নরসিংদী সদর হাসপাতাল
চারদিকে যার ওত পেতে আছে দালাল
নরসিংদী প্রতিনিধি || রাইজিংবিডি.কম
নরসিংদী সদর হাসপাতাল ঘিরে দালালদের দৌরাত্ম্যের অভিযোগ উঠেছে। ক্ষতিগ্রস্ত অসহায় মানুষরা বলছেন, সংঘবদ্ধ দালাল চক্র হাসপাতালটির সব জায়গায় অবাধ বিচরণ করছে।
জরুরী বিভাগ থেকে শুরু করে হাসপাতালের মূল গেট, অপারেশন থিয়েটার, আউটডোর, বিভিন্ন ডাক্তারের রুমের পাশের দরজা। সব জায়গায়ই ওদের অবাধ বিচরণ। রোগী আসলেই তারা হামলে পড়ে। রোগীদের নানা প্রলোভনে বিভ্রান্ত করে।
নরসিংদী সদর হাসপাতালের গেটের সামনে পিছনে পুরো এলাকা জুড়ে ব্যাঙের ছাতার মত অসংখ্য বৈধ অবৈধ ডায়াগনস্টিক সেন্টার গড়ে উঠেছে। সেইসব ডায়গনস্টিক সেন্টারে রোগীদের ভিড়ানোই দালালদের লক্ষ্য। দালালরা প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত হাসপাতালে অবস্থান করে রোগীদের নিয়ে যান এসব ডায়গনস্টিক সেন্টারে। বিনিময় পান মোটা অংকের কমিশন। এমনকি ওষুধ কিনতে হলেও তাদের পছন্দের দোকান থেকে কিনতে হয়।
আবার দালালদের মদদ যোগান হাসপাতালেরই দুর্নীতিবাজ কর্মচারী। ফলে দালাল চক্রের কাছে সাধারণ রোগীরা জিম্মি। দুর্নীতি পরায়ণ এক শ্রেণির কর্মচারীরা স্বেচ্ছাচারিতায় এ হাসপাতালের চিকিৎসা কার্যক্রম বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
মনোহরদী উপজেলা থেকে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা মো. রাকিবুল ইসলাম বলেন, সদর হাসপাতালে এসেছিলাম ভালো চিকিৎসা হবে বিধায়। কিন্তু এসে দেখি চিত্রপট পুরোই ভিন্ন।
তিনি বলেন, যদি একটি টিকেট কিনতে যাই আশেপাশের কয়েকজন এসে বলে ভাই ৫০ টাকা ১০০ টাকা বাড়িয়ে দেন লাইনে দাঁড়াতে হবে না। পরবর্তীতে তাদের মুখেই শুরু হয় এই জায়গায় ডাক্তার ভালো না, সুন্দর করে রোগীদের দেখেনা, ভালো পরীক্ষা নিরীক্ষা হয় না। পাশে এক অনেক ভালো ডায়াগনস্টিক সেন্টার আছে সেখানে উন্নত মানের চিকিৎসা করা হয় ভালো ডাক্তারের মাধ্যমে। আরো কতো কি প্রলোভন। একজন রোগীর মন মানসিকতা ভাঙার জন্য এইসব দালালরাই যথেষ্ট।
এক সন্তানের জননী বিথি রানী তার ছোট্ট বাচ্চাকে ডাক্তার দেখাতে এসেছেন।
তিনি বলেন, সকালে এক থেকে দেড় ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ডাক্তার দেখিয়ে রুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই একজন মহিলা আমাকে বলে- আপনার মেয়েকে এর থেকেও ভালো ডাক্তার দেখানো যাবে। এখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা ডাক্তারসহ কোনো কিছুই ভালো না। আমার সাথে চলুন, অনেক ভালো ডাক্তার দেখানো হবে। তার কথা বিশ্বাস করে বাচ্চাটিকে নিয়ে আমি তার সাথে চলে যাই। আমাকে একটি ডায়গনস্টিক সেন্টারে সে মহিলা নিয়ে যায়। প্রথমেই আমার থেকে ডাক্তারের ফি নেয় ৫০০ টাকা। কিছুক্ষণের মধ্যে ডাক্তার দেখে এবং একগাদা পরীক্ষা নিরীক্ষা দিয়ে দেয়। পরবর্তীতে ওই মহিলাই সেই ডায়গনিক সেন্টারের কাউন্টারে নিয়ে যায় এবং হিসাব-নিকাশ করে দেখে সাড়ে তিন হাজার টাকা পরীক্ষার বিল। আমি বলি পরীক্ষা করাবো না। হাতে এতো টাকা নেই। কিন্তু তাৎক্ষণিক তারা বিভিন্ন ভয় দেখায় আমাকে। এখন না করলে বাচ্চার ক্ষতি হয়ে যাবে। তার পেটের সমস্যা নাকি গুরুতর। শেষে আমি বাধ্য হয়ে বাসা থেকে টাকা আনিয়ে পরীক্ষা করিয়ে ডাক্তার দেখাই। কিন্তু দুঃখের বিষয়। এতকিছু করার পরও আমার বাচ্চা সুস্থ হয় নাই। পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে আমি ঢাকা যাই।
নাম প্রকাশ না করে হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী জানান, পুরো হাসপাতাল জুড়েই মহিলা ও পুরুষ দালালের দৌরাত্ম্য রয়েছে। আমরা যত টাকা না ইনকাম করি আমাদের থেকে দশগুণ বেশি টাকা তারা ইনকাম করে। আমরা সব কিছু দেখি কিন্তু তারপরও কিছু বলতে পারিনা। কারণ তাদের হাত অনেক লম্বা। দালালদের সাথে এই হাসপাতালের কর্মচারীদের অনেকেই জড়িত। তারাও কমিশন পায়, তাই সব দেখে চুপচাপ থাকে এবং সাহায্য করে।
নাম গোপন রাখার শর্তে একজন দালাল বলেন, সদর হাসপাতালে ডাক্তার পরীক্ষা নিরীক্ষা দিলেও অধিকাংশ সময় সেই পরীক্ষাগুলো হয় না। গ্রামের ও সহজ সরল মানুষদের মূলত আমরা টার্গেট করি। সদর হাসপাতাল এলাকায় গড়ে ওঠা বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর মালিকরা এলাকার স্থানীয় প্রভাবশালী লোক। হাসপাতালে কর্মরত ঝাড়ুদার, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন কর্মচারীদের মদদে মূলত দালালরা চলে। চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে পরীক্ষা-নিরীক্ষা লিখে দেওয়ার পর দালালরা রোগীদের বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যায়। একজন রোগী নিয়ে আসতে পারলে দালাল ১০০ থেকে ৫০০ টাকা এবং পরিস্থিতি ভেদে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কমিশন পায়। যতবেশি পরীক্ষা করবে রোগী, তত বেশি কমিশন পাবে দালাল।
নরসিংদী সদর হাসপাতালের আরএম ডা. মাহমুদুল কবীর বাশার কমল বলেন, দালাল নির্মূলে আমরা দফায় দফায় কার্যক্রম চালাচ্ছি। হাসপাতালে সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সব সময় আমরা কাজ করে যাচ্ছি। যতই দালালদের দমাতে চেষ্টা করি না কেন, ফাঁকফোকর দিয়ে তারা আবার বেরিয়ে আসে। আমিও চাই যে হাসপাতাল দালালমুক্ত হোক এবং সেই জন্য আমি কাজ করে যাচ্ছি।
হৃদয়/টিপু