উত্তম আর কাওসারদের চাই না
বদলে দেওয়ার সবচেয়ে বড় শক্তি নুতন প্রজন্ম। এ জন্য তাদের সঠিকভাবে গড়ে তোলার দায়িত্ব পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের। সবার আগে এ দায় পরিবারের। অর্থাৎ পরিবার বড় শিক্ষালয়। যেখান থেকে শিশুর মূল ভীত গড়ে ওঠে। এতে ব্যর্থ হলে, ফল সুখকর হবে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা থাকা স্বাভাবিক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপে, দেশে কিশোর-কিশোরীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বয়সভিত্তিক জনসংখ্যার মধ্যে যারা ১৫-১৯ বছর বয়সী। দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জনের মধ্যে ১ কোটি ৭১ লাখ ৬০ হাজার ১৭৫ জন এই বয়সী। এরপরই আছে ১০-১৪ বছর বয়সী, যাদের সংখ্যা ১ কোটি ৬৮ লাখ ৪২ হাজার ৬৮২ জন। অর্থাৎ ১০-১৯ বছর বয়সীরাই মূল জনসম্পদ। এই সম্পদকে সঠিক পরিচর্যার মধ্য দিয়ে বড় করে তোলা বর্তমান সময়ে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আমরা কি এই চ্যালেঞ্জ নিয়েছি বা গ্রহণ করেছি? অভিভাবকরা সন্তানদের জিপিএ-৫ পাওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত। এই আলোর পথের যুদ্ধে, বড় অন্ধকার যুগে নতুন প্রজন্ম প্রবেশ করে বসে আছে- সে খেয়াল ক’জনের আছে?
সমাজ ও রাষ্ট্র ভেদে নানা কারণে কিশোর অপরাধ হলেও তার মধ্যে কয়েকটি কারণ প্রায় সব রাষ্ট্রেই একই রকম। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বৈষম্য, রাজনীতি, ভাঙা-পরিবার, দারিদ্র্য এবং পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধের সংকট, বিশ্বায়নের প্রভাব। সমাজের নেতিবাচক বাস্তবতার কারণে শিশুরাও বিপথে পা বাড়াচ্ছে। মাদক, কিশোর গ্যাং থেকে শুরু করে বহু অপরাধে নিজেদের যুক্ত করছে। কখনও কখনও হত্যাসহ চরম সহিংস কর্মকাণ্ড করতেও পিছপা হচ্ছে না। একটি শিশু বা কিশোরের পক্ষে এর ধরণের কর্মকাণ্ডে জড়ানোর খবর সমাজের জন্য ভালো বার্তা বয়ে আনে না। এ নিয়ে কারো ভাবনা আছে? অথচ প্রতিদিন এমন অঘটনের কোন শেষ নেই।
সামষ্টিক বিচারে এ বিষয়টিকে কোনোভাবেই হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। কারণ এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সমাজ পরিবর্তনের হাওয়ার ঘটনা প্রবাহ বাড়ছে। তাই সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রতিকারের দিতে নজর দেয়া এখন সময়ের দাবি। যদি প্রতিকারের জায়গায় পরিবার, সমাজ, রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় অবস্থান এখনও সেরকমভাবে প্রস্তুত নয়।
সমাজবিজ্ঞানী ও ওয়েস্টার্ন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনাল জাস্টিস প্রোগ্রামের পরিচালক রোনাল্ড সি ক্রামার এক প্রবন্ধে বলেছেন, সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে সংঘটিত ‘স্কুল শুটিং’-এর কারণ হিসেবে সামাজিক সমস্যাকেই দায়ী করা চলে। তিনি বলেন, বৃহত্তর সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়সমূহ, যেমন দারিদ্র্য, বৈষম্য, এবং ‘সোশাল এক্সক্লুশন’ বা সামাজিক বহির্ভুক্তি আমেরিকার অধিকাংশ যুবা-সহিংসতার মূল কারণ। আমেরিকা বা অন্যান্য দেশের শিশুরা যা চর্চা করছে, তা কি ঠেকানো যায়? নেতিবাচক সব কিছুতেই শিশুদের আগ্রহ বেশি। তথ্যপ্রযুক্তি সবকিছুই মুহূর্তের মধ্যে সামনে তুলে ধরে।
একবিংশ শতাব্দীতে গড় আয়ু যখন সমাজ ভেদে ৬০-৯০ বছর, তখন মানুষের জীবনকে শৈশব, বয়ঃসন্ধিকাল ও প্রাপ্ত বয়সের দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছে। এই বিভাজন ইতিহাসের সব সময়ে সব সমাজে এই রকম ছিল না। ফরাসি ঐতিহাসিক ফিলিপ এরিএস-এর মতে, মধ্যযুগে শৈশব ছিল ক্ষণস্থায়ী। তখনকার ইউরোপীয় সমাজে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩২ থেকে ৩৫ বছর। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে শৈশবের সময়কাল বাড়তে থাকে এবং এটি প্রাপ্ত বয়সকাল থেকে পৃথক হতে শুরু করে। ফিলিপ এরিএস-এর মতে, ঠিক ওই সময় থেকে বয়ঃসন্ধিকালের মানুষ অথবা শিশু কিশোরদের শারীরিক, নৈতিক ও যৌন বিকাশ নিয়ে ভাবতে শুরু করি।
আজকে বৈশ্বিকভাবে শিশুদের সুরক্ষা ও নিবিড় পরিচর্যার যে কথা বলা হয়, সেই ধারণার সূত্রপাত সেই সময়ে, যখন থেকে শৈশব মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ বলে স্বীকৃতি পেতে শুরু করে। এ কথাও আজ সত্য যে, শিশুদের মধ্যে ভালো এবং খারাপ এই দুই সম্ভাবনাই নিহিত থাকে। খারাপের ওপর ভালো যেন জাঁকিয়ে বসতে পারে সেজন্যে শিশুদের সুরক্ষা, শৃঙ্খলা ও সুস্থ পারিবারিক পরিমণ্ডল প্রয়োজন। আমরা কি তা নিশ্চিত করতে পারছি? এটি আজ অনেক বড় প্রশ্ন।
সন্তানের শৈশব, বয়ঃসন্ধিকালের শারীরিক, মানসিক, যৌন ও বুদ্ধিবৃত্তিক সুস্থ বিকাশের গুরুত্ব সম্পর্কে বাংলাদেশের অধিকাংশ বাবা-মা সঠিক ধারণা রাখেন না। অভিভাবকরা মনে করেন, শিশুদের পথ আলোয় আলোয় পরিপূর্ণ। তাদের সামনে নিরাপদ পরিবেশ। সুস্থ ধারায় তারা বেড়ে উঠবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন, তরুণ প্রজন্মের জন্য সমাজ মোটেও নিরাপদ নয়। শিশুকিশোরদের পায়ে পায়ে বিপদ অপেক্ষা করে।
এই অবস্থায় তাদের বকাঝকা না দিয়ে, মারধর না করে, শরীর ও মনের ওপর কোনও চাপ সৃষ্টি না করে সন্তানকে বড় করার আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি সম্পর্কে বাবা-মায়ের ধারণা জরুরি। রাষ্ট্রও কিন্তু এ ব্যাপারে খুব বেশি সচেতন বলা যাবে না। এজন্য দেশে সঠিক গাইড লাইনও নেই। অভিভাবকরাও অনেক ক্ষেত্রে উদাসীন।
এই সুযোগে সমাজে শিশুদের দ্বারা সংগঠিত নানা অঘটন বাড়ছে। দিন দিন তা মাত্রা ছাড়িয়ে ভয়াবহ পর্যায়ে রুপ নিয়েছে। এটিই প্রমাণ করে তারা প্রয়োজনীয় শিক্ষা পায়নি। বা তাদের গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে, তা যথার্থ নয়। এমনও হতে পারে, সময়ের কারণে পদ্ধতিগত পরিবর্তন এলেও আমরা তা ধরতে পারছি না। এ কারণে সমাজের তরুণ বা কিশোরদের একটা বড় অংশ অপরাধে জড়াচ্ছে। তাদের কোনো কৌশলেই আলোর পথে ফেরানো যাচ্ছে না। এটা সুন্দর সমাজ বিণির্মাণে সর্বোচ্চ পর্যায়ের লাল সংকেত বলা যেতে পারে। তবে আমাদের শিশু কিশোরের কেন বিপথে পা বাড়াচ্ছে এ রোগ কিন্তু কমবেশি চিহ্নিত।
গেল ২৩ জুন রোববার নেত্রকোনার মোহনগঞ্জে ঘরে ঢুকে স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালায় উত্তম বিশ্বাস (২১) নামে এক যুবক। বাধা দেওয়ায় ওই ছাত্রীর গলা ও ঠোঁটে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায় অপরাধী। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীর মা বাদী হয়ে মোহনগঞ্জ থানায় মামলা করেছেন। ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী স্থানীয় একটি উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী। আর অভিযুক্ত যুবক সবার কাছে বখাটে হিসিবে পরিচিত। অল্প বয়সে সে বিবাহিত হওয়ার পরও এলাকার বিভিন্ন মেয়েদের উত্ত্যক্ত করত। প্রতিবেশী ওই মেয়েটিকে স্কুলে যাওয়ার পথে কুপ্রস্তাব দিতো। এতে রাজি না হওয়ায় ক্ষিপ্ত হয় উত্তম।
এর আগে গত বছরের মে মাসেই পাশের উপজেলা বারহাট্টায় এ ধরনের আরেকটি ঘটনা ঘটে। প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় প্রকাশ্যে দিবালোকে এক বখাটে কুপিয়ে হত্যা করে স্কুল শিক্ষার্থী মুক্তি বর্মণকে। যদিও হত্যাকাণ্ডের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয় ১৯ বছর বয়সী আসামি কাওসার।
২০২২ সালের ১৬ জুলাই মোহনগঞ্জে ফেসবুকে ছবি আপলোড করার ঘটনায় এক স্কুলছাত্রী ও তার বাবা-মাকে রামদা দিয়ে কুপিয়ে ও লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আহত করে প্রতিবেশী তিন যুবক। শিক্ষককে পিটিয়ে আহত করা, যৌন নির্যাতন, মাদক, জুয়া, চাঁদাবাজি, কিশোর গ্যাং, সন্ত্রাস থেকে শুরু করে সমাজের বিতর্কিত সব অপকর্মেই এখন শিশু-কিশোররা যুক্ত।
নেত্রকোণার পাশাপাশি এই দুই উপজেলায় এরকম ঘটনা ঘটছে। এসব অপরাধ প্রতিকারে স্থানীয় প্রশাসন, সমাজ বা পরিবার থেকে কোন পদক্ষেপ কি নেওয়া হয়েছে? যদি হতো তাহলে একের পর এক এ ধরনের অপরাধের পুনরাবৃত্তি হয়ত হতো না। কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে গোটা দেশের চিত্রই প্রায় কাছাকাছি।
প্রশ্ন আসে এসব অপরাধ কেন বাড়ছে? অবাধ তথ্য প্রবাহের কারণে সবার হাতে হাতে এখন মোবাইল। ইন্টানেট সবকিছু এনে দিয়েছে হাতের নাগালে। তরুণ প্রজন্মের একটা বড় অংশের কাছে এর অপব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। যা সত্যিই উদ্বেগজনক। এরসঙ্গে রাজনীতি, অর্থনীতি, অপরাধ করে আশ্রয় পাওয়া, সুশাসনের অভাব অল্প বয়সের মানুষদের দিন দিন বেপরোয়া করে তুলছে। ক্ষমতার আশ্রয় দিয়ে শিশু কিশোরদের অপরাধে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আকাশ সংস্কৃতি। সুস্থ ধারার গ্রামীণ সংস্কৃতি এখন সামাজ থেকে প্রায় বিলুপ্ত। তেমনি টেলিভিশনের পর্দা থেকে ছেলে মেয়েরা খারাপ বিষয়গুলো বেশি নিচ্ছে। গ্রামেও এখন শিশুদের খেলার মাঠ কমেছে। তাদের সুস্থ ধারায় ব্যস্ত রাখার পরিবেশ ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে! সব মিলিয়ে শহর থেকে গ্রাম সব জায়গাতেই মোবাইল নির্ভর জীবন। তেমনি বড়রাও বড় হওয়ার চিন্তায় বেসামাল।
বড়দের অন্যায় কাজগুলো শিশুরা বেশি রপ্ত করে। অর্থ, সম্পদ আর চাওয়া-পাওয়ার দিকে ছুটতে গিয়ে সন্তানদের দিকে খেয়াল করেন না অনেক অভিভাবক। অনাদর, অবহেলা আর সঠিক পরিচর্যার অভাবেও অন্ধকার পথে পা বাড়াচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। শিশুরা কোথায় যাচ্ছে? কার সঙ্গে গিয়ে মিশছে? কাদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছে? কোথায় থাকছে? এ নিয়ে অভিভাবকরা খুব বেশি সচেতন নয়! তেমিন শিশুরা কীভাবে আয় করছে, ঘর থেকে নেয়া অর্থের ব্যয় কীভাবে হয়? এর খোঁজ রাখনে না অনেক বাবা-মা। এসবকিছুর ফলাফল হলো প্রজন্মের বিপথে যাওয়া।
সামাজিক বাস্তবতা বদলে যাওয়ায়, গ্রামের ভালো মানুষগুলো আত্মসম্মানের ভয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন। তারা আর কোনো কিছুতেই মাথা ঘামান না। অল্প বয়সের একটি যুবক মানুষ হত্যার মতো সাহস করেছে! অন্যের উপর হামলা করছে। এর চেয়ে ভয়ঙ্কর আর কী হতে পারে।
শিক্ষা, সংস্কৃতি চর্চা ও সভ্যতা বিবেচনায় সমৃদ্ধ দেশগুলো অনেক এগিয়ে। সেখানের সমাজে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে সবাই নড়েচড়ে বসে। তারপর স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থা ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করে প্রকৃত বিষয় বের করে এনে কার্যকর দাওয়াই নিশ্চিত করে। আমরা তেমনটি দেখি না। যে দেশে নানা স্তরের শিক্ষা, সংস্কৃতির বাজেট কমে সেখানে শিশুদের নিরাপদ পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ থাকার কথা নয়।
সবকিছুর পরও কিশোর অপরাধের ঘটনা গুলোকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা ঠিক নয়। তাই উত্তম বিশ্বাস আর কাওসারদের মতো অপরাধী যেন সমাজে তৈরি না হয় সেজন্য পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের দায় রয়েছে। সব পক্ষ থেকেই সোচ্চার হওয়ার সময় এখনই। বিশেষ করে সন্তান কোথায় যায়, বাবা মাকে তা চোখে চোখে রাখতে হবে। অন্যথায় এক সময় উত্তম-কাওসারদের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা রাষ্ট্রের জন্য বড় রকমের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে। পরিবারে উত্তম আর কাউসারের চরিত্র কারো কাম্য নয়।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
তারা//