ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

দুই ভাইয়ের স্যাক্রিফাইস, বাবার মৃত্যু ও রোনালদোর দর্শন- রবিউলের ক্রিকেট জীবনের গল্প 

ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০১, ১৪ জানুয়ারি ২০২৩   আপডেট: ১০:১৩, ১৪ জানুয়ারি ২০২৩
দুই ভাইয়ের স্যাক্রিফাইস, বাবার মৃত্যু ও রোনালদোর দর্শন- রবিউলের ক্রিকেট জীবনের গল্প 

‘আমি খুব আবেগী হয়ে যাচ্ছি’ - রবিউল হক বাক‌্যটা শেষ করতে পেরেছিলেন ঠিকই কিন্তু মনের ভেতরে যা চলছিল তা প্রকাশ করতে পারছিলেন না। 

বড় দুই ভাইয়ের কথা মনে করতেই তার চোখ জোড়া ছলছল করছিল। বাধ‌্যগত অশ্রু যেন বেরিয়ে আসার অনুমতির অপেক্ষায়! রবিউল নিজেকে সামলে নেন। ভাইদের স্যাক্রিফাইসেই আজকের রবিউল। এর আগে বাবার পৃথিবী বিয়োগের কথা জানিয়ে নিজেকে ফিরিয়ে নেন বছর খানেক আগে। প্রিয় বাবা দেখে যেতে পারেননি ছেলের সাফল্য। তার স্মৃতিতে ভেসে আসে শৈশবের একাডেমির কোচ। যে স্মৃতি আজও অম্লান। সঙ্গে আইডল ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর জীবন দর্শন তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়, প্রতিটি ঘাম-বিন্দুকে আনন্দময় করে তোলে। ১১ মিনিট ১৫ সেকেন্ডের জীবনের প্রথম সংবাদ সম্মেলন। রবিউল শুধু বললেন। বাকিরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলেন।     
  
পুরোটা সময় রবিউলের কণ্ঠ ভারী হয়ে আসে কয়েকবার। কিন্তু নিজেকে সামলে পরিস্থিতি সামলে নেন। আজ হাসির দিনে অশ্রু নয়। বরং কৃতজ্ঞতা জানানোর সেরা মঞ্চ। 

শুক্রবার বিপিএলের দ্বিতীয় ম্যাচে রংপুর রাইডার্সকে ৪ উইকেটে জেতানোর নায়ক পেসার রবিউল হক। ২২ রানে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচ সেরার পুরস্কার জিতেছেন এ পেসার। এর আগে দুই আসরে বিপিএলে দুটি করে ম্যাচ খেলেছিলেন। ২০১৯ সালে চিটাগাং ভাইকিংয়ের হয়ে অভিষিক্ত মৌসুমে মাত্র ২ ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়। পরের বছর খুলনা টাইগার্সের হয়ে আরও ২ ম্যাচ। বিপিএলের যাত্রা থেমে যায় ওখানেই। 

এবার রংপুরের জার্সিতে আবার পথ চলা শুরু। ঘরোয়া ক্রিকেটে শেষ দুই বছর বেশ ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করায় তাকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল। বিশেষ করে লাল বলের ক্রিকেটে সফল হওয়ায় রবিউল লাইম লাইটে ছিলেন। ভালো বোলিংয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন টি-টোয়েন্টিতেও। ৪ উইকেট তারই প্রমাণ।

ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অযুত-নিযুত পরিশ্রম, কণ্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে পাওয়া সাফল্য হয় অম্লমধুর। সেই আনন্দের সীমা থাকে না। রবিউলের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। জীবন দর্শনে তার প্রথম প্রেম, ভালোবাসা বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। পর্তুগালের রোনালদো লিসবন থেকে যেভাবে গোটা বিশ্বের সিআরসেভেন হলেন তাতে রবিউল খুঁজে পান আলোর দিশা। রোনালদো পারলে কেন রবিউল নয়! তাইতো আইডলকে দেখেই হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেন। সাফল‌্য মিললে উদযাপনও করেন তার মতো। কখনো দু’হাত বুকে জমাট বাঁধে কখনো, কখনো লাফিয়ে হাত ছড়িয়ে দেন দু পাশে। 

‘আমার উদযাপনের পেছনে যে আইকনিক মানুষটা (ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো) আছেন তিনি আমার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আসল কথা হচ্ছে প্রত্যেকটা খেলোয়াড় কাউকে না কাউকে অনুসরণ করে, আমিও একজনকে অনুসরণ করি। উনার ওয়ার্ক ইথিকস বলেন, অনেক কঠোর পরিশ্রমী, অনেক শক্ত মানসিকতার। খুব খারাপ পরিস্থিতিতেও উনি দলকে যেকোনো ভাবে কাম-ব্যাক করাতে পারেন, বড় মঞ্চেও। এরকম একটা বিশ্ব মহা তারকার কাছ থেকে কিছুটা হলেও যদি আমি নিজের ভেতর নিতে পারি...কঠোর পরিশ্রম বলেন, শক্ত মানসিকতা বলেন, যাই বলেন। সেটা আমার জন্য অনেক সৌভাগ্যের ব্যাপার হবে।'

রোনালদোর প্রতি রবিউলের এ ভালোবাসা একেবারে শৈশব থেকে। যে ভালোবাসা নিখাদ, বিশুদ্ধ। তার কণ্ঠেই তা ফুটে উঠে প্রবলভাবে,‘উনার খেলা দেখি ২০০৬/২০০৭ সাল থেকে। হয়তো যখন উনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দিয়েছেন। তারপর থেকে উনাকে অনুসরণ করি। তারপর উনাকে দেখলে মনে হয় উনি জেতার জন্য যেকোনো কিছু করতে পারেন, যেকোনো কিছু। ছোটবেলা থেকে হয় না কাউকে ভালো লাগলে মনে প্রাণে বসে যায়। ওরকম থাকতে থাকতে রিয়াল মাদ্রিদে সুপার সিজন কাটানোর পরে এত চ্যাম্পিয়ন্স লিগ, এত ট্রফি...জুভেন্টাসে যাওয়ার পর... এখনও তার শক্ত মানসিকতার পরিচয় যেভাবে দিয়ে যাচ্ছেন এটা অনেক বড় কিছু। এইগুলাই মোটামুটি অনুসরণ করা হয়। নিজেকেও পাম্প আপ করি যে একটা মানুষ কঠোর পরিশ্রম দিয়ে এত কিছু করতে পারলে আমিও মানুষ, আমিও ইনশাল্লাহ অনেক কিছু করতে পারব।' 

সৈয়দপুরে জন্ম নেওয়া রবিউলের বড় দুই ভাই ক্রিকেট খেলতেন। বড় ভাই রাশেদ আনাম, মেঝ ভাই রাকিব সরকার। বাবা এনামুল হক সরকার ছেলেদের ক্রিকেট খেলতে উদ্বুদ্ধ করলেও জানিয়ে দেন, কেবল একজনকে নিয়েই ঝুঁকি নেবেন। বড় দুই ভাই নিজেদের স্বপ্ন আড়াল করে সম্ভাবনাময় রবিউলকে সুযোগ করে দেন। তারা চাইতেন, রবিউল যেন সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্রিকেট খেলে। তাদের সেই স্যাক্রিফাইসে আজ প্রতিষ্ঠিত রবিউল। বড় মঞ্চে দাঁড়িয়ে রবিউল ভুলতে পারেন না দুই ভাইয়ের আত্মত‌্যাগ। 

‘আসলে আমার দুই কোচ হচ্ছেন আমার বড় ভাই ও মেঝ ভাই। সবসময় ফোন দিলেই উনারা আমাকে এত নলেজ দেয়… ওরা আসলে...আমার বড় ভাই আমার হিরো। উনি লাইফের সবকিছুই স্যাক্রিফাইস করেছেন আমার এই ক্রিকেট খেলা নিয়ে জন্য। কি বলব, ইমোশনাল হয়ে যাচ্ছি। বড় ভাই, মেঝ ভাই… তাঁরা আমার ক্যারিয়ারের জন্য সব কিছুই করেছেন।’

ভাইরা এখনও আছেন। দেখছেন তার এগিয়ে যাওয়া। তাতে নিশ্চয়ই গর্ব খুঁজে পাচ্ছেন। তবে রবিউলের আক্ষেপ বাবা দেখতে পারেননি তার এগিয়ে যাওয়া। অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের পর ইনজুরি ও ক্যারিয়ার আগাচ্ছিল না বলে বাবা চিন্তায় ছিলেন। কিন্তু বছর দুয়েকের ভেতরেই রবিউল খুঁজে পেলেন কক্ষপথ। কিন্তু প্রিয় বাবাই এখন নেই। 

‘একটা অনেক স্যাড স্টোরি আছে। ২০২২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি আমার বাবা মারা যান। উনি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক টেন্সড ছিলেন। আমি ইনজুরিতে ছিলাম প্রায় দেড় বছর। উনি হয়তোবা অনেক টেনশন করতেন যে, আমার কি হবে ক্যারিয়ারে। আমি কখনও ভাবতাম না। আমার দুইটা এথিকস হচ্ছে আমি পরিশ্রম করি যতদূর আমার সম্ভব আর আল্লাহ পাকের কাছে চাই যা হবে আলহামদুলিল্লাহ্‌। আমি দুই হাত দিয়ে সেটা একসেপ্ট করে নিবো।’

‘আজ হোক, কালকে হোক আমাদের মরতেই হবে। প্রিমিয়ার লিগে আমার দল হচ্ছিল না, তখন উনি মারা যাওয়ার ঠিক পরদিনই আমার প্রিমিয়ার লিগে প্রাইম ব্যাংকে সাইন হয়। তো সামথিং দেয়ার, এটা আসলে বলতে পারেন আল্লাহ্‌ পাকের তরফ থেকে এটা ভালো কিছু ছিল। তো এটা সবসময় ব্যাক অব মাইন্ডে কাজ করে হয়তো আজকে বাবা বেঁচে থাকলে অনেক খুশি হতেন এরকম লাইভ ম্যাচে দেখলে।’- রবিউল ভারী কণ্ঠে গড়গড়িয়ে বলতে থাকেন।

ডানহাতি পেসারের ক্রিকেটের হাতেখড়ি জন্মস্থান সৈয়দপুরে। সেখানের  ভিক্টোরিয়া ক্লাবে কিছুদিন খেলে ক্রিকেটের টানে চলে আসেন ঢাকায়। ফ্রেন্ডস ক্রিকেট একাডেমীতে কোচ নাদিম সাজ্জাদের তত্ত্বাবধানে ৬ মাস অনুশীলনের পর ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সুযোগ পান ঢাকা মেট্রো দলে। এরপর বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ মেলে। বিপিএলের মঞ্চে রবিউল কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন শৈশব গুরুকেও। 

‘আরেকজনের কথা না বললেই নয়। তিনি আমার একাডেমীর কোচ নাদিম সাজ্জাদ ভাই। যখন আমি অনূর্ধ্ব-১৮ খেলি, তখন আমার কিছুই ছিল না। উনি এতটা সাহায্য করেছে যা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। উনাকে কখনো কিছু দিয়ে ধন্যবাদ জানাতে পারিনি। তবে নাদিম ভাই, আমি আপনার প্রতি চিরকৃতজ্ঞ।’

অন্ধকার পেরিয়ে গেলেই আলোর দিশা পাওয়া যায়। ব‌্যর্থতার এক-একটি স্তর পেরিয়ে মেলে সাফল‌্যের সিঁড়ি। নিজেদের প্রথম দুই বিপিএল ব‌্যর্থতা নতুন করে পথ চলতে শিখিয়েছে বলে দাবি রবিউলের,‘প্রথম বিপিএলে তো অনেক ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে! তিন বলে তিনটা ছয়, নো বল... আর্লি স্টেজে আমার মতে এসব হওয়া ভালো। একটা ইয়াং প্লেয়ারের জন্য খুবই ভালো। তাহলে তার শেখার চাহিদাটা, স্ট্রংভাবে কীভাবে কাম ব্যাক করা যায় এ জিনিসগুলি খুব ভালো শিখতে পারবে। যত দিন যাচ্ছে চেষ্টা করছি নিজের উন্নতি করার। সর্বোচ্চ পর্যায়ে এগিয়ে যেতে হবে। এছাড়া কোনও বিকল্প নেই।’

প্রত্যেকের জীবনেই সংগ্রাম থাকে। সেই গল্পগুলো একেক জনের একেক রকম। তবে সাফল্যের জন্য প্রত্যেককেই ঘাম ঝরাতে হয়। কষ্টের পর মেলে কেষ্ট। তাইতো কষ্টের ফল হয় শ্রেষ্ঠ। রবিউল সেই কন্টকাকীর্ণ পথ পেরিয়ে এখন আলোর দেখা পেয়েছেন। তার আলো ছড়িয়ে পড়ুক দেশের ক্রিকেটে এমনটাই চাওয়া কোটি ক্রিকেটপ্রেমির। 

চট্টগ্রাম/ইয়াসিন

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ