ঢাকা     বুধবার   ০৮ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৫ ১৪৩১

বর্তমান প্রজন্ম আমাদের গান পছন্দ করে: আহমেদ ফজল 

মো. রায়হান কবির || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৮, ১৬ মে ২০২১   আপডেট: ১৮:৩০, ১৬ মে ২০২১
বর্তমান প্রজন্ম আমাদের গান পছন্দ করে: আহমেদ ফজল 

৯০ এর দশকে বাংলাদেশে জনপ্রিয়তার চূড়ায় ছিল ব্যান্ড মিউজিক। দেশের ব্যান্ডগুলো সীমানা ছাড়িয়ে ওপার বাংলায়ও ভালো চাহিদা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। জনপ্রিয়তার কারণে নিয়মিত শো করতো দলগুলো। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক ব্যান্ডের সঙ্গে শো করেছে দেশের ব্যান্ডগুলো।

নানা প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে ব্যান্ড মিউজিক যে অবস্থান সৃষ্টি করেছিল, তা ধরে রাখতে পারেনি পরবর্তী প্রজন্ম। বলা যায়, দেশের ব্যান্ডগুলো সোনালী সেই সময় হারিয়ে ফেলেছে। এই ব্যর্থতার কারণসহ নানা বিষয়ে কথা বলতে ওই সময়ের সফল কয়েকজন ব্যান্ড শিল্পীর মুখোমুখি হয়েছেন রায়হান কবির। আজকের পর্বে রয়েছেন নোভা ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আহমেদ ফজল।

রাইজিংবিডি: ব্যান্ড মিউজিক আপনারা যে জনপ্রিয়তার জায়গাটায় রেখেছিলেন, বর্তমানের ব্যান্ডশিল্পীরা কেন সেটা ধরে রাখতে পারলো না? 

আহমেদ ফজল: এটা আসলে অনেক বছর ধরেই একটা বার্ণিং কোশ্চেন। অনেকেই এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে। একেকজন একেক অ্যাঙ্গেলে বিষয়টি বিশ্লেষণ করে। আমি আমার মতো করে বলি। আমরা যখন ব্যান্ড মিউজিক শুরু করি নাইনটির কিছু আগে, ওই সময় ব্যান্ড মিউজিকের একটা টেক অফ টাইম ছিল। মূলত ওই সময় আমরা যারা ব্যান্ড মিউজিক করতাম, ব্যান্ড মিউজিকটা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। তখন খুব বেশি ব্যান্ড ছিল না, আমরা অল্প কিছু মিউজিশিয়ান ছিলাম। হাতেগোনা অল্প কিছু ট্যালেন্টেড মিউজিশিয়ান আমাদের আগে একটা প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিলেন, আমরা সেটা এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমাদের চেষ্টা ছিল ভালো একটা মিউজিক বাংলাদেশের নতুন শ্রোতাদের কাছে নিয়ে আসা। এটার জন্য আমাদের ডেডিকেশনটা ছিল ফার্স্ট প্রায়োরিটি। তখন প্রফেশনালিজম ছিল কিন্তু এখনকার মতো এতোটা ছিল না। আমাদের ডেডিকেশন ছিল ভালো কাজ করার। ওই সময় সকল ব্যান্ডই একই ডেডিকেশন ছিল এবং তারা সবাই খুব ভালো মিউজিশিয়ান ছিল। সেসময় আমরা বা অন্যরা বেশ ভালো কিছু কাজ করেছি, যা এখন পর্যন্ত বয়ে বেড়াচ্ছে, যেটাকে নব্বই দশকের একটা সোনালী সময় হিসেবেই অভিহিত করা হয়। 

এবার আসি আপনার প্রশ্নে, এটা কেন কন্টিনিউ করা গেল না। আসলে প্রত্যেকটা জিনিসেরই একটা পিক সময় থাকে এবং তারপর ফল বা ল্যান্ডিং থাকে। এটা হয়, এটা আবার ফিরে আসে। এছাড়াও আরও কিছু কারণ আছে যা আমার ব্যক্তিগত অভিমত। ২০০০ সালের দিকে ব্যান্ড মিউজিক প্রফেশনালিজমে রূপ নেয়। বিষয়টি খারাপ কিছু তা বলবো না। এর প্রয়োজন ছিল। সবাই মেধা ও শ্রম দিয়ে মিউজিক করে এবং সেটার একটা রিটার্ন থাকার দরকার আছে। আমাদের দেশে যেটা হয়েছে, প্রফেশনালিজমের পাশাপাশি কিছু অসাধু প্রযোজকের ব্যবসায়িক মনোভাব খুব প্রকট আকার ধারণ করে। ব্যান্ড মিউজিক শুধু আর্থিক ব্যাপার নয়, এটা সৃজনশীল একটা কাজ। ব্যান্ড মিউজিককে যদি শুধু আর্থিক বিবেচনায় নিলে, কোয়ালিটিতে কিছু সেক্রিফাইজ করতে হয় এবং তখন সেটা হয়েছিল। বাণিজ্যিকীকরণ এবং অর্থ অর্জনের যে স্পৃহা, তখনকার প্রযোজকদের মধ্যে তা বড় আকার ধারণ করেছিল। যার কারণে কোয়ালিটি কাজ কিছুটা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। তখন কিছু ব্যান্ড বা মিউজিশিয়ান অর্থের পেছনে ছুটেছিল। আমি তাদের দোষও দেব না, কারণ এটা তাদের প্রফেশন ছিল। কিন্তু আর্থিক দিকটা যখন বেশি জড়ালো ব্যান্ড মিউজিকে তখন ক্রিয়েটিভিটিটা কিছুটা সেক্রিফাইজ করতে হলো। এর সঙ্গে যোগ হলো, মিক্সড অ্যালবাম। যা শুরু হলো ৯৫/৯৬ এর দিকে। তখন মিক্সড অ্যালবামে একটা ক্যাসেটে অনেককে একত্রে পাওয়ার সুযোগ তৈরি হলো। আমিও এই ধারায় জড়িয়ে ছিলাম। ব্যান্ডের জন্য এটা ক্ষতিকর ছিল। আমি যখন বিষয়টি অনুভব করলাম তখন অনেক অফার থাকা সত্ত্বেও মিক্সড অ্যালবাম থেকে সরে গেছি।

এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হলো, সেসময় ব্যান্ড সংগীতের সংগঠন বামবা গঠন করা হলো। আমি একটু খোলাখুলি কথা বলি, এজন্য আমাকে অনেকে পছন্দ করে আবার অনেকে করে না। বিশ্বে ব্যান্ড মিউজিকের এমন কোনো সংগঠন আছে কিনা জানা নেই, হয়তো আমার জ্ঞানের পরিধি লিমিটেড থাকতে পারে। বামবা গঠনের উদ্দেশ্য হয়তো ভালো ছিল কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেল, ব্যান্ড শোর আয়োজন সদস্যদের মধ্যে রাখা এবং সংগঠনের বাইরে ভালো ব্যান্ড থাকলেও তাদের উপেক্ষা করা। এ ধরনের কার্যক্রম যখন শুরু হলো তখন থেকেই মূলত ব্যান্ডগুলোর মধ্যে ঠিক বিভক্তি বলবো না, ব্যান্ডগুলোর ইন্টারেস্ট কমে গেল। দেখা গেল একটা মিক্সড কনসার্ট হচ্ছে, সেখানে নিজেরা একরকমভাবে পারফর্ম করলো আর অন্যদের একটা সাইড করে দেয়া হলো। আবার দেখা গেল, একটা বড় ব্যান্ড কনসার্টে নিজেদের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে অন্যদের হ্যাম্পার করছে। এ ধরনের ব্যাপার আমি নিজেও সাফার করেছি। ওই সময়ের যারা দর্শক ছিল তারাও বিষয়টি খেয়াল করতো। এটা ওপেন সিক্রেট। ফলে এতে করে দুই একটা ব্যান্ড লাভবান হলেও ওভারঅল ব্যান্ড ইন্টারেস্ট হ্যাম্পার হয়েছে। একটা কনসার্ট হচ্ছে সেখানে আমি আমার সাউন্ড ভালো করলাম আর অন্য একটা ভালো ব্যান্ডের সাউন্ড নষ্ট করে দিলাম। অনেক সময় উপস্থিত দর্শকরা এটা বুঝতে পারতো না, তারা ভাবতো ওই ব্যান্ডের পারফরম্যান্স বোধহয় খারাপ। এই প্রচলনটা তখন শুরু হলো। এ ধরনের কিছু হীনমন্যতা ছিল। ব্যান্ড মিউজিকে যখন আর্থিক বিষয় যোগ হলো তখন ব্যান্ডগুলোর মধ্যে ঐক্যও কমে গিয়েছিল। পরবর্তীতে দেশের রাজনৈতিক ইস্যু বা অন্যান্য ইস্যুর জন্য ব্যান্ড মিউজিকের জন্য ভেন্যু পাওয়া দুস্কর হলো, যা পরে আরো প্রকট আকার ধারণ করে। এমনকি একটা সময় বন্ধই হয়ে গেল। ব্যান্ডরা যদি কনসার্টই করতে না পারে, পারফর্ম করতে না পারে তাহলে তাদের চাহিদাও কমে যায়। এটাও একটা কারণ বলা যায়।

রাইজিংবিডি: ব্যান্ডগুলো ভাঙনের ব্যাপারে কিছু বলুন? এটাও কি জনপ্রিয়তা কমে যাওয়ার একটা কারণ বলে মনে করেন? অনেকে স্বাধীনভাবে কাজের অজুহাতে ব্যান্ড ছেড়ে গিয়েছে বলে ঘোষণা দিতো। এটা কি শুধুই গানের স্বাধীনতার ব্যাপার ছিল, নাকি আর্থিক ব্যাপারও যুক্ত ছিল? 

আহমেদ ফজল: আসলে এটা ভালো বলতে পারবে সংশ্লিষ্ট ব্যান্ডগুলো। তবে আমার মতে, সব ব্যান্ডেই একইরকম কারণ ছিল সেটা হয়তো না। কিছু ব্যান্ডে আর্থিক কারণ থাকতে পারে, আবার কারো ব্যক্তিগত কারণও থাকতে পারে। তবে এটা বড় ইস্যু না। আন্তর্জাতিক ভালো ভালো ব্যান্ডেও দেখা যায়, নিজেদের মধ্যে মতদ্বৈততা দেখা দিলে বা কেউ ব্যান্ডে সেরকম সময় দিতে না পারলে এমনটা ঘটে। এক-দুজন সদস্য পরিবর্তন হয়। আমার ব্যান্ডেও হয়েছে। আমার ব্যাপারটা বলি, আমাদের ব্যান্ডকে প্রফেশনালভাবে নিতে পারিনি, কেননা আমরা সবাই অন্য প্রফেশনে জড়িত। ফলে কাজের ব্যস্ততায় ব্যান্ডে সময় দিতে না পারাও একটা কারণ। ফলে আমার ব্যান্ডেও কিছু সদস্য পরিবর্তন হয়েছে। সাধারণত একই চিন্তার মানুষগুলো মিলে ব্যান্ড গঠন করে। তারপরও কোনো একটা গানের ধরন বা স্টাইল নিয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে। তখনও কেউ কেউ ব্যান্ড ছাড়তে পারে।

রাইজিংবিডি: এটা কি শ্রোতাদের ভেতর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না?

আহমেদ ফজল: এটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আমার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, এর প্রভাব পড়ে। সাংঘাতিকভাবে পড়ে। কেননা লিড ভোকালিস্ট, গিটারিস্ট বা ড্রামার- এরা ব্যান্ডের একটা গুরুত্বপূর্ণ সেকশন। একটা ব্যান্ড যখন পারফর্ম করে তখন অবশ্যই তাদের ভয়েস, গিটার বা ড্রাম একটা নিজস্বতা তৈরি করে। এই সেকশনের যেকোনো একটা পরিবর্তন হলে তা ব্যান্ডের শ্রোতাদের মধ্যে বিরুপ প্রভাব ফেলে। কেননা প্রথম সেটআপটাই শ্রোতাদের মাঝে থেকে যায়। পরে ওয়ার্ল্ড ক্লাস পারফর্মার আনলেও এবং সে ভালো গান করলেও দর্শক প্রথমটাই মনে রাখে। তবে অনেক ব্যান্ডের ক্ষেত্রে পরিবর্তন হওয়ার পর তারা ভালো করেছে।

রাইজিংবিডি: ব্যান্ড দলগুলো অ্যালবাম রিলিজের ক্ষেত্রে বেশ সময় নেয়। এটা কি দর্শক ধরে রাখার ক্ষেত্রে অন্তরায় হিসেবে দেখা দিয়েছে?

আহমেদ ফজল: অ্যালবাম রিলিজের ক্ষেত্রে বাঁধাধরা কোনো নিয়ম নেই। এমন নয় যে প্রতি বছরই তাদের অ্যালবাম বের করতে হবে। তাছাড়া ব্যান্ডের অ্যালবাম বের করতে হলে সময় লাগেই, কেননা বেশ কিছু প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হয়। দর্শক চায় তাদের প্রিয় ব্যান্ডের গান দ্রুত আসুক। তবে দেরি করে হলেও অ্যালবাম পেলে দর্শক তা পুষিয়ে নেয়। তবে অনেক ব্যান্ডের ক্ষেত্রে যদি লম্বা সময় ধরে তাদের অ্যাক্টিভিটিজ না থাকে তাহলে সেটা মেজর হ্যাম্পার করে। আর নিয়মিত যারা কাজ করে তাদের জন্য ৬ মাস বা ১ বছর পর অ্যালবাম হলেও কোনো সমস্যা হয়না। 

রাইজিংবিডি: আপনি বলেছিলেন ‘মিক্স’ অ্যালবাম আর্থিক দিক দিয়ে লাভবান হলেও, তা গানের মানের ক্ষতি করেছে। অথচ শ্রোতারা তাদের প্রিয় ব্যান্ড বা শিল্পীর গান কিন্তু পেত। বর্তমানে এটা কমে গেছে বা নাই বললেই চলে। এটাও কি শ্রোতা হারানোর একটি কারণ বলে আপনি মনে করেন?

আহমেদ ফজল: প্রথম দিকে মিক্সড অ্যালবামে আমরা নিজস্ব লিরিক এবং কম্পোজিশনে কাজ করতাম। ফলে গানের কোয়ালিটি মেইনটেইন হতো এবং শ্রোতারাও এটা খুব ভালোভাবে নিয়েছিল। এক পর্যায়ে যারা মিক্সড অ্যালবাম অ্যারেঞ্জ করতো তারাই সব সুর, কথা এবং কম্পোজিশনের দায়িত্ব নিয়ে নিল। আমরা শুধু ভয়েসটা দিতাম। এতে করে ভালো গান যে আসেনি তা নয়, তবে ব্যান্ডের ইমেজটা হ্যাম্পার হয়েছে। আপনি যেমন বললেন, নোভার গান আসেনি তবে আহমেদ ফজলের গান শ্রোতা পেয়েছে। এতে করে আমার ব্যান্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এভাবেই সব ব্যান্ডগুলোর ক্ষতি হয়েছে।

রাইজিংবিডি: আপনারা নব্বই দশকে যাদের জন্য গান করেছেন তাদের বয়স এখন এভারেজ পঞ্চাশ বা তার কম বা বেশি। আর এখন যারা তরুণ প্রজন্ম তাদের জন্য আপনাদের গান কি মানানসই না, নাকি তাদের টেস্ট অনুযায়ী আপনারা গান করতে পারছেন না? 

আহমেদ ফজল: ওয়েল, চমৎকার একটা প্রশ্ন করেছেন। আমরা কিন্তু একটা টাইম ফ্রেমের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। আমরা যারা ব্যান্ড মিউজিক করি তারা তরুণ প্রজন্মের জন্য গান করি। তরুণ প্রজন্ম যে তাদের আগের প্রজন্মের গান পছন্দ করেনা, এটা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই তারা করে। এখনকার অনেক তরুণ আমাকে লিখে জানায় যে, আপনার এই গানটি ভালো লেগেছে বা খারাপ লেগেছে। আমরা আমাদের সময়ের তরুণ প্রজন্মের জন্য গান করেছি, তারা আমাদের গান ধারণ করেছে। সেই প্রজন্ম বা তার পরের আরও কয়েক প্রজন্ম এখনো আমাদের গান শুনে। সেই নব্বই দশকের শ্রোতারা তাদের বয়স এখন যাই হোক না কেন, তারা এখনো আমাদের গান শুনে সেই সময়ে ফিরে যায়। অনেকেই বলে, ভাইয়া আপনার গান শুনে আমি স্কুলের সময়ে ফিরে যাই...। এখন যারা ব্যান্ডের গান করছে তারাও কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের জন্য গান করছে আর এই প্রজন্ম কিন্তু তাদেরও ধারণ করবে। এটা হচ্ছে প্রাকৃতিক একটা নিয়ম, এটা চলতেই থাকবে। আমরা আমাদের সময়ের পুরোনো গান শুনতাম, এখনো শুনি। আমার কাছে সেই গান এখনো নতুনই মনে হয়। মিউজিকটা এমনই। আমরা এবং আমাদের শ্রোতা যারা ছিলেন তারা একটা ফ্রেমের মধ্যে ছিলাম এবং সেখানেই থাকবো। আর নতুনরা যারা কাজ করছে তারা আমাদের গান শুনে প্রশংসা করে।

রাইজিংবিডি: আসলে আমরা যে প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজছিলাম সেটা হলো- নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও নব্বই দশকের ব্যান্ড দলগুলো সফলতা এবং জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, সেই তুলনায় অনেক ভালো প্ল্যাটফর্ম পেয়েও নতুন প্রজন্মের ব্যান্ডগুলো সেই জনপ্রিয়তা বা বাজার ধরতে পারলো না কেন? 

আহমেদ ফজল: আমার কাছে ব্যাপারটা একটু ভিন্ন মনে হয়। আমি ভিন্নমত পোষণ করি। আমাদের পর যারা এসেছে, এখন যারা কাজ করছে, তাদের ভেতর খুব ভালো ব্যান্ড বা কাজ নেই, অল্প কিছু ভালো ব্যান্ড বা কাজ আছে। আমাদের সময় প্রচুর ডেডিকেশন ছিল। আমরা প্রত্যেকটা ডিপার্টমেন্টে কষ্ট করেছি। আমার মনে হয়, নতুন প্রজন্মের ব্যান্ডগুলোর কিছু জায়গায় আরও ইমপ্রুভ করা দরকার। এর মধ্যে প্রথম বিষয়টা হলো, গানের লিরিক। তাদের গানে তারা কি বলতে চাচ্ছে, সেটা পরিষ্কার না। গান তো শুধু বিনোদনের জন্য না, অনেক রকমের গান হয়। গানের কথাটা পরিষ্কার হতে হবে। পরিষ্কার মানে শুনতে পরিষ্কার না, মেসেজটা সবার কাছে খুব সহজবোধ্যভাবে তুলে ধরতে হবে। এখনকার লিরিকগুলো আমার কাছে কিছুটা দুর্বোধ্য মনে হয়। লিরিকগুলো আরও যত্ন নিয়ে করতে হবে। লিরিকের ওপর গানের সুর, কম্পোজিশন নির্ভর করে। লিরিকের ওপরই গানের থিমটা থাকে। আমি মনে করি, অনেক ক্ষেত্রেই বাইরের কোনো গানকে হুবহু বাংলা করে গানটা করা হচ্ছে, যার কারণে গানের লিরিকের কোয়ালিটি ঠিক থাকছে না। বলা যায়, ভালো গীতিকারের অভাব আছে। আসলে ভালো লিরিক হলে আপনি ওর মধ্যে ভালো সুর করতে পারবেন, ভালো কম্পিজিশন করতে পারবেন। গানের থিমটা তখন পরিষ্কার হয়। এটায় যদি নজর দেয়া যায় তাহলে তারা খুব ভালো কাজ করতে পারবে। কারণ এখন খুব ভালো ভালো মিউজিশিয়ান আছে, যারা আমাদের সময়ের চেয়েও ভালো বাজায়। 

আর দ্বিতীয় যেটা সেটা হচ্ছে, গানের মেলোডি। আমাদের সময়ের সিনিয়ররা যারা আমাদের গান শুনতেন, তারা আমাদের গানের মেলোডি পছন্দ করতেন। এখন আমরা সিনিয়র হিসেবে এটা কিছুটা মিস করি, গানের মেলোডিটা ঠিক সেরকম পাওয়া যাচ্ছেনা। গানের স্ট্রাকচার কেমন যেন অগোছালো। যার কারণে শ্রোতাদের কাছে তা পৌঁছালেও দীর্ঘদিন তাদের মনে গেঁথে থাকে না। 

রাইজিংবিডি: আপনি এক সময় ‘রাজাকারের তালিকা চাই’ এর মতো গান করেছেন। স্বাভাবিকভাবে তরুণরা সব সময় হয় সাহসী এবং প্রজন্মের চেয়ে এগিয়ে। তাহলে এখনকার তরুণরা এধরনের সাহসী কিংবা জীবনমুখী গান গাইতে পারছেনা কেন?

আহমেদ ফজল: এটা নির্ভর করে প্রেক্ষাপটের ওপর। আমরা যখন মিউজিক শুরু করি সে সময়টাকে সবদিক দিয়ে গোল্ডেন টাইম বলবো। আমাদের সময়ে দেশপ্রেম, দেশের সমস্যা, সামাজিক প্রেক্ষাপট-এগুলো নিয়ে আমাদের গ্রুমিংটা হয়েছে। আমাদের বলতে ওই সময়ের সবার গ্রুমিং এমনটাই হয়েছে। আমরা স্কুলে শিখেছি কিভাবে দেশকে ভালোবাসতে হবে, সমাজের সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে হবে। আমার মনে হয় না, বর্তমানে এমনটা হয় বরং রিভার্স হচ্ছে। আমরা যেহেতু এভাবে বেড়ে উঠেছি তাই আমাদের প্রত্যেকটা কার্যক্রমে এর একটা রিফ্লেকশন ছিল। আমরা যেহেতু গানের প্ল্যাটফর্মে ছিলাম তখন আমরা যা শিখেছি জীবনের উদ্দেশ্য, দর্শন বা ভাবনা এগুলো আমরা গানের মাধ্যমেই প্রকাশ করেছি। সে সময়ের প্রজন্ম গানে হোক কিংবা অফিস আদালতে তাদের দর্শনটা তুলে ধরেছে।  এখনকার ছেলেমেয়েদের কাছে গত ২০ বছর ধরে এধরনের অ্যাক্টিভিটিজ অনুপস্থিত এটা আমি জোর দিয়ে বলতে পারি। এখন সব কিছু হ্যান্ডি হয়ে গেছে, সকল ইনফরমেশন চাইলেই সহজে পাওয়া যায়। কিন্তু একটা কথা আছে না, বিনা পয়সায় কিছু পেলে আমরা সেটা ফেলে রাখি। এখন সবকিছু এতো সহজ হয়ে গেছে যে, বর্তমান প্রজন্ম ‘পাজলড’ হয়ে গেছে- তারা কোনদিকে মুভ করবে। 
বর্তমান প্রজন্ম দেশের সমস্যা নিয়ে ভাবা, রাজনৈতিক ইস্যু, পরিবেশগত সমস্যা ইত্যাদি থেকে নিজেকে দূরেই রাখে। তাদের এসব বিষয়ে সময় দেয়ার মতো সময় নেই। যদিও কিছু ব্যতিক্রম আছে। তবে সার্বিকভাবে বলতে গেলে এখন এধরনের চিন্তাভাবনা কম, একারণেই তারা ওই ধরনের গান করতে পারে না। 

রাইজিংবিডি: আপনি রাজাকারের তালিকা কেন চেয়েছিলেন? 

আহমেদ ফজল: আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের সবকিছু আমার টু দ্য পয়েন্ট মনে আছে। আমার মনে রাজাকারদের কর্মকাণ্ড দাগ কেটেছে। তাদের দেশবিরোধী কাজ আমাকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। রাজাকারের বিচার হওয়াটা আমি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছি। তাদের তালিকা চাই, এটা একটা সিম্বলিক অর্থে ব্যবহার করে তাদের বিচার চাওয়াটাকেই বুঝিয়েছি। তখন যে আমি এটা বলতে পেরেছি এজন্য নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি। যারা রাজাকারের বিচার করেছেন তাদের আমি স্যালুট জানাই।

রাইজিংবিডি: বর্তমানে গানের বাণিজ্যিকীকরণ ইউটিউব ভিত্তিক হয়ে গেছে, এটাকে নোভা ব্যান্ড বা আহমেদ ফজল কিভাবে দেখেন?

আহমেদ ফজল: প্রথমত একটা স্রোতের বিপরীতে আপনি খুব বেশিদূর যেতে পারবেন না। প্রত্যেকটা মিডিয়াই একটা দীর্ঘ সময় ধরে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে। এক সময় রেডিওতে গান হতো, কলের গান ছিল, এলপি ছিল, ক্যাসেট ছিল, সিডি এসেছে। এগুলো অপ্রচলিত হয়ে গেছে।  এখন ইউটিউব বা অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে মিউজিক চলে গেছে। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আমি এটাকে সাধুবাদ জানাই। তবে মিউজিক যে মিডিয়াতেই যাক না কেন, মেধা ও শ্রমের ন্যায্য পারিশ্রমিক যেন নিশ্চিত করা হয়।

রাইজিংবিডি: শ্রোতারা আপনাদের নতুন ‌অ্যালবাম কবে পাবে?

আহমেদ ফজল: ইতিমধ্যেই একটি অ্যালবাম পেয়ে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু সেটা আমাদের কিংবা শ্রোতাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতির কারণে তা সম্ভব হচ্ছেনা। তবে পরিস্থিতি উন্নত হলে খুব দ্রুতই আমাদের অ্যালবাম শ্রোতাদের উপহার দিতে পারবো।

ঢাকা/শান্ত/ফিরোজ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়