ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

উপজেলা ভোট  

পদে থাকা প্রার্থীদের আয় ও সম্পদ বে‌ড়ে‌ছে দ্বিগু‌ণের বে‌শি

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ২১:৩৪, ১৯ মে ২০২৪   আপডেট: ২২:০৩, ১৯ মে ২০২৪
পদে থাকা প্রার্থীদের আয় ও সম্পদ বে‌ড়ে‌ছে দ্বিগু‌ণের বে‌শি

উপজেলা নির্বাচনে জয়ী হয়ে সম্পদ অর্জন ও সম্পদ বাড়া‌নোই প্রার্থীদের মূল লক্ষ্য হ‌য়ে দাঁড়িয়েছে। গত পাঁচ বছরে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীদের সঙ্গে নির্বাচিত হননি এমন প্রার্থীদের তুলনায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের আয় ও সম্পদ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। শুধু নির্বাচিতদের নিজেদেরই নয়, পাল্লা দিয়ে বে‌ড়ে‌ছে স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের আয় ও সম্পদ ।

৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের (২য় ধাপ)-এর প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য বিশ্লেষণ ক‌রে এমন তথ‌্য প্রকাশ ক‌রে‌ছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।

রোববার (১৯ মে) টিআইবির ধানম‌ন্ডিস্থ কার্যাল‌য়ে এক সংবাদ স‌ম্মেল‌নে প্রার্থী‌দের হলফনামা ও পর্য‌বেক্ষণ তু‌লে ধরেন সংস্থাটির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সহ সমন্বয়ক ইকরামুল হক ইভান।

টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক ও গবেষণা দলের প্রধান মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলামের সঞ্চালনায় সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা নির্বাহী ব্যবস্থাপনা ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা দলের সদস্য ও আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের সহ-সমন্বয়ক রিফাত রহমান ও কে. এম. রফিকুল আলম।

চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ১৫৭টি উপজেলার প্রায় ৫ হাজার ৪১২টি হলফনামায় দেওয়া আটটি তথ্যের বহুমাত্রিক ও তুলনামূলক বিশ্লেষণ, সার্বিক চিত্র, উপজেলাভিত্তিক তুলনা টিআইবির ওয়েবসাইটে ‘হলফনামায় প্রার্থী পরিচিতি’ ড্যাশবোর্ডে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে।

প্রার্থীদের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গে‌ছে, ক্ষমতায় থাকার সাথে সা‌থে নির্বা‌চিত প্রার্থীদের ম‌ধ্যে দ্রুত আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

যারা পদে ছিলেন এমন প্রার্থীদের গত দশ বছরের হিসাবে তুলনা করলে দেখা যায়, পদে থাকা প্রার্থীদের আয় ও অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে যথাক্রমে ৫৪০.৬৮ শতাংশ ও ২১১.৯৮ শতাংশ। পদে না থাকাদের এক্ষেত্রে আয় ৫৬.৪৭ শতাংশ বাড়লেও, সম্পদ কমেছে ৪৫.৪৪ শতাংশ।

পাঁচ বছরে আয় বেড়েছে ১৪০.৬১ শতাংশ, অন্যদিকে যারা পদে ছিলেন না তাদের আয় বেড়েছে ৭৭.৪৪ শতাংশ। একইভাবে এ সময়কালে পদে থাকা প্রার্থীদের অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে ২৩১.৬২ শতাংশ এবং যারা পদে ছিলেন না তাদের বেড়েছে ১০০.৩৩ শতাংশ। এক্ষেত্রে শুধু নির্বাচিতদের নিজেদেরই নয়, স্ত্রী ও নির্ভরশীলদের আয় ও সম্পদ বেড়েছে পাল্লা দিয়ে।

সংস্থাটির পক্ষ থেকে আরও বলা হয়, ক্ষমতায় থাকার সঙ্গে অর্থ-সম্পদ বিকাশের সুবিধাজনক সুযোগের কারণে জনপ্রতিনিধি হওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিরাজ করছে।

হলফনামা বিশ্লেষণে দেখা যায়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও ব্যবসায়ী প্রার্থীদের দাপট চলমান। ব্যবসায়ী প্রার্থীদের সংখ্যা চতুর্থ নির্বাচনের তুলনায় ৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৭০.৫১ শতাংশই ব্যবসায়ী। ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের প্রায় ৬৮.৭৩ শতাংশ, নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ২৯.২৬ শতাংশ ব্যবসাকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীদের ৫১.৬৩ শতাংশই নিজেকে গৃহিণী হিসেবে উল্লেখ করেছেন অথবা গৃহস্থালির কাজকে পেশা হিসেবে দেখিয়েছেন। তবে, গৃহিণী/গৃহস্থালিকে পেশা হিসেবে দেখানো প্রার্থীদের ১৪.৫৫ শতাংশের আয় আসে ব্যবসা থেকে।

বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, সার্বিকভাবে প্রার্থীদের ৪২ শতাংশই আয় দেখিয়েছেন সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে, অর্থাৎ করযোগ্য আয় নেই তাদের। সাড়ে ১৬ লাখ টাকার বেশি আয় দেখিয়েছেন মাত্র ১০ শতাংশ প্রার্থী। চেয়ারম্যান ও অন্যান্য প্রার্থীদের মাঝে উল্লেখযোগ্য আয় বৈষম্য লক্ষ্য করা গেছে। চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২১ শতাংশ প্রার্থীদের আয় সাড়ে তিন লাখ টাকার নিচে, যেখানে অন্যান্য প্রার্থীদের ক্ষেত্রে তা ৫৩ শতাংশ। একইভাবে চেয়ারম্যান প্রার্থীদের প্রায় ২৩.৬২ শতাংশের আয় সাড়ে ষোল লাখ টাকার উপরে। অন্যান্য প্রার্থীর ক্ষেত্রে তা মাত্র ৩.২৫ শতাংশ। অর্থাৎ চেয়ারম্যান পদে অপেক্ষাকৃত ধনীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তা ছাড়া, সার্বিকভাবে দ্বিতীয় ধাপের প্রার্থীদের মধ্যে ১১৬ জনের ১ কোটি টাকা বা তার বেশি সম্পদ রয়েছে। কোটিপতির সংখ্যা আগের নির্বাচনের তুলনায় হয়েছে তিনগুণের বেশি।

দ্বিতীয় ধাপের প্রার্থীদের হলফনামার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, পাঁচ বছরে একজন প্রার্থীর আয় বেড়েছে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৯০০ শতাংশ, অস্থাবর সম্পদ বেড়েছে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ৬৬৬ শতাংশ। দশ বছরে একজন প্রার্থীর আয় বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ ৫ হাজার ৩৩৬ শতাংশ। পাঁচ বছরে অস্থাবর সম্পদ বৃদ্ধিতে স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিরা পেছনে ফেলেছেন সংসদ সদস্যদের। সংসদ নির্বাচনে একজন সংসদ সদস্যদের সম্পদ বৃদ্ধির হার ছিলো সর্বোচ্চ ৩ হাজার ৬৫ শতাংশ, সেখানে একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থীর সম্পদ বেড়েছে ১১ হাজার শতাংশের বেশি। তাছাড়া, আইনি সীমা বা ১০০ বিঘা বা ৩৩ একর এর বেশি জমি আছে ৪ জন প্রার্থীর।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংরক্ষিত পদ ছাড়া প্রার্থীদের মধ্যে নারীর হার দুই শতাংশেরও কম। অন্যদিকে জাতীয় পর্যায়ের মতোই ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য প্রায় একচ্ছত্র। একইভাবে, একদলীয় আধিপত্যের বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে, যেমন বাড়ছে স্থানীয় পর্যায়ে পরিবারতন্ত্র। সব জনপ্রতিনিধি দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন, তাদের আয় ও সম্পদ বৃদ্ধির প্রবণতাও স্পষ্ট উল্লেখ করে ড. জামান আরও বলেন, যারা আগে থেকেই নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছিলেন তাদের আয়-সম্পদ বৃদ্ধি যারা জনপ্রতিনিধি ছিলেন না তাদের থেকে বহুগুণ বেশি। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, কেন জনপ্রতিনিধি হওয়ার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা বিরাজ করছে। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচিত হওয়ার মূল আগ্রহের জায়গা অনেক ক্ষেত্রেই জনগণের কল্যাণ থেকে সরে গিয়ে নিজের সম্পদ বৃদ্ধিতে স্থির হয়েছে। তা ছাড়া, অস্বাভাবিক সম্পদ বৃদ্ধির যে চিত্র হলফনামার তথ্য থেকে দেখা গেছে, সেগুলো তাদের বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কি-না এবং সম্পদ অর্জন বা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার হয়েছে কি-না, তা যাচাই করার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ সে দায়িত্ব পালনে কোনো আগ্রহ দেখায় না। অন্যদিকে, হলফনামায় যে তথ্য দেওয়া হয়, তা কতটুকু পর্যাপ্ত ও নির্ভরযোগ্য তা-ও খতিয়ে দেখা হয় না।

নির্বাচনে জনস্বার্থের পাশাপাশি দলীয় আদর্শ কিংবা দলীয় শৃঙ্খলার বিষয়গুলো উপেক্ষিত উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, দুই ধাপেই আমরা দেখলাম, বড় দুই রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই দলীয় নির্দেশনা প্রতিপালনের বিষয়টি অনুপস্থিত। তদুপরি, বৃহৎ দল দুটি দলীয় শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারছে না। কারণ, স্থানীয় নেতৃত্বের কাছে সম্পদ অর্জনের লাইসেন্স পাওয়াই এখানে মূল উদ্দেশ্য। সার্বিকভাবে, এই নির্বাচনের লড়াই একদিকে যেমন অসুস্থ, অগণতান্ত্রিক, আত্মকেন্দ্রিক অন্যদিকে জনগণ বা জনকল্যাণের সঙ্গে এর সম্পর্ক ক্রমাগত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে।

নঈমুদ্দীন/এনএইচ

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়