আমিনুলের লেগ স্পিনার হয়ে ওঠার গল্প
রাজকোট থেকে ইয়াসিন হাসান || রাইজিংবিডি.কম
এসেছিলেন ধুমকেতু হয়ে। আগমণে আলো ছড়িয়েছেন আপন ছন্দে। বুঝিয়ে দিয়েছিলেন সম্ভাবনার সব উপাদান রয়েছে তার বৈশিষ্ট্যে। তাতে লেগেছে প্রতিভাবান ট্যাগ।
একটু সতর্কতা, সাথে ধৈর্য ধারণ। তাহলে বাংলাদেশ ক্রিকেটের পরবর্তী তারকাদের একজন হয়ে উঠার সুযোগ থাকবে আমিনুল ইসলাম বিপ্লবের। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেকে জোড়া উইকেটের পর আমিনুল ভারতের বিপক্ষে খেলেছেন দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি। সেখানেও সাফল্য পান ১৯ পেরিয়ে ২০ এ পা দেয়া আমিনুল। ৩ ওভার বল করে ২২ রান দিয়ে নেন ২ উইকেট। চমক দেখানো এ লেগ স্পিনারকে নিয়ে বোলিং আক্রমণে নতুন দিগন্তের শুরু হচ্ছে বাংলাদেশ ক্রিকেটে।
আমিনুলের ছোট্ট পথ চলা খুব কাছ থেকে দেখেছেন রাইজিংবিডির জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইয়াসিন হাসান। তার লিখায় উঠে এসেছে বিস্তারিত অনেক কিছু।
ব্যাটসম্যান টার্নস লেগ স্পিনার :
বয়সভিত্তিক দলে আমিনুল ছিলেন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যান। এইচপির কোচ সাইমন হেলমট নেটে তার লেগ স্পিন দেখে বড় স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। শুরু হয় তাকে নিয়ে ‘ঘষামাজা’। হেলমটকে সঙ্গ দিয়েছেন কোচ ওয়াহিদুল গনি ও সোহেল ইসলাম।
রশিদ খানকে ‘সামলাতে’ গিয়ে আমিনুলকে পাওয়া :
রশিদ খানকে সামলাতে হবে ত্রিদেশীয় সিরিজে। এর আগে নিতে হবে প্রস্তুতি। ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টের আগে জাতীয় দলের নেটে আনা হয় আমিনুলকে। নেটে আমিনুলের বোলিং দেখে পছন্দ হয় রাসেল ডমিঙ্গোর। হাই পারফরম্যান্স কোচ সাইমন হেলমটও সবুজ সংকেত দেন। ‘আমিনুলকে নেওয়া হয়েছে মূলত কোচের আগ্রহে। প্র্যাকটিসে ওকে দেখে কোচের ভালো লেগেছে। আমরা চেয়েছিলাম ওকে ভারতে পাঠাতে (এইচপির হয়ে)। কিন্তু কোচ বেশ জোরাজুরি করছিলেন যে ওকে আরও ভালোভাবে দেখতে চান। এজন্যই নিয়েছি। - বলেছিলেন জাতীয় দলের নির্বাচক মিনাহজুল আবেদীন নান্নু।
এরপর স্বপ্নের অভিষেক :
ত্রিদেশীয় টি-টোয়েন্টি সিরিজে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে নিজের প্রথম ওভারেই আমিনুল নেন উইকেট। এক ওভার পর আউট করেন জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক হ্যামিল্টন মাসাকাদজাকে। অভিষেকে তার বোলিং ফিগার ৪-০-১৮-২। ২০ বছর বয়সি আমিনুল নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে যে বোলিং কারিশমা দেখিয়েছেন, তাতে আশার প্রদ্বীপ জ্বলেছে- অন্তত বাংলাদেশ পেল একজন লেগ স্পিনার!
ভেট্টরির প্রথম ক্লাস :
আকাশে কালো মেঘ জমা ছিল। গুমোট পরিবেশ। মনে অনেক সংশয় জমা ছিল আমিনুল ইসলাম বিপ্লবের। বিসিবি তাদের জন্য উড়িয়ে এনেছে ড্যানিয়েল ভেট্টরির মতো কোচকে। তার সঙ্গে প্রথম সেশন। কেমন কাটবে? ভেট্টরিকে কোন বল করে দেখাবেন? ভেট্টরি কি বলবেন? এসব ভাবনা জুড়ে ছিল তার মনে। কিন্তু নরম শরম ভেট্টরিকে পেয়ে সব সংশয় দূর হয়ে যায় তরুণের। অভয় দিয়ে নিউজিল্যান্ডের প্রাক্তন অধিনায়ক বলেন, ‘ডু ওয়াট এভার ইউ ওয়ান্ট।’ মিরপুর শের-ই-বাংলার সেন্টার উইকেটে তখন পেসাররা ব্যস্ত। ভেট্টরি আমিনুলকে নিয়ে গেলেন সবুজ ঘাসের ওপর। সেখানেই চলল তার বোলিং সেশন। শুরুতে বল পিচ করাতে কষ্ট হচ্ছিল। লেগ স্পিন ধরছিল না। এলোমেলো আমিনুল বোলিংয়ে কোনো কারিশমাই দেখাতে পারেননি। তাতে কোনো রাগ নেই। বরং গুড বলে শিষ্যকে প্রেরণা দিচ্ছিলেন ভেট্টরি। সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমিনুল নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরে পান। লেগ স্পিন, গুগলি করে দেখাতে থাকেন ভেট্টরিকে। পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে টানা বোলিং করে যান আমিনুল। বোলিংয়ে এক সেশন কাটানোর পর ভেট্টরি শিষ্যের মনোবল নষ্ট করেননি। বরং পিঠ চাপড়ে বাহবা দিয়ে বলেছেন,‘কিছুটা সময় লাগবে কিন্তু উন্নতি হবে।’
ল্যান্ডিংয়ে ত্রুটি সারিয়ে ভিন্ন আমিনুল :
সহজাত লেগ স্পিনারদের থেকে খানিকটা বড় তার রানআপ। কুইক আর্ম অ্যাকশন। তেড়েফুঁড়ে এসে বল ছোড়েন। বলের ওপর নিয়ন্ত্রণ দারুণ। গতি কমাতেও পারেন, বাড়াতেও পারেন। লেগ স্পিনার হিসেবে বল ঘোরাতে পারে সহজেই। স্টক বল হিসেবে ফ্লিপার তো আছেই। বৈচিত্রে খানিকটা ঘাটতি থাকলেও বল হাতে তার দারুণ নিয়ন্ত্রণ। সবকিছু ইতিবাচক থাকলেও ল্যান্ডিংয়ে ত্রুটি ছিল আমিনুলের। বিষয়টি ধরিয়ে দেন ভেট্টরি। আগের রান আপ থেকে কিছুটা রান আপ কমিয়েছেন আমিনুল। ল্যান্ডের আগে বড় লাফ দেওয়ার প্রবণতা ছিল এ পুচকে লেগ স্পিনারের। কিন্তু লাফ দেওয়া তো আর হচ্ছে না।
‘চাহাল’ হয়ে উঠবেন আমিনুল :
ভারতের লেগ স্পিনার যুজবেন্দ্র চাহালকে গড়ে তোলার পেছনে সবথেকে বড় অবদান ভেট্টরির। ভারতীয় গণমাধ্যমের দাবি, আইপিএল চলাকালিন চাহালকে আবিষ্কার করেন ভেট্টরি। শুধু তাই নয়, রয়াল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরুর কোচ থাকাকালিন চাহালকে নিয়েই সবথেকে বেশি শ্রম দিয়েছেন ভেট্টরি। তাতে ফল পাচ্ছে ভারত। সীমিত পরিসরে চাহাল এখন ভারতের স্ট্রাইক বোলারদের অন্যতম। বেঙ্গালুরুর কোচ হিসেবে যোগ দেওয়ার পর ভেট্টরি চাহালকে তুলে আনেন। নিয়মিত ম্যাচ খেলানোর ব্যবস্থা করেন। অধিনায়ক বিরাট কোহলিও আস্থা রাখেন লেগ স্পিনারের উপর। সব মিলিয়ে টানা ম্যাচ খেলার উপরে থাকায় এবং দ্রুত উন্নতি করায় চাহাল হয়ে উঠেন বর্তমান সময়ের অন্যতম সেরা লেগ স্পিনার।
চাহালের আয়নায় আমিনুল :
দিল্লিতে আমিনুলের দুর্দান্ত বোলিং ড্রেসিং রুমে বসে দেখেছেন যুজবেন্দ্র চাহাল। তার কাছেই জানতে চাওয়া হয়েছিল আমিনুল কী করেছেন। চাহাল তরুণ স্পিনারের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘সম্ভবত সে তার দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেছে। অবশ্যই সে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ভালো কিছু করে এখানে এসেছে। প্রথম ম্যাচে সে তিন ওভার করেছে এবং নিয়ন্ত্রিত বোলিং করেছে। ২২ রানে ২ উইকেটও পেয়েছে। আশা করছি ভবিষ্যতে সে আরও ভালো করবে।’
উজ্জ্বল ভবিষ্যত :
বাংলাদেশের ক্রিকেটের আরেকটি লজ্জার দিনে আমিনুল জাতীয় দলে ডাক পেয়েছিলেন। সেই রাতটি ছিল নির্ঘুম। ঢাকার নির্ঘুম সেই রাতের পর চট্টগ্রামে আরেক রাতে জ্যোৎস্নাবিলাস করেছিলেন আমিনুল। জাতীয় দলে অভিষেক, পকেটে দুই উইকেট; জ্যোৎস্না রাতে আর কি চাই! এরপর ভারতের বিপক্ষে একই পারফরম্যান্সের পুনরাবৃত্তি। মাত্র কৈশোর পেরোনো আমিনুলের পরিণত উপলব্ধি, সাহস আর আত্মবিশ্বাসে সামনে এগিয়ে চলা সম্ভব।
দিল্লি/ইয়াসিন/আমিনুল
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন