ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪ ||  অগ্রহায়ণ ২০ ১৪৩১

‘প্রকাশকদের বইমেলার দায়িত্ব দেওয়া হোক’

মুজাহিদ বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪   আপডেট: ১৪:০১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
‘প্রকাশকদের বইমেলার দায়িত্ব দেওয়া হোক’

দেশের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম এবং পুরোনো আহমদ পাবলিশিং হাউসের যাত্রা শুরু ১৯৫৪ সালে। এর প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মহিউদ্দীন আহমদ ১৯৮৪ সালে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র থেকে প্রকাশনা শিল্পে বিশেষ অবদানের জন্য সর্বপ্রথম স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। ১৯৮৬ সালে বাংলা একাডেমি থেকে পান বিশেষ সম্মাননা। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে রয়েছেন তাঁর সন্তান মেজবাহউদ্দীন আহমদ। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুজাহিদ বিল্লাহ

আহমদ পাবলিশিং হাউস দেশের অন্যতম পুরনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। আপনাদের যাত্রা শুরুর গল্পটা শুনতে চাই। 

মেজবাহউদ্দীন : আমার আব্বা প্রথমে কলকাতার বসিরহাটে কবি গোলাম মোস্তফার সঙ্গে যৌথভাবে বইয়ের ব্যবসা শুরু করেন। ‘বসিরহাট বুক ডিপো’ নামে সে সময় শুরু হয় আমাদের বইযাত্রা। এরপর এককভাবে আহমদ পাবলিশিং হাউসের যাত্রা শুরু ১৯৫৪ সালে। পূর্ব পাকিস্তান আমলে; পরবর্তীতে ‘ঢাকা বুক ডিপো’ নামে ইসলামপুরে আমাদের বইয়ের দোকান ছিল। 

আরো পড়ুন:

আপনি কবে থেকে এর সঙ্গে যুক্ত হলেন?

মেজবাহউদ্দীন : আমি এর সঙ্গে যুক্ত ১৯৮০ সাল থেকে। সে বছর ইউনেস্কোর একটা স্কলারশিপের মাধ্যমে আমি সিঙ্গাপুরে যাই প্রিন্টিং পাবলিকেশনের উপর প্রশিক্ষণ নিতে। তার আগে (৭৬ সাল) থেকে আমি বিভিন্ন ধরনের বইমেলায় অংশগ্রহণ করতাম। বাবা আমাকে বিভিন্ন মেলায় পাঠাতেন হাতে-কলমে শেখার জন্য। কিন্তু এরপর পুরোপুরি দায়িত্বে আমি আসি ১৯৮০ সালে।

বইমেলার এই যে বিবর্তন। সেই বাংলা একাডেমির মেলা এবং এই মেলা। কোথায় বেশি বদলেছে বলে মনে করেন?

মেজবাহউদ্দীন :  অনেকেই বলেন যে, চিত্তবাবু মেলাটা শুরু করেছেন। কিন্তু আসলে ঠিক তেমনটা না। এ কথার সঙ্গে আমার দ্বিমত আছে। আমি যতটুকু জানি; হ্যাঁ তিনি উদ্যোক্তা ছিলেন মুক্তধারার, তিনি তো মূলত পুঁথিধারার মালিক ছিলেন, স্বাধীনতার পরে করেন মুক্তধারা। আমার যতটুকু মনে পড়ে, তিনি যখন মেলাটা শুরু করেন ১৯৭২ সাল থেকে তখন তিনি উদ্যোক্তা। তাঁর সঙ্গে আরো ৫-৬ জন পাবলিশার ছিলেন। তার মধ্যে আহমদ পাবলিশিং হাউসও ছিল। আমার মনে আছে, আমি তখন নাইন বা টেনে পড়ি। তখন দেখতাম, চট বিছিয়ে আমরা সবাই মেলাটা শুরু করি বাংলা একাডেমি চত্বরে। সেখান থেকেই বইমেলার যাত্রা শুরু। সেই মেলার পরিধি বেড়েছে। বাংলা একাডেমির  গোল চত্বর পেরিয়ে আমরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করেছি। মেলা এখন আগের চেয়ে সুন্দর ও পরিপাটি। তবে কিছু ত্রুটি আছে, সেদিকে নজর দিতে হবে। মেলায় যে স্টল তৈরি হয়, প্রতিটা পাঠক যেন সবগুলো স্টলের সামনে যেতে পারে সেভাবে একটা ডিজাইন করা উচিত। এবার দেখছি, স্টলগুলো ভিন্ন; অন্যবারের চাইতে একটু ক্লোজ নেয়া হয়েছে। আগে যে একটা গুচ্ছগ্রামের মতো ছিল, এটা এখন নেই। আশাকরি বাংলা একাডেমি এ দিকগুলোতে আরো নজর দেবে। মেলার পরিধি বড় হলেই মেলা সুন্দর হবে বিষয়টা এমন নয়।

একুশে বইমেলা চাইলে প্রকাশকরাও করতে পারে। প্রকাশকদের সমিতি রয়েছে। অনেকে এটা চায় বলেও জানি। আপনি কি এ প্রসঙ্গে একমত?

মেজবাহউদ্দীন :  এটা তো আসলে প্রকাশকদের মেলা। একুশে বইমেলা হওয়া উচিত শুধু প্রকাশকদের। প্রকাশক ছাড়াও মেলাতে অনেকেই অংশগ্রহণ করে। এর অনুমোদন বাংলা একাডেমি কেন দেয় তারাই ভালো বলতে পারবে। আমরা পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির পক্ষ থেকে প্রকাশকরা চাই মেলাটা প্রকাশকরা আয়োজন করুক। আমরা এর আগেও বিভিন্ন ফোরামে বলেছি। এখনো বলছি প্রকাশকদের বইমেলার দায়িত্ব দেওয়া হোক। বাংলা একাডেমি থাকবে কিন্তু মেলাটা যেন প্রকাশকদের মাধ্যমে হয়।

আমাদের প্রকাশনার মান কতটা বেড়েছে বলে আপনি মনে করেন?

মেজবাহউদ্দীন : প্রকাশনার মান আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। তবে অনেক পাবলিশারের নিজস্ব সম্পাদনা বিভাগ নেই। অনেক প্রকাশক, লেখক যখন একটা স্ক্রিপ্ট দেয় তখনই ছেপে ফেলে। এডিটিং, প্রুফ রিডিং ঠিকঠাকভাবে করে না। এটা কেন হয়েছে? কারণ আমরা অনেক প্রকাশক মেলাভিত্তিক বই প্রকাশ করি। মেলা আসলে আগেভাগে সিক্সটি পার্সেন্ট, সেভেন্টি পার্সেন্ট লেখক দেখা যায় যে, মেলার আগেই হয়তো স্ক্রিপটা ধরিয়ে দেয়। তখন আর প্রকাশকরা সেই সময় পায় না। মেলাকে ধরার জন্য তড়িঘড়ি করে অনেকেই বই ছেপে দেয়। এ কারণে বইয়ের মান অনেক সময় ভালো হয় না। 

যখন শুরু করলেন তখন তো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান কম ছিলো। এখন বেড়েছে। তখন ব্যবসা কেমন ছিলো এখন কেমন?

মেজবাহউদ্দীন : প্রকাশক বেড়েছে, বই বিক্রি বাড়েনি। বরং বইয়ের মুদ্রণ কমে গেছে। আমার বাবা যখন ব্যবসা করতেন কিংবা আমিও যখন আশির দশকে করেছি তখন আমরা বই ছাপতাম বারোশো বা পোনে দুই হাজার। এখন অনেক বই আমরা ৩০০ কপি ছাপিয়েও দুই বছরে বিক্রি করতে পারি না। প্রকাশক বেড়েছে কিন্তু পাঠক সে অনুপাতে বাড়েনি। পাঠকের সংখ্যা কমেছে। এত বড় একটা দেশ, ১৬-১৭ কোটি মানুষ, বইতো শেষ হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু বই বিক্রি করতে হিমশিম খাই। 

আপনাদের প্রকাশনা সম্পর্কে জানতে চাই। কী ধরনের বই প্রকাশে আপনারা আগ্রহী? 

মেজবাহউদ্দীন : আমরা আলাদা করে মেলা উপলক্ষে বই প্রকাশ করি না। আমরা বছরজুড়ে বই প্রকাশ করতে চাই। একটা বই হাতে আসার পরে স্ক্রিপ্ট যাচাই-বাছাই করে সম্পাদনা করিয়ে সবকিছু রেডি হলে আমরা একটা শিডিউলে ফেলে দেই, তারপর বইটা প্রকাশ করি। তারপরও প্রতি বছর মেলায় আমাদের আট-দশটা বই নতুন আসে। আমাদের প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় থেকে শুরু করে শিশুদের বই, অনুবাদ, মুক্তিযুদ্ধ, প্রবন্ধ, নাটক সব ধরনের বই আছে। নির্দিষ্ট কোনো গণ্ডিতে আমরা সীমাবদ্ধ নই। তবে জনপ্রিয় লেখক হয়তো কেউ নেই। হুমায়ূন আহমেদ শুরুর দিকে দুই তিনটা বই আমাদের দিয়েছিলেন। এরপর যখন জনপ্রিয় হয়ে গেলেন তখন তিনি অন্যভাবে বই বিক্রি শুরু করলেন। তিনি প্রথমে খান ব্রাদার্স থেকে বই ছাপালেন। তারপর আমরা করি, আরো কয়েকজন করেছিলো। বইটাকে পাঠকের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য হুমায়ূন  আহমেদের একটা বড় অবদান রয়েছে বলে আমি মনে করি। আমাদের এখানে বর্তমানে শিশুসাহিত্য কম। নিবন্ধ, প্রবন্ধ, মুক্তিযুদ্ধ সংখ্যায় বেশি। মনীষীদের জীবনী গ্রন্থ সিরিজ আকারে আমরাই প্রথম প্রকাশ করি। তখন বইয়ের দাম ছিলো চার আনা, আট আনা, এক টাকা। 

লেখক প্রকাশকের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত? আজকাল তো অনেকে টাকা নিয়ে বই প্রকাশ করছে।

মেজবাহউদ্দীন : লেখক প্রকাশকের সম্পর্ক অবশ্যই ভালো হওয়া উচিত। প্রকাশক লেখক ছাড়া বাঁচতে পারবে না, আবার লেখক প্রকাশক ছাড়া তার বই প্রকাশ করতে পারবে না। এসব ঘটনা আমিও শুনি। অনেক নতুন লেখক টাকা খরচ করে হলেও চায় যে তার বইটা মেলায় বের হোক। এখন তো আসলে প্রকাশকরা সংখ্যায় বেশি, আমি নিজেও যেহেতু প্রকাশক, ফলে প্রকাশকদের এভাবে বললে হয়তো খাটো করে দেখা হবে, তাই বলতে চাই না। এখন দেখা যায় যে, দোকানের কর্মচারীও প্রকাশক হয়ে গেছে। তার থেকে আপনি কি আশা করতে পারেন? একজন বাইন্ডারও এখন প্রকাশক হয়ে গেছে। আপনি বইয়ের মান নিয়ে তার কাছ থেকে কি আশা করবেন?

আমাদের সাহিত্যে মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনের সমগ্র ইতিহাস এখনও উঠে আসেনি। এ ধরনের বইয়ের বাজার কাটতি কেমন?

মেজবাহউদ্দীন : আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের উপর আরো বই হওয়া উচিত। এই প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ঐতিহ্য জানাতে আরো বই আসা উচিত। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অনেক কিছুই লেখার আছে। একসময় তো আর এই বিষয়গুলো নিয়ে লেখার লোক থাকবে না। কারণ যারা মুক্তিযুদ্ধ দেখে নাই তারা তো ওই জিনিসটা ওভাবে লিখতে পারবে না। তাই এখনও যারা অনেক মুক্তিযোদ্ধা বেঁচে আছেন, তাদের কাছ থেকে ইতিহাস শুনে রণাঙ্গনের দিনগুলো লেখা উচিত। আমাদের প্রতিষ্ঠান এ বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন। আমাদের এখানে মুক্তিযুদ্ধের পাণ্ডুলিপি এলে সাদরে গ্রহণ করি।
 

তারা//

সম্পর্কিত বিষয়:


সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়