি লিখছেন: ‘খবরটা দিলো মেয়ে। কিন্তু তখন তো মাঝরাত। নোবেল-টোবেল কিচ্ছু নেই মাথায়।’

বলছিলেন অ্যালিস মানরো। ২০১৩ সালে সাহিত্যের নোবেলজয়ী। নোবেল পুরস্কার ঘোষণার এক ঘণ্টা আগে সাধারণত পুরস্কারপ্রাপকদের ফোন করে জানানো হয়, কিন্তু মানরোর সঙ্গে যোগাযোগই করতে পারেনি সুইডিশ অ্যাকাডেমি। এমন অনেক ঘটনা আছে দুনিয়ায়। একটা আভাস হয়তো থাকে কিন্তু এমন না যে এক বছর আগে বা অনেক আগেই সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক হতে থাকে। এই আচমকা বিষয়টি আমাদের দেশ বা সমাজ থেকে উধাও হবার পথে!

স্বাধীনতা পদক আমাদের দেশের সর্বোচ্চ পদক। আপাতত এর ওপর আর কোনো সম্মান নাই। স্বাভাবিকভাবেই মানুষ এই পদকপ্রাপ্তদের বেলায় কৌতূহলী হবেন। আমিও হয়েছি। এবারের স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত চারণ কবি আমির হামজার নাম আমি শুনি নি। আমার মতো কোটি বাঙালি জানেন না। তার মানে এই না যে আমির হামজা পদক পেতে পারেন না। একজন চারণ কবি বিশেষত অখ্যাত অজ্ঞাত কবি যদি দেশের সেরা সম্মান লাভ করেন; কেন আনন্দিত হবো না? এটি তো নিঃসন্দেহে হওয়া উচিত গর্বের বিষয়। ভারতে যখন পদ্মশ্রী পদ্মভূষণ এ জাতীয় পদকগুলো দেওয়া হয় আমরা বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি কোণায় কোণায় ছড়িয়ে থাকা কতো বিস্ময়কর প্রতিভারা এসব পদক জিতে নেন। তখন তাঁদের বন্দনা আর কৃতকর্মের ঔজ্জ্বল্যে ঝলমল করে ওঠে সামাজিক মিডিয়া। আমরা পুলকিত হই।

বাংলাদেশে এর আগেও অখ্যাত এক কবিকে এমন সম্মান দেওয়ার পর সমালোচনা দেখা দিলে পরে তা স্থগিত করা হয়। সে বেচারা এরপর লোকান্তরিত হওয়ায় বিতর্কটি চাপা পড়ে যায়। কবি এস এম রইস উদ্দীনকেও আমরা চিনতাম না। আবারো বলছি আমাদের চেনা-অচেনায় কিছু যায় আসে না। যায় আসে যখন পদক দিয়ে আবার তা প্রত্যাহার করা হয়। এই প্রত্যাহারের ভেতর দিয়ে যাঁরা পদক দেন তারা স্বীকার করে নেন তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। দেশের সবচেয়ে বড় সম্মানের বেলায় এমন বালখিল্যতা কেন?

সে যাই হোক, আমির হামজা অবশ্য তেমন কেউ নন। তাঁর একটা পরিচয় আছে। তাঁর গ্রন্থ আছে। তাঁর  এক সন্তান উপ-সচিব পদে আছেন। সবচেয়ে বড় কথা তিনি ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। পদক তালিকায় নাম আসার পর খোঁজ করে জানা যায়, বীর মুক্তিযোদ্ধা আমির হামজা ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি মারা গেছেন। ২০১৭ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বাঘের থাবা’ প্রকাশিত হয়। এতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে ৩৫টি কবিতা এবং ৩৬টি গান আছে। ২০২১ সালে প্রকাশিত হয় গীতিকাব্যগ্রন্থ ‘পৃথিবীর মানচিত্রে একটি মুজিব তুমি’। গানগুলো বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে লেখা। 

আমির হামজার জন্ম মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার শ্রীকোল ইউনিয়নের বরিশাট গ্রামে ১৯৩১ সালের ৩ মে। তাঁর বাবা ইমারত সরদার। মা আবিরণ নেছা। শৈশবে বাবাকে হারানোর কারণে লেখাপড়া বেশি দূর করতে পারেননি। ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছেন। কবিতা লিখতেন। নিজের লেখা সুর করতেন। কবিগান, পালাগানের মঞ্চে নিজেই গাইতেন। স্থানীয় আকবর বাহিনীর অধিনায়ক আকবর হোসেন মিয়ার অধীনে আমির হামজা সরসারি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।

আমির হামজার ১০ সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয়জন মো. আছাদুজ্জামান। তিনি আমলা। বাবার হয়ে স্বাধীনতা পদকের জন্য আবেদন করেছিলেন। যাতে সুপারিশ করেছিলেন বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ। আছাদুজ্জামান বলেন, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এককভাবে কবি আমির হামজার মতো এত গান ও কবিতা আর কেউ লিখেননি। তার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি মরণোত্তর স্বাধীনতা পদক পেয়েছেন। আমির হামজা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতায় লিখেছেন: ‘যে ক্ষতি পারো না তুমি করিতে পূরণ/কেন সেই মহাপ্রাণ করিলে হনন।/কারে নিয়ে বল আজ কবিতা লিখি/একটি মুজিব এনে দাও তো দেখি।’

শেখ হাসিনা নিয়ে কবিতায় তিনি লিখেছেন: ‘আবারো ভাসিছে আযানের ধ্বনি/ শেখ হাসিনার আহ্বান/ ক্লান্ত শ্রমিক, মাঝিরা, চাষিরা/ফিরিয়া পেয়েছে প্রাণ/ সে যে শেখ হাসিনার আহ্বান/শত বাহুতুলে হাসিছে শাপলা বাংলার সরোবরে।’

স্বাধীনতা পদক বা যে কোনো পদক পুরস্কার কখনো বিতর্কের ঊর্ধ্বে জায়গা নিতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নীল নকশাকারী চাষী মাহবুবুল আলম থেকে শর্ষিনার পীর অনেকেই আছেন এই তালিকায় । এক সময় আমরা ধরে নিয়েছিলাম কিছুটা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কিছুটা পাকপ্রীতি আর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে থাকলেই এমন পদক পাওয়া যায়। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার দেশ শাসনে আসার পর আশা আবার জাগতে শুরু করে। মনে করা হয়েছিল স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর কন্যা যখন আছেন এবং তিনি নিজেও যখন শিল্প সংস্কৃতির ব্যাপারে আগ্রহী কাজেই এবার অন্য কিছু দেখবে জাতি। বলাবাহুল্য গত কয়েক বছর ধরে সে সম্ভাবনার মূলে কুঠারাঘাত দেখছি। 

এটা সবাই জানেন, এতো সব ব্যাপারে খবর রাখার মতো সময় দেশপ্রধানের হাতে থাকে না। বিশেষত আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ব আজ করোনা আর যুদ্ধ বিগ্রহে ক্লান্ত। আমাদের সজীব অর্থনীতির পরও দেশের ভেতরে বাইরে সমস্যার স্তূপ। বাজার মন্দা। তেলের দাম আকাশচুম্বী। আছে নানা ধরনের সমস্যা আর আপদ-বিপদ। সেখানে কে স্বাধীনতা পদক পেলেন আর কে পেলেন না তা নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় কি প্রধানমন্ত্রীর থাকে? অথচ কোনো এক দুষ্টচক্র কাজগুলো এমনভাবে করছে যাতে সবকিছু গুবলেট হয়ে সাধারণ মানুষের মনে এমন ধারণা তৈরি করে দিচ্ছে।  

বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্য এমনিতেই ঝিমিয়ে পড়েছে বা আগের মতো নাই- এ কথা প্রায়ই শুনি আমরা।  কিন্তু একথা জানি না বা মানি না কেন? কে কখন কীভাবে পদক পুরস্কার পাবেন সেটা বড় কথা না। শিল্প সংস্কৃতিকে বেগবান রাখতে হলে সঠিক মানুষদের সম্মান জানাতে হয়। যত দিন তা ছিল তত দিন আমাদের শিল্পাকাশ ছিল ঝকঝকে রোদের মতো উজ্জ্বল। আগেও লিখেছি গ্রাম আর বাংলা বা ঢাকার বাইরের যে কেউ এমন কোনো পদক পেলে আনন্দিত হবার বিকল্প নাই। সব কিছু যেখানে ঢাকাকেন্দ্রিক সেখানে এমন মফস্বলের মানুষ সম্মানিত হলেই ভালো। যারা তাঁকে এই সম্মান বা পুরস্কার দিয়েছেন তারা নিশ্চয়ই বুঝে শুনে সবদিক বিবেচনা করেই তা করেছেন। ‘মরণোত্তর’ শব্দটি আমার পছন্দের না। তার চেয়ে এটিকে দেহোত্তর বা এমন কিছু বললেই ভালো হয়। মরণের পর কোনো মানুষ জানেন না দেখেনও না। কাজেই আমির হামজাও জানবেন না বা দেখবেন না। তবে বিশ্বাসীদের মতে তাঁর আত্মা হয়তো দেখছে আর অবাক হচ্ছে।

সম্মান অর্জন আর পদকের বাইরে এক বিশাল জগত আছে লেখক শিল্পী কিংবা গুণী মানুষদের। সেটা যত দিন তাঁরা মানছেন বা সে জায়গাটুকু যত দিন অবারিত আর মুক্ত তত দিন বাকী সব বুদবুদ। 

সিডনি
 

/তারা/ 

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়