ঢাকা     শনিবার   ২৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৪ ১৪৩১

ভ্রমণকালে রোজা রাখার বিধান

প্রকাশিত: ১৭:২১, ১১ মে ২০২১   আপডেট: ১৭:২৭, ১১ মে ২০২১
ভ্রমণকালে রোজা রাখার বিধান

প্রথমত ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে সফর কী? কিংবা মুসাফির কে? বিষয়টি স্পষ্ট হওয়া দরকার। নিজের বসবাসের স্থায়ী জায়গা থেকে কমপক্ষে ৮০ কিলোমিটার দূরে কেউ ভ্রমণ করলে এবং সেখানে ১৫ দিন বা তার চেয়ে কম অবস্থানের নিয়ত করলে সে মুসাফির। এই বিষয়টিতে উলামাদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ বলেছেন, নিজের দেশ থেকে অন্য একটি দেশে গেলে মুসাফির হিসেবে পরিগণিত হবেন। আবার কেউ বলেছেন, নিজের একটি এলাকা থেকে অপর একটি এলাকায় ভ্রমণ করলেই মুসাফির হিসেবে পরিগণিত হবেন। তবে যদি ১৫ দিনের বেশি অবস্থানের নিয়ত বা সংকল্প স্থির করা হয়, তাহলে সে আর মুসাফির নয়। এই ক্ষেত্রে তার ভ্রমণের সময়টুকু সে মুসাফির কিন্তু তার গন্তব্যে পৌঁছার পর সে আর মুসাফির থাকবে না। একইভাবে একজন ব্যক্তির দু’টি বাড়ি রয়েছে, ধরা যাক চট্টগ্রামে একটি বাড়ি রয়েছে, ঢাকায়ও তার একটি বাড়ি রয়েছে; সে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় যখন যাত্রা করবে, তখন সে মুসাফির, কিন্তু ঢাকায় যখন সে তার আবাসস্থলে পৌঁছে যাবে, তখন সে মুসাফির থাকবে না বরং মুকিম বা স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে পরিগণিত হবে।
মুসাফিরের জন্য রোজা অবস্থায় সিয়াম পালন করার বিষয়ে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা পবিত্র কালামে পাকে বর্ণনা করেছেন, আল্লাহ বলেন, “রমজান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে, মানুষের জন্য হেদায়াত স্বরূপ এবং হেদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী, সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী রূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে এই মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে। আর যে অসুস্থ হবে অথবা সফরে থাকবে তবে অন্যান্য দিবসে সংখ্যা পূরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান এবং কঠিন চান না। আর যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ করো এবং তিনি তোমাদেরকে যে হেদায়াত দিয়েছেন তার জন্য আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর। যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।’’ (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৫)

এই দীর্ঘ আয়াতটিতে রমজান মাস এলে রোজা রাখার যেমন বিধান দেয়া হয়েছে, তেমনি কেউ যদি সফরে থাকে তাহলে তাকে ছাড় দেয়া হয়েছে অর্থাৎ মুসাফির অবস্থায় সক্ষম হোক অথবা অক্ষম হোক, সফরে কষ্ট হোক বা আরাম হোক, সেখানে মুসাফির হলেই তার জন্য রোজা না রাখার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে ১৫ দিনের কমের যে সফর, যেমন ব্যবসা-বাণিজ্যের সফর, হজ্ব বা উমরা আদায়ের  সফর, এক দেশ থেকে আরেক দেশে প্রয়োজনীয় কাজে ভ্রমণের জন্য সফর অথবা টুরিস্ট হিসেবে ভ্রমণের জন্য সফর ইত্যাদি ক্ষেত্রে রোজা না রাখাই উত্তম। এ ক্ষেত্রে আনাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু এর একটি হাদিস স্মরণযোগ্য, আনাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহুকে সফর অবস্থায় রোজা রাখার বিষয়টি জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “যে রোজা রাখবে না, সে অবকাশ গ্রহণ করল, আর যে রোজা রাখল, সে উত্তম কাজ করলো।’’ আবার জাবির ইবন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “সফর অবস্থায় রোজা রাখার মধ্যে পুণ্য নেই।’’ (সহীহুল বুখারী, হাদিস নম্বর ১৯৪৬০)

মুসাফির দু’রকমের। একটু আগে যাদের কথা উল্লেখ করা হলো তারা এক ধরনের মুসাফির, আবার বেশির ভাগ সময়ই সফরে থাকে, তারাও মুসাফির। যেমন যারা জাহাজে কাজ করেন, নাবিক থেকে শুরু করে অন্যান্য ক্রুসহ জাহাজের কর্মীরা, বিমানের পাইলট এবং তার সাথের ক্রুরা, দূরপাল্লার বাস অথবা অন্যান্য যানবাহনের চালক ও তার হেলপাররা, বেশিরভাগ সময়ই সফরে থাকেন। এমতাবস্থায় রোজা এসে গেলে তাদের কি করা উচিত? বেশিরভাগ সময় যারা সফরে থাকেন, তাদের সফর অবস্থায় রোজা রাখাই ভালো। তবে যদি তারা রোজা না রাখতে চায় তাহলে তাদের রোজা না রাখার সুযোগ রয়েছে। এই ক্ষেত্রে রোজা রাখার কারণে স্বাস্থ্যহানি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, রুগ্ন হয়ে পরার সম্ভাবনা থাকলে, খুব বেশি পিপাসার্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে, রোজা ছেড়ে দেয়ার সুযোগ রয়েছে।

এই প্রসঙ্গে আবদুল্লাহ ইবন উমর রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত একটি হাদিস এখানে উল্লেখযোগ্য। তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, “আল্লাহ তার অবকাশ বা ছাড় দেয়া কাজগুলো কার্যকরী করা পছন্দ করেন, যেমনি তিনি তার প্রতি অবাধ্যতামূলক কাজ করাকে অপছন্দ করেন।’’ (মুসনাদ আহমদ, হাদিস নম্বর ৫৮৬৬)

এ হাদিসের মাধ্যমে যেখানে যেখানে আল্লাহ ছাড় দিয়েছেন সেগুলোর সুযোগ গ্রহণ করার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে, তবে বিষয়টি এমন না হয়ে কোনো রকম চালাকি হলে সে ক্ষেত্রে এই সুযোগ না গ্রহণ করাই ভালো। যেমন, একজন ব্যক্তি রোজা থেকে অবকাশ বা ছাড় পাওয়ার জন্য রমজান মাসেই বেশিরভাগ সফরগুলোর শিডিউল তৈরি করে রেখেছেন, এই লোকটির ব্যাপারে বিধান কী? সফর করলে রোজা রাখা লাগবে না, সে জন্য কেউ যদি এই মাসেই ঘুরেফিরে সফরের ওপর কাটানোর চেষ্টা করে, তাহলে এই অবস্থায় তার রোজা ছাড়া উচিত হবে না। কোন কোন আলিমের মতে তার রোজা ছেড়ে দেয়া বৈধ নয়। তবে হ্যাঁ, কেউ যদি ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে, উমরা আদায়ের ব্যাপারে, অথবা প্রয়োজনীয় সরকারি বা বেসরকারি কোনো সফরের কারণে, বিদেশে বা কোথাও যেতে হয়, তাহলে সে বিষয়টি ভিন্ন।

একজন রোজাদার সফর উপলক্ষে রোজা ছেড়ে দিলো; দিনের বেশ কিছু সময় থাকতেই সে সফর থেকে ফিরে এলো এবং মুকিম অবস্থায় উপণীত হলো, এমতাবস্থায় এখন বাকি সময় সে কি করবে? এমতাবস্থায় তার উচিত বাকি সময় পানাহার থেকে বিরত থেকে ইফতার পর্যন্ত অপেক্ষা করা, এটা যেখানে সে মুকিম অবস্থায় রয়েছে সেখানের এবং রোজাদারদের সম্মান রক্ষার্থে, তা সম্ভব না হলে, প্রকাশ্যে পানাহার থেকে অন্তত দূরে থাকবে। তবে যেহেতু সে রোজা ছেড়ে দিয়েছিল সেহেতু তাকে পরবর্তীতে রোজা কাযা আদায় করে নিতে হবে। একইভাবে একজন ব্যক্তি সফর অবস্থায় রোজা শুরু করল, মাঝপথে এসে, সে কি রোজা ভেঙে ফেলবে না কি তা চালিয়ে যাবে? এই ক্ষেত্রে সে রোজা ভাঙবে না। তবে রোজা রাখলে স্বাস্থ্যহানির সম্ভাবনা থাকলে অথবা খুবই পিপাসিত হয়ে পড়লে সে রোজা ছেড়ে দিতে পারে, ভাঙতে পারে, তবে তাকে কাযা আদায় করে নিতে হবে।

একজন ব্যক্তি তার নিজের দেশে রোজা শুরু করেছে, হিসেব মতো তার দেশে যেই তারিখে রোজা শেষ হবে, অন্য দেশে সফর করার কারণে সেই তারিখের পরে রোজা শেষ হচ্ছে, এই ক্ষেত্রে এই ব্যক্তি কী করবে? এমন অবস্থায়, সফরকারী ব্যক্তি যেই দেশে সফর করছে, সেই পরিবেশের সাথে মিলিয়ে রোজা রাখতে হলে রাখবে, অথবা রোজা ছাড়তে হলে ছাড়বে। অর্থাৎ তখন সে ওই পরিবেশের বিধানের আওতায় পড়ে যাবে।

অনেকে বলেন, আমার সামনে পরীক্ষা রয়েছে, পরীক্ষার পড়াশোনা করার জন্য আমার পক্ষে রোজা রাখা কষ্টকর। কিংবা কেউ কেউ বলেন, আমি মাঠে-ময়দানে কঠোর পরিশ্রম করছি, কনস্ট্রাকশনের কাজ করছি, আমার কাজের প্রকৃতি অনুসারে রোজা রাখা আমার জন্য কষ্টকর। আবার কেউ যদি বলে যে, আমি কয়লা খনিতে অথবা কোনো তেলের খনিতে কাজ করছি, এখানে রোজা রাখা আমার জন্য কষ্টকর ইত্যাদি, এ জাতীয় অবস্থার ক্ষেত্রে বলা যায় যে, এমতাবস্থায় রোজা পরিত্যাগ করা যাবে না। কারণ এ বিষয়গুলোর সাথে রোজা পরিত্যাগ করার সম্পর্ক নেই। আল্লাহ ভালো জানেন।
 
সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ চান মানুষকে মুত্তাকী বা তার পরহেজগার হিসেবে তৈরী করার জন্য। তার নিয়ত কি রয়েছে, বা ইচ্ছা কি রয়েছে, অন্তরে কি গোপন রয়েছে, সে বিষয়টি সে জানে এবং আল্লাহও জানেন। অতএব সে কি রোজা ছাড়া বা না ছাড়ার জন্য বাহানা করছে, নাকি সত্যিকারে সমস্যায় পরে রোজা ছেড়ে দিচ্ছে, সে বিষয়টি আল্লাহর বিবেচনায় ছেড়ে দিতে হবে।

মোটকথা সফর আরামদায়ক হোক, আর কষ্টদায়ক হোক, সক্ষম ব্যক্তির জন্য হোক, আর অক্ষম ব্যক্তির জন্য হোক, সফর অবস্থায় রোজা ছেড়ে দেয়ার সুযোগ রয়েছে এবং পরবর্তীতে রমজানের বাইরে যে কোনো সময়ে তাকে এই রোজা কাযা আদায় করে নিতে হবে। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিকভাবে জেনে বুঝে তার ইবাদত করার তাওফীক দান করুন। আমীন!

লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক ও মাসিক পত্রিকা সম্পাদক।

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়