ঢাকা     রোববার   ০৫ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২২ ১৪৩১

আমার অবদানের কথা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে জানাতে চাই : শাকিল

মুজাহিদ বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫২, ১৭ জুলাই ২০২৩   আপডেট: ১১:৫৮, ১৭ জুলাই ২০২৩
আমার অবদানের কথা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে জানাতে চাই : শাকিল

হিমালয় পর্বতের পশ্চিমে নেপাল-তিব্বতের সীমান্ত এলাকা হিলশা থেকে শুরু করে পূর্বের কাঞ্চনজঙ্ঘা বেইজক্যাম্প পর্যন্ত টানা ১৭০০ কিলোমিটার পথকে বলা হয় ‘গ্রেট হিমালয় ট্রেইল’। এই পথ পাড়ি দিয়েছেন দেশের তরুণ পর্বতারোহী ইকরামুল হাসান শাকিল। ৯ জুলাই কাঞ্চনজঙ্ঘা উত্তর বেজক্যাম্প পাংপেমাতে পৌঁছানোর মাধ্যমে অভিযানের ইতি টানেন তিনি। শাকিল এই অভিযানে পাড়ি দিয়েছেন দুর্গম অনেক এলাকা। ছিল প্রাণ সংশয়। শাকিল তার এই অভিযানে নানা প্রতিকুলতার কথা জানিয়েছেন রাইজিংবিডিকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুজাহিদ বিল্লাহ

মুজাহিদ : শাকিল আপনাকে অভিনন্দন। এখন কোথায় আছেন?

শাকিল : আপনাদের দোয়ায় অভিযান শেষ করলাম। বর্তমানে আমি নেপালের কাঠমান্ডুতে আছি। 

মুজাহিদ : আপনার অভিযান কবে শুরু হয়েছিল? কতদিন চলল?

শাকিল : আমার ‘গ্রেট হিমালয় ট্রেইল’ অভিযান শুরু হয়েছিলো উত্তর-পশ্চিমে নেপাল-তিব্বতবর্তী হিলশা গ্রাম থেকে, ২০২২ সালের আগস্টে। দুর্গম মুগু, ডোলপা, মানাং, গোরখা, রুবি ভ্যালি, লাংটাং, হেলাম্বু, গৌরীশঙ্কর, সলুখম্বু, এভারেস্ট বেজক্যাম্প, মাকালু ন্যাশনাল পার্ক হয়ে  উঁচু-নিচু, পাহাড়, অরণ্য, বরফ পাড়ি দিয়ে কাঞ্চনজঙ্ঘা বেজক্যাম্পে এসে এই অভিযান শেষ হয়। অভিযানে হাঁটতে হয়েছে ৯৬ দিন। বিশ্রামসহ সময় লেগেছে ১০৯ দিন। এই অভিযানে মোট ২৯টি পাস অতিক্রম করতে হয়েছে তার মধ্যে ১৪টি ৫ হাজার মিটার উচ্চতার অধিক।

মুজাহিদ : আপনি গ্রেট হিমালয় ট্রেইলকে বেছে নিলেন কেন?

শাকিল : আমরা যারা পর্বতারোহণ করি তারা একেকজন একেক ধরনের অভিযান বেছে নেই। পর্বতারোহণ কিন্তু এক ধরনের স্পোর্টস। এটা কিন্তু পর্বতের উঁচুতে যাওয়ার জন্য এবং পর্বত জয় করার জন্য। এই অভিযানে আপনি হাইকিং পাবেন, ট্রাকিং পাবেন, ক্লাইম্বিং পাবেন। পথ চলতে কখনো মরুভূমি, বরফ, অরণ্য, জঙ্গলের দেখা পাবেন। এই ট্রেইলে সব অ্যাডভেঞ্চার দারুণভাবে উপভোগ করা যায়। আমাদের পর্বতারোহণ করার জন্য উচ্চতাকে মানদণ্ড ধরা হয়। আমরা প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর ৫০০০ মিটার, ৬০০০ মিটার যাই। এরপর আমরা ৮০০০ মিটারে যাই। ৮০০০ মিটার পর্বতারোহণ করা মানে পর্বতারোহণের এলিট ক্লাবে প্রবেশ করা। গ্রেট হিমালয়া ট্রেইল এভারেস্ট অভিযানের চেয়েও কঠিন। এভারেস্ট শুধু উচ্চতার জন্য মৃত্যুঝুঁকি বেশি। কিন্তু আপনি সেখানে সকল সাপোর্ট পাবেন এবং সুবিধা পাবেন। কিন্তু গ্রেট হিমালয় ট্রেইলে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। কারণ এটা খুব দুর্গম এলাকা। এটি বিশ্বের একমাত্র ট্রেইল যেটা সবচেয়ে দুর্গম এলাকা দিয়ে লম্বা ট্রেইল। এটা এখনো ৫০ জনের বেশি মানুষ সম্পন্ন করতে পারেনি। আমি যেহেতু চ্যালেঞ্জ নিতে চাই, অ্যাডভেঞ্চার করতে চাই, দেশকে প্রতিনিধিত্ব করতে চাই তাই এই অভিযান বেছে নেয়। সবাই এখন শুধু এভারেস্ট জয়ের গুরুত্ব দেয়, ৬ বা ৭ হাজার মিটার পর্বতারোহণের গুরুত্ব দেয় না। তাই আমি এটা বেছে নেই যেন ইতিহাসের অংশ হতে পারি।

মুজাহিদ : আপনি বলছেন এটা সবচেয়ে দুর্গম ছিল। ঠিক কী ধরনের দুর্যোগের মুখোমুখী আপনি হয়েছেন? 

শাকিল : এখানে সবসময় দুর্যোগ সঙ্গী হয়েই থাকে। ঝড়-বৃষ্টি সবসময় থাকে। আমি প্রায় চারবার মৃত্যুর মুখোমুখী হয়েছি। এই পর্বতে যারা আরোহণ করেন তারা জানেন এখানে একটা জায়গা রয়েছে এটা হচ্ছে ডু অর ডাই। রাস্তা শেষ হয়ে গেছে এমন একটি জায়গা আপনাকে একদিন যেতেই হবে। আপনি জানছেন যে আপনি সেখানে মারা যেতে পারেন। সেখান থেকে ফিরে নাও আসতে পারেন। এর ভয়াবহতা বলে বোঝানো যাবে না। খুবই ভয়ানক!

মুজাহিদ : তারপরও আপনার মুখ থেকে অভিজ্ঞতার কথা শুনতে চাই। আপনি কীভাবে এটি মোকাবিলা করলেন? 

শাকিল : একবার আমরা জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ট্রেইল করছিলাম সে সময় টানা বৃষ্টি হচ্ছিল এবং প্রচুর তুষার পড়ছিল। আমরা একটা পাহাড় ধ্বসের মধ্যে পড়েছিলাম। হিমালয়ের পাহাড় ধ্বস হলে বড় বড় গাছপালা সব উপড়ে যায়। ভাগ্য ভালো আমরা মারা যাইনি। অনেক ব্যথা পেয়েছিলাম এবং আমার জিহ্বা কেটে গিয়েছিল। আমি একদিন কথাই বলতে পারিনি এবং খেতেও পারিনি। আমার গাইড ব্যথা পেয়েছে এবং আমার সঙ্গে যে মালবাহক ছিল সে সবচেয়ে বেশি ব্যথা পেয়েছিল। তার পায়ের লিগামেন্ট ছিঁড়ে গিয়েছিল। আমরা তাকে নিয়ে নিচে নেমে তার বাড়ি পৌঁছে দেই। এরপর আমাদের নিচ থেকে আবার শুরু করতে হয়।

মুজাহিদ : শুনলাম আপনি এই অভিযানে দুবার বিরতি নিয়েছেন। এর কি কোনো বিশেষ কারণ ছিল?

শাকিল : আমার অভিযানের প্রথম বিরতি দেই গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে। সেই ব্রেক দিয়েছিলাম নেপাল বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক ৫০ বছর পূর্ণ হওয়ায় একটা অনুষ্ঠানে আমরা যাই। বাংলাদেশের চারজন পর্বতারোহী আর নেপালের চারজন পর্বতারোহী মিলে অনুষ্ঠানে অংশ নেই। আমাদের নেতৃত্বে ছিল এভারেস্টজয়ী এম এ মুহিত ভাই। আমাদের দেশের চারজনের মধ্যে তিনজন ঢাকা থেকে আসে এবং আমি সেখান থেকেই যুক্ত হই। আমরা সবাই মিলে তুগারী নামের একটা পর্বতারোহণ করি, যে অভিযানে আমাদের আগে কেউ কখনো অংশগ্রহণ করেনি। আমাদের নাম সেখানের ইতিহাসে থেকে যাবে। আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে ৪৫০০ মিটার পর্যন্ত রাস্তা তৈরিতে সক্ষম হই এবং ফিরে আসি। এরপর ডোমাখান নামে একটা ৬০০০ মিটার পর্বতারোহণ করি। সেটা শেষ করে আমি আবার আমার অভিযানে চলে যাই।
দ্বিতীয় ব্রেকটা আমি আসলে দেই দুইটা কারণে- নেপালে ট্যুরিস্ট ভিসায় ১৫০ দিনের বেশি থাকা যায় না এবং আমার টাকা ফুরিয়ে যায়। টাকা সংগ্রহ করতে দেশে চলে আসি। এরপর পুনরায় নেপাল ফিরে গিয়ে অভিযান শেষ করি। আমি কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি যেমন দারাজ, আমার সংগঠন বিএমটিসি, হামিম গ্রুপসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সাহায্য করেছে। অর্থনীতিবিদ ওয়াহেদ উদ্দিন মাহমুদ এক লাখ টাকা দিয়েছেন। এ ছাড়া অনেকেই ২০ হাজার, ১০ হাজার এমনকি ৫০০ টাকা দিয়েও আমাকে সহায়তা করেছেন। সবার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ।  

মুজাহিদ : সরকার বা ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কেউ কি আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে?

শাকিল : এ রকম কেউ এখনো যোগাযোগ করেনি। আমি প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি পারিনি। এই অভিযান যে দেশের তরুণদের জন্য কতটা অনুপ্রেরণার এটা কাউকে জানাতেই পারছি না। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের কিন্তু একটা ফেডারেশন আছে- বাংলাদেশ মাউন্টেন ফেডারেশন। ফেডারেশন কারা চালায় এটা আমরা পর্বতারোহী কেউ জানি না। এরা আসলে কি কাজ করে তাও জানি না। পদাধিকার বলে এটার সভাপতি কিন্তু ক্রীড়ামন্ত্রী। আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু যোগাযোগ করতে পারিনি। যদিও তিনি আমার এলাকার লোক। আমি সুযোগ পেলে তাকে এই অবদানের কথা জানাতে চাই।

মুজাহিদ : আপনার পরবর্তী অভিযান? 

শাকিল : আমি এভারেস্ট জয় করতে চাই। মেন্টালি এবং ফিজিক্যালি আমি প্রস্তুত। স্পন্সর পেলেই আমি যাত্রা শুরু করব।
 

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়