ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

টিকা মেরে বাড়ি দান

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:৫৬, ২৬ জানুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১৬:৫৭, ২৬ জানুয়ারি ২০২১
টিকা মেরে বাড়ি দান

আমার পিতা গ্রামের জায়গা-জমি’র বাইরে আর কোনো কালে জমি কিনে বাড়ি করতে পারেন নি। আমার মতো কোটি কোটি বাংলাদেশী শহরের ভাড়া বাড়িতে বড় হয়েছেন। দেশ স্বাধীন হবার পর আমরা ছিন্নমূল মানুষদের আশ্রয় নিতে দেখেছি সিঁড়ির পাশে বা ঘরের বাইরে খালি এক কোণা জায়গায়; তারা থেকেছেন বছরের পর বছর। বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর বাংলাদেশে পাকিস্তানি-করণের জোশ আর গণতন্ত্র নামের সোনার হরিণের প্ররোচনায় রাজনীতি উন্নয়ন বা মানুষের কথা মনে রাখে নি।প্রগতিশীলতার জন্য তখন সময় ছিল কঠিন। তাই তারাও মনে রাখতে পারেন নি। তাদের তখন এক চিন্তা, এক ধ্যান- কীভাবে আবার দেশকে বাংলাদেশের মূলধারায় ফিরিয়ে আনা যায়?

অন্যদিকে যারা সরকারে বা গদীতে, যাদের গাড়িতে পতাকা, সামনে-পেছনে পুলিশের গাড়ি, তাদের মনে অন্য ধান্দা। তারা প্রতিবেশী ভারত বিরোধিতার নামে তলে তলে তাদের সাথে গোপন সম্পর্ক তৈরি করে, ব্যবসা বিলিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নব্য পাকি কায়দায় দেশের চেহারা বদলাতে ব্যস্ত। তখন মানুষ কি গাছ তলায় না পাঁচ তলায় থাকেন কেউ খবর রাখতো না। সামরিক শাসকেরা তাদের জয়গান আর তাদের ব্যক্তিগত উন্নতির ফিরশতি দিতেই ব্যস্ত সময় কাটাতেন।

দিন পাল্টেছে। সত্যি যে পাল্টেছে তার প্রমাণ পেলাম। যা কোনোদিন আশা করা যায় নি, তাই হচ্ছে বাংলাদেশে। শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন মুজিববর্ষে তিনি গৃহহীন বাংলাদেশী দেখতে চান না। এটা মানি, এই বিশাল জনসংখ্যার দেশে সবাইকে বাড়ি দেওয়া অসম্ভব। তারপরও তালিকাভুক্ত প্রায় নয় লাখ পরিবারের মধ্যে প্রথম দফায় জমিসহ ৬৬ হাজার ১৮৯টি ঘরের মালিকানা বুঝিয়ে দেওয়া হলো শনিবার। এই সংখ্যা ব্যাপক। সত্যি বলতে কি- আনন্দে আমাদের বুক ভরে গেছে!

বঙ্গবন্ধু কন্যা যা বলেন, করে দেখান। কিন্তু বাধ সাধে তাকে ঘিরে রাখা স্তাবক আর চামচার দল। রাজনীতিতে একতরফা খেলাধুলায় এরা এখন এতটাই বেপরোয়া, আপনি নোয়াখালীর দিকে তাকালেই টের পাবেন। শেখ হাসিনার সরকারের যাবতীয় অর্জন আর সুনামের বিরুদ্ধে এখন মাঠে বিরোধী দলের দরকার পড়ে না। সরকারী দলের খাইখাই নেতারাই যথেষ্ট। তারা এখন খোদ সাধারণ সম্পাদককে ডাকছে রাজাকার পরিবারের লোক বলে! এদের হাতে কি সমাজ আসলেই নিরাপদ? নিরাপদ কি শেখ হাসিনার দেওয়া টিকা বা বাড়িঘর?

এ সপ্তাহের সংবাদ শিরোনামে আছে: শেখ হাসিনা বাড়ি উপহার দেওয়ায় আনন্দ-বন্যা বইছে দেশে। এই আনন্দের সঙ্গে আরেকটি বিষয় হচ্ছে স্বস্তির। সেই স্বস্তির নাম টিকা। করোনা মহামারিতে সারা দুনিয়ার হাল টালমাটাল। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, চীন, রাশিয়ার মতো পরাশক্তি এর ভয়ে কাবু! কীভাবে এ থেকে পরিত্রাণ সম্ভব কেউ এখনো নিশ্চিত নন। তবু মানুষ ও বিজ্ঞান থেমে নাই। থেমে নাই সভ্যতা। দেশে দেশে টিকা আবিষ্কারের জন্য ঘুম হারাম করা বিজ্ঞানী গবেষকরা বলছেন- তারা কূল খুঁজে পেয়েছেন। সে আশার আলো জাগানো অক্সফোর্ডের করোনার টিকার ফর্মূলায় ভারতে তৈরি টিকার উপহার পৌঁছে গেছে দেশে। এরপর আসছে বেক্সিমকো আমদানীকৃত ভারতীয় টিকা। কিন্তু তার আগেই শুরু হয়ে গেছে নানা গুজব আর জল্পনা-কল্পনা। আমরা গুজবে বিশ্বাসী এক জাতি। তার মধ্যে ভারত যদি জড়িত থাকে তো, সেই গুজব ডালপালা ছড়াতে সময় নেয় না। দেশ স্বাধীনের পর থেকে এ পর্যন্ত ভারত বিরোধীতা কমতে দেখি নি। এখন তা বেশ চূড়াতেই। টিকা দেওয়ার পর আর কী কী গুজব শোনা যাবে সেটা ভাবাও অসম্ভব। আমি নিশ্চিত এক শ্রেণীর সুবিধাবাদীরা এর ভেতরও হারাম-হালাল আবিষ্কার না করে ছাড়বে না! এর প্রভাবে গ্রামেগঞ্জে মানুষ আদৌ টিকা নেবে কি না তাও আশঙ্কার বিষয়।

মজার ব্যাপার হলো, মানুষের মনে আস্থা তৈরির পরিবর্তে আর একদল ‘বিশিষ্ট’ নামে পরিচিত মানুষ নেমেছেন কৌতুকের ডালি নিয়ে। আমাদের ওষুধ শিল্পে গণস্বাস্থ্যের ভূমিকা স্মরণীয়। তাদের করোনাকালীন কাজকর্ম ছিলো কৌতূহলের। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও বিজন শীল বহুবার সংবাদ শিরোনাম হয়েছেন। এক পর্যায়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী করোনা আক্রান্ত হয়ে আরোগ্য লাভের খবরও ছিল মিডিয়ায়। এবার তিনিও মুখ বন্ধ রাখেন নি।  আগ বাড়িয়ে শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্যে টিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তার মতে এতে নাকি জনমনে আস্থা বাড়বে। যতদূর জানি তিনি তার আদর্শের নেতা যার শাড়ির ভাঁজ তিনি পায়ের কাছে বসে ঠিক করে দিতেন সেই খালেদা জিয়ার টিকা নেওয়ার কথা বা টিকা দেওয়া না-দেওয়া নিয়ে কিছু বলেন নি। এটা যেমন বিপরীতমুখি আচরণ, তেমনি তার সুবিধাবাদী মনোভাবের প্রকাশ। তিনি হয়তো মনে করেন, সরলতার নামে এই চালাকিগুলো মানুষ বোঝে না। জনাব আপনি যে শেখ হাসিনার অমঙ্গল চান সেটা শিশুও বোঝে। 

বিষয় সেটা নয়। বিষয় হচ্ছে দুনিয়ার আর কোনো দেশে টিকা নিয়ে এমন তামাশার খবর শুনি নি।  আমরা এভাবেই একটি হাস্যকর সমাজ তৈরি করেছি, যেখানে যে কোনো সিরিয়াস বিষয়ও হাসি তামশার শিকার! পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলো যেখানে টিকা পাওয়ার জন্য; টিকা নিয়ে রোগ থেকে মুক্ত হবার জন্য; সহজ স্বাভাবিক জীবনে ফেরার জন্য মুখিয়ে আছে, সেখানে আমাদের দেশে চলছে কথা আর ঝগড়া। এতো বিশেষজ্ঞ, এতো চিকিৎসক, এতো সবজান্তা আর কোথাও পাবেন না। টিভি খোলা যায় না। রেডিও অন করা মুশকিল। খবরের কাগজ বা সামাজিক মিডিয়া- সর্বত্র উপদেশ আর বিশেষজ্ঞ মতামতের প্লাবন। জানি না আদৌ এই টিকার ভবিষ্যৎ কী হবে দেশে?
বাংলাদেশে এই দুই বড় ঘটনা- টিকা ও গৃহদান যেভাবে রাজনীতি ও কলহের বিষয় বানানো হলো তাতে সত্যি বিস্মিত হবার বিকল্প থাকে না। অথচ আমরা আশাকরি গরিব ছিন্নমূল ও নিম্মবিত্তের মানুষ গৃহকোণ ফিরে পাক। আজকাল এই সিডনি শহরেও রাস্তায় থাকা মানুষ দেখতে পাই। আমাদের দেশের তুলনায় তা নগণ্য বা কিছুই না; তবু আছে। সে জায়গায় সতেরো কোটি মানুষের দেশে জনগণকে বিনামূল্যে বাড়ি দেওয়া, করোনার টিকা দেওয়ার পরও এতো বিতর্ক, এতো কথা- পারি বটে আমরা!

আওয়ামী লীগের অযোগ্য, দুর্নীতিবাজ নেতা বা কর্মী নামে পরিচিতদের এড়িয়ে বাড়িঘরগুলো প্রকৃত মানুষেরাই পাবে- এটুকু আশা করা যায়। টিকা হোক আনন্দময় স্বাভাবিক জীবনে ফেরার উপহার। নয়তো মনে হবে টিকা মেরে বাড়ি দান হচ্ছে দেশে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, সিডনি থেকে

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়