গান শুনলে কি রোজা নষ্ট হয়?
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন || রাইজিংবিডি.কম
গান শুনলে কি রোজা নষ্ট হয়? এই প্রশ্ন অনেকেই করেন। এটি একটি ব্যাখ্যাযোগ্য বিষয়। গান গাওয়া বা শোনা দুটো বিষয় নিয়েই এ ক্ষেত্রে আলোচনা হতে পারে।
যদি কোনো মেয়েলি কণ্ঠে গান গাওয়া হয়, আর সে যদি শ্রোতার জন্য মাহরাম হয়, তাহলে তার গান ব্যক্তিগত বা ব্যক্তিবিশেষের জন্য শোনা বৈধ। আর যদি শ্রোতা মাহরাম না হয়, অর্থাৎ যে গান গাইছে ‘তাকে ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে বিয়ে করার ক্ষেত্রে বাধা নেই’ সেই ক্ষেত্রে মাহরাম নয় এমন কোনো শ্রোতার জন্য তার গান শোনা বৈধ নয়।
মহিলাদের কণ্ঠে গান গাওয়ার বিষয়ে ইসলামী শরীয়তের নির্দেশনা এমনই। কারণ ইসলামের রীতিনীতি অনুযায়ী মহিলাদের (সুরেলা) কণ্ঠ প্রকাশ করা দোষণীয় ব্যাপার, গুনাহের কাজ। পরপুরুষের সঙ্গে মহিলাদের নরম ভাষায় কথা বলতে নিষেধ করা হয়েছে। কুরআনে এ প্রসঙ্গে বিশেষ নির্দেশনা এসেছে (সূরা আহযাব, আয়াত-৩২)। অতএব মহিলাদের কণ্ঠে গান গাওয়া এবং মাহরাম ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে এই গান শোনা সম্পূর্ণ গুনাহের কাজ।
যেহেতু রোজা ইসলামের একটি অন্যতম স্তম্ভ এবং গান শুনলে রোজা নষ্ট হয়ে যাবে কিনা এ প্রসঙ্গে কথা বলতে হচ্ছে, সেজন্যই ইসলামের রীতিনীতি অনুযায়ী কথাগুলো বলা হলো। আমাদের সমাজে বিষয়টির গুরুত্ব কম। ফলে মহিলা কণ্ঠ বিভিন্নভাবে প্রচার করা হয়। বিষয়টি ইসলামী শরীয়তে ঢালাওভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।
এবার আসা যাক গায়ক যদি পুরুষ হয়, তাহলে তার কণ্ঠে যে গান গাওয়া হয়, সেগুলি কি শোনা রোজা অবস্থায় বৈধ? হ্যাঁ, রোজা অবস্থায় পুরুষ কণ্ঠে গান শোনা যাবে, তবে একটি শর্ত আছে; সে শর্তটি হচ্ছে গানের কথাগুলো কেমন এটা আগেভাগেই নির্ধারণ করতে হবে। গানের কথাগুলো অশ্লীল কিনা, নির্লজ্জ কিনা, যৌন উদ্দীপক কিনা, শিরক-বিদআতের ধারক-বাহক বা প্রচারক কিনা, কথাগুলো কারও প্রতি হিংসামূলক কিনা, আক্রমণাত্মক কিনা, এ কথার মাধ্যমে সমাজে শৃঙ্খলা নষ্ট হবে কিনা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। এমন যদি হয়, সেই গান কোনোক্রমেই গাওয়া বা শোনা এবং প্রচার করা যাবে না- এটা মহাপাপ। চাই তা রোজা রেখে হোক বা অন্য সময়ই হোক।
অন্যদিকে গানের কথা যদি এর বাইরে হয়, অর্থাৎ কোনো গান স্মৃতি রোমন্থনের বিষয়ে করা হয়, দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলার জন্য করা হয়, সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে গাওয়া হয়, সৎভাবে বন্ধুত্ব স্থাপনের উদ্দেশ্যে বলা হয়, সৎ কাজের আদেশ দেয়ার জন্য গাওয়া হয়, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করার জন্য গাওয়া হয়, ভালো কাজের দিকে আহ্বান করার উদ্দেশ্যে গাওয়া হয়, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সা. এর প্রতি বিশ্বাস স্থাপনের জন্য গাওয়া হয়- তাহলে সেই গান লেখা, গাওয়া, শোনা, চর্চা করা এবং এর প্রচার-প্রসার করা যাবে। এই জাতীয় গান রোজা অবস্থায় শুনলে কখনোই রোজা নষ্ট হবে না।
গানের কথা যেহেতু চলেই এলো, শিশু বা অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরীদের কণ্ঠে গান শোনা যাবে। তবে এত কিছুর পরেও যদি রোজা অবস্থায় অশ্লীল বা শিরক যুক্ত অথবা আক্রমণাত্মক, হিংসাত্মক গান কেউ শোনে, তার মাধ্যমে রোজা নষ্ট হবে না। তবে রোজার যে ফজিলত রয়েছে, তা অনেকাংশে কমে যাবে। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা এবং অশ্লীল কথা বলা ও সেই অনুযায়ী আমল করা থেকে দূরে থাকতে পারে না, তার পানাহার থেকে বিরত থাকার কোনো প্রয়োজন আল্লাহর কাছে নেই।’ (বুখারী শরীফ, হাদিস নং -১৯০৩, সুনান তিরমিযী, হাদিস নং - ৭০৭)। অর্থাৎ তার রোজাব্রত পালন করায় আল্লাহর কোনো দরকার নেই।
অন্যদিকে হানাফী মাযহাবের ফকিহদের বক্তব্য অনুসারে, এই জাতীয় অশ্লীল, যৌন উদ্দীপক, হিংসামূলক, আক্রমণাত্মক যে সমস্ত গান রয়েছে এগুলো শোনা ফাসিক হওয়ার সমতুল্য। যদি গানের সঙ্গে মিউজিক থাকে তাহলে এই জাতীয় গানগুলোর ব্যাপারে, দুই ধরনের অভিমত রয়েছে। কিছু কিছু আলিম এবং ফকিহগণ শুধু ‘দফ’ বা একদিকে আটকানো ঢোল জাতীয় যে বাদ্যযন্ত্র রয়েছে, সেটার মাধ্যমে গান গাওয়া হলে ওই গান শোনা বৈধ বলেছেন। এ ছাড়া অন্যান্য যন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে যদি গান গাওয়া হয় সেটা কোনোক্রমেই বৈধ নয়।
অন্য আলিম ও ফকিহদের মতানুসারে, হালকা বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে শোকাবহ অবস্থা সৃষ্টি হলে, আবেগঘন প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি হলে, সেই হালকা বাদ্যযন্ত্রের গান শোনা যেতে পারে। তবে সেই ক্ষেত্রে কথাবার্তাগুলো যাতে অশ্লীল না হয়, যৌন উদ্দীপক না হয় সেদিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন।
আমরা শুধু মানসিক প্রশান্তির জন্য গান না শুনে, পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করতে পারি, রোজার দিনে ভালো কিছু বক্তব্য শুনতে পারি, হাদিস পাঠ করতে পারি। সময়ের অপচয় না করে, গানের পিছনে সময় না দিয়ে, ভালো কাজে সময় কাটাতে পারি। তাহলে আমাদের রোজা পূর্ণতা পাবে। এক্ষেত্রে গান শুনে সময় নষ্ট না করাই ভালো।
তবে একান্তই যদি গান শুনতে হয় তাহলে ভালো কথা সম্বলিত, অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করা হয় এমন, ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রতকারী কথা সম্বলিত, পরকালের বিষয় মনে করিয়ে দেয়- এ জাতীয় কথার গানগুলো হালকাভাবে শোনা যেতে পারে। কেননা রোজার উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর কাছে পরহেজগার বা মুত্তাকী তৈরি করা। আমাদের মাঝে আল্লাহ-ভীতি জাগিয়ে তাকওয়া অর্জন করার জন্য মহান রবের কাছে তাওফিক কামনা করছি। আমিন!
লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক ও মাসিক পত্রিকা সম্পাদক
ঢাকা/তারা