সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের উল্টো পিঠ দেখছেন সু চি
![সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের উল্টো পিঠ দেখছেন সু চি সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের উল্টো পিঠ দেখছেন সু চি](https://cdn.risingbd.com/media/imgAll/2020August/risingbd1-2102021106.jpg)
ভোটে জয়লাভ করেও ক্ষমতায় যেতে পারছেন না সু চি
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী দেশটির ক্ষমতাসীন দলের নেত্রী অং সান সু চিসহ শীর্ষ নেতাদের আটকের পর দেশটিতে আগামী এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করেছে। এর মধ্যে দিয়ে দেশটিতে ফের সেনা শাসনের সূচনা হলো।
আধুনিক মিয়ানমারের জাতির জনক অং সান এবং খিন চি’র কন্যা অং সান সু চি ১৯৮৮ সালের গণ-আন্দোলনের সময় থেকেই সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। ১৯৯০ সালের নির্বাচনে ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসি (এনএলডি) বিজয়ী হলেও সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকৃতি জানায়। তখন গণতন্ত্র ধরে রাখার জন্য লড়াই করা এই নেত্রী প্রায় ১৫ বছর গৃহবন্দি অবস্থায় কাটান। এ সময় থেকেই তিনি ক্রমে বিশ্বে গণতন্ত্রকামী নেত্রী হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। বিশ্বজুড়ে তার গ্রহণযোগ্যতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। নিজ দেশেও তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
মিয়ানমার দীর্ঘ সময় সেনাবাহিনী দ্বারা শাসিত হয়েছে। ১৯৬২ সালের এক অভ্যুত্থানের পর টানা ৪৯ বছর সামরিক বাহিনীর হাতে ছিল দেশটির শাসনভার। ২০১৫ সালে ঐতিহাসিক নির্বাচনে সূ চি’র দল এনএলডি বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় এলে টানা পাঁচ দশকের সামরিক শাসনের অবসান ঘটে। গত বছর অর্থাৎ ২০২০ সালের নভেম্বরের নির্বাচনেও এনএলডি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও সেনাবাহিনী সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি (ইউএসডিপি) নির্বাচনে প্রতারণা ও ভোট কারচুপির অভিযোগ করে। তারপর থেকেই দেশটিতে এনএলডি ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এরপরই গত ১ ফেব্রুয়ারি সু চি এবং দেশটির প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টকে আটক করে সেনাবাহিনী।
এখন যে প্রশ্নটি সামনে চলে এসেছে তা হলো- সেনাবাহিনীর হাতে ক্ষমতা যাওয়ার ফলে মিয়ানমারে গণতন্ত্র বিদায় নিয়েছে। তাহলে রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের যে আলোচনা বা তাদের ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতি বা সে সম্পর্কিত কার্যক্রমের কী হবে? সেসব কি পূর্বের গতিতেই চলবে, নাকি আরো বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া? এখন যাদের আপাতত নিরাপদ গন্তব্য হিসেবে ভাসানচর পাঠানো হচ্ছে, তাদের স্থায়ী গন্তব্য মিয়ানমার। যদিও বারবার চেষ্টা করেও রোহিঙ্গাদের স্থায়ী গন্তব্যে পাঠানো যায়নি। মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনের পর রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আরও কার্যকর অগ্রগতি হওয়ার ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ এই সামরিক অভ্যুত্থানে সবকিছু পাল্টে গেল।
যদিও রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে সু চি’র ভূমিকা ছিল বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। কৌশলগত কারণেই হোক বা অন্য যে কোনো কারণে সেদেশের সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর এই নির্মমতায় তিনি কার্যকর কোনো ভূমিকা নেননি। অথচ একসময় তিনি শোষিত জনগণের পক্ষে কথা বলে নন্দিত হয়েছেন। সেই তিনিই যখন অন্যায়ের বিপক্ষে মুখে কুলুপ এঁটে ছিলেন তখন বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সমালোচিত হয়। এমনকি গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘ লড়াই করে সু চি যে পদকগুলো পেয়েছিলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার নেতিবাচক ভূমিকার জন্য সেগুলো কেড়ে নেওয়ার কথাও বলা হয়। তারপরও সু চি’র বোধোদয় হয়নি। এমনকি এ জন্য তাকে আন্তর্জাতিক আদালতেও দাঁড়াতে হয়েছিল।
২০১৭ সালে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা শুরু করার পর তারা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দেয়। বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লাখ ১৮ হাজার ৫৭৬ জন। তারপর থেকেই এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের আশ্রয়ে রয়েছে। মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত থাকলেও তা শুরু করা যাচ্ছে না। রাষ্ট্রের দায়িত্ব দেশে বসবাসরত সব নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। মিয়ানমার তা করেনি। তার পরিবর্তে রাখাইনে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। অথচ আজো এর কোনো প্রতিকার হয়নি। যদিও এই নৃশংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর জাতিসংঘের সর্বোচ্চ আদালত আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে গাম্বিয়া। শুনানি শেষে চলতি বছর ২৩ জানুয়ারি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গণহত্যামূলক সহিংসতা বন্ধে জরুরি ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ দেন আইসিজে। হঠাৎ মিয়ানমারে সামরিক শাসন নেমে আসায় আইসিজের নির্দেশও এখন পালন করা হবে কিনা সেটাও দেখার বিষয়।
যদিও ২০১৮ সালে রোহিঙ্গা বিষয়ে চুক্তি হয়েছে। চুক্তির দুই বছর পেরিয়ে গেলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। আমাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয় থেকে, মিয়ানমারে ক্ষমতায় যেই থাকুক, তাকেই চুক্তি অনুযায়ী প্রত্যাবাসন শুরু করার উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও চীনের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। দুই দেশই দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারে সচেষ্ট রয়েছে। ওদিকে যুক্তরাষ্ট্রে নতুন সরকার ক্ষমতায়। বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের পক্ষে অবস্থান নেওয়ার অঙ্গীকার বাইডেন করেছেন। আর কে না জানে রোহিঙ্গা নির্যাতন একটি চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন। সেক্ষেত্রে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি কার্যকর করতে কূটনৈতিক তৎপরতা জোরদার করার বিকল্প নেই। মিয়ানমারে ক্ষমতায় যেই থাকুক- এটা মনে রাখতে হবে, সু চি ক্ষমতায় থেকেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে টুঁ শব্দটিও উচ্চারণ করেননি। সুতরাং তিনি ক্ষমতায় থাকলেই কি, না-থাকলেই কি! বাংলাদেশের কাজ বাংলাদেশকেই করে যেতে হবে। তবে এটা ঠিক, মিয়ানমারের সেনা অভ্যুত্থান সেই কাজটিকে আরো কঠিন করে দিলো।
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
ঢাকা/তারা
আরো পড়ুন