ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ০৯ মে ২০২৪ ||  বৈশাখ ২৬ ১৪৩১

গৌরবের বাংলা, অহঙ্কারের বাঙালি

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১২, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১   আপডেট: ১২:০১, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২১
গৌরবের বাংলা, অহঙ্কারের বাঙালি

দু’বছরও হয়নি, একদিন কলকাতার রাস্তায় দুটো উঠতি তরুণ-তরুণীকে কথা বলতে শুনেছিলাম। আমি ফুটপাতে দাঁড়িয়ে ভাড়ে চা পান করছি। মেয়েটি রেগে যাওয়া ছেলেটির হাত চেপে ধরে বলছিল- মাইরি বলছি, তোর জন্য হামদরদী আছে  আমার। তুই রোগনজোশ। দিলদরদী রে!
গলে গিয়ে ছেলেটি বলল, এ জন্য তো আমি তোর ইশক। তুই বিন্দাস!

ঢাকায় ফিরে শুনি একজন আরেকজনকে বলছে, মাম্মা এইডার নাম মাইনকা চিপা!
এক সভায় একজন বলছিল, আখেরে বিলকুল সাফা হতে হলে তরিকা মানুন।

ভালো করে দেখুন, কলকাতা ও ঢাকার পরিবর্তিত বাংলায় কয়টা বাংলা শব্দ আছে? বাঙালির অবস্থা আরো ভয়ঙ্কর। কলকাতায় সত্যজিৎ রায়ের বাড়ি যাবার জন্য ট্যাক্সিতে চেপেছিলাম। কথায় কথায় ছোকরা চালককে বললাম, জানো তো সত্যজিৎ কে? মাথা দুলিয়ে পানের রস গিলতে গিলতে সে বলল, জানি জানি, ঐ যে প্রসেনজিৎ-এর বাবা।
চট্টগ্রামে এক তরুণ বলেছিল বাংলা সাহিত্যের সেরা লেখক কাশেম বিন আবু বকর। আর হুমায়ূন আহমেদ ভূতের গল্প লিখে নাম করেছেন। 

যত দূরেই থাকি, যত সমুদ্র পাড়ে; পরিচিতি একটাই— আমরা বাঙালি। বাংলাদেশি। বাংলা ভাষা (বাঙলা, বাঙ্গলা, তথা বাঙ্গালা নামগুলোতেও পরিচিত) একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, যা দক্ষিণ এশিয়ার বাঙালি জাতির প্রধান কথ্য ও লেখ্য ভাষা। মাতৃভাষীর সংখ্যায় বাংলা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের চতুর্থ ও বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম ভাষা। [মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুসারে বাংলা বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ভাষা। বাংলা সার্বভৌম ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা তথা সরকারি ভাষা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসামের বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা। বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের প্রধান কথ্য ভাষা বাংলা। এছাড়া ভারতের ঝাড়খণ্ড, বিহার, মেঘালয়, মিজোরাম, উড়িষ্যা রাজ্যগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাংলাভাষী জনগণ রয়েছে। ভারতে হিন্দির পরেই সর্বাধিক প্রচলিত ভাষা বাংলা। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা ও ইউরোপে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাংলাভাষী অভিবাসী রয়েছে। বিশ্বে সব মিলিয়ে ২৬ কোটির অধিক লোক দৈনন্দিন জীবনে বাংলা ব্যবহার করে। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত এবং ভারতের জাতীয় সংগীতও  বাংলায় রচিত।

এমন একটি ভাষার দায়িত্ব এখন বাংলাভাষী রাষ্ট্র বাংলাদেশের ওপর বললে কি ভুল বলা হবে? এবং এই দায়িত্ব আমরা অর্জন করেছি। ত্যাগের বিনিময়ে। বাংলা ভাষার আন্দোলন নিয়ে যে যাই বলুক এর সরকারি সূচনা করেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। কুমিল্লার এই মানুষটি ছিলেন দেশপ্রেমী এক বাঙালি। কংগ্রেসের রাজনীতি করা দত্ত মহাশয় পাকিস্তান হবার পর ভারত চলে যেতে পারতেন, যাননি। বন্ধুরা চলে যাবার ডাক পাঠালেও মাটি আঁকড়ে পড়ে ছিলেন স্বদেশে। এই মানুষটিই প্রথম পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা ভাষার মর্যাদার কথা বলেন। সেদিন পাকিস্তানী শাসক ও রাজনীতিকরা তাঁকে নিয়ে মশকরা করলেও তিনি কিন্তু সাবধান করে দিয়েছিলেন তখনকার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির কথা মনে করিয়ে দিয়ে। বলাবাহুল্য সেই রাষ্ট্র টেকেনি। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে মেরে ফেলার পরও পাকিস্তান টিকতে পারেনি। 

আমাদের একুশে কেবল ভাষার সংগ্রাম নয়। শুরুতে তার চাওয়া মাতৃভাষার সম্মান হলেও পরে তা স্বাধীনতার পথ খুলে দেয়। এই কারণে আমরা মূলত ভাষাভিত্তিক রাষ্ট্র। ভাষাহীন জাতি যেমন মূক বধির, আমরাও তাই। কিন্তু আজ এত বছর পর নানা আগ্রাসনে ভাষা আক্রান্ত। দেশের ভেতরের হাল নাজুক। অথচ বাইরের বাঙালির পরম মমতা আর কষ্টবোধের ফল হিসেবে বাংলা পেয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সম্মান। কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ সালে। 

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ২০১০ সালের ২১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ। এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে উত্থাপন করে বাংলাদেশ। মে মাসে ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্যবিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।

এমন গৌরবময় ইতিহাসের ধারক একটি জাতির তারুণ্য শুদ্ধ বাংলা জানে না, বলতে বা লিখতে পারে না। পারে না- এর চাইতে কষ্টের আর কি হতে পারে? এর কারণগুলো কি আমরা খতিয়ে দেখেছি? আজ দেশের নতুন প্রজন্মে বাংলা ভাষার বিকৃতি ভয়াবহ। কাউকে যদি আপনি প্রশ্ন করেন- কোথায় যাচ্ছে বা কেমন আছে? তারা উত্তর দেয়: দৌড়ের ওপর আছি। এর মানে কি? ইংরেজি ‘অন দ্য রান’ আর ‘দৌড়ের ওপর আছি’ কি সমার্থক? সম্বোধনে ঢুকে গেছে ইংরেজি। হাই হ্যালো ছাড়া কেউ কাউকে সম্বোধন-ই করে না। ফেইসবুক টুইটার কিংবা প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চয়ই দরকারি। আমরা আধুনিক হবো, উত্তোরোত্তর এগিয়ে যাব- এটাই চাওয়া। কিন্তু মাতৃভাষাকে অমর্যাদা করে বা এড়িয়ে তা কীভাবে সম্ভব?

নতুন প্রজন্মকে দোষ দেওয়ার আগে আমাদের নিজেদের চেহারা দেখা দরকার। এই প্রবণতার পেছনে নাটকের ভূমিকা সর্বজনবিদিত। ঢাকার নাটকে হঠাৎ আঞ্চলিক ভাষার নামে ডাইলেক্টকে ভাষা বলার শুরু বিস্ময়কর। মানুষ বাংলাদেশে এক এক জেলায় এক এক উচ্চারণ আর পরিবর্তিত বাংলায় কথা বলেন। চট্টগ্রাম সিলেট নোয়াখালীর কথা বুঝতে পারা অন্য জেলার মানুষদের জন্য কঠিন। মূলত অন্যরা চট্টগ্রামের ভাষাই বোঝেন না। সেখানে আচমকা ঢাকার ভাষা জাতীয় ভাষা মনে করার কারণ বোধগম্য নয়। কিন্তু তার প্রকোপ এখন এমনই যা অস্বীকার করা যাবে না। বরং আগামীর জন্য তা রীতিমত চ্যালেঞ্জের।

বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির আকাল রোধে ভাষার পরিচর্যা জরুরি। কারণ, আজকালকার জনপ্রিয় তরুণ-তরুণী লেখকরাও প্রমিত বাংলায় লিখছেন না। মাঝে মাঝে আমি নিজেকে প্রশ্ন করি, আমরাই কি পশ্চাৎপদ না আমরা অনাধুনিক? কিন্তু দুনিয়া দাপিয়ে বেড়ানো ভাষাগুলোর দিকে তাকালে আমার ভাবনা উত্তর খুঁজে পায়। ইংরেজি, স্প্যানিশ কংবা আরবি তো বিকৃত না। হিন্দিও না। আমরা যত গালমন্দ করি না কেন হিন্দি তার আপন মহিমায় আছে এবং উল্টো আমাদের ও পাকিস্তানের বাস্তবতাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। তার এই আগ্রাসন যতোটা ভাষাভিত্তিক ততোটাই বিনোদন নির্ভরতার কারণে। ফলে আমাদের উচিত নিজেদের বিষয়গুলোর দেখভাল করা। অপরের ভাষা ও সংস্কৃতি কেন কি নিচ্ছে, তার চেয়ে জরুরি ঘরের তালা ঘরের চাবি ঠিক রাখা। বাংলা ভাষা ঢাকায় একদিকে যেমন তার গৌরবে বাড়ন্ত, আরেকপ্রান্তে হতাশ আর দিকভ্রান্তদের হাতে আছে বিপদে। এটা মনে রাখা দরকার প্রমিত ভাষা একদিনে তৈরি হয়নি। বহু মনীষার বহু চেষ্টার ফল আজকের এই রূপ। আমরা কি বাংলাকে আরো শ্রীবৃদ্ধির দিকে নেব, নাকি তার শরীরে আঁচড় কাটতে দেব? এই মীমাংসার দায় বুদ্ধিজীবী ও অগ্রসর মানুষের। আজ নানা কারণে তারা আগের মতো সরব না। কিন্তু তাঁরাই পারেন তারুণ্যকে বাঁচাতে।

প্রায় সত্তর বছর আগে আমাদের অগ্রজেরা প্রাণ দিয়ে যে ভাষা প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তার দান অপরিসীম। তার মূল্যায়ন করেছে সময়। আমাদের তারুণ্য আজ যে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে মাতৃভাষায় মাকে ‘মা’ ডেকে আনন্দ করে, দুঃখে কাতর হয়; যে ভাষায় ভালোবাসে- তার জন্যে হলেও ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা রাখা চাই। এমনিতেই নানা বিষয়ে আমরা একটি অকৃতজ্ঞ জাতি। আমাদের কৃতজ্ঞতাবোধ আর সুধি সমাজের মিলনেই বাংলাদেশের উজ্জ্বলতার বহিরাঙ্গিক রূপ মূর্ত করতে পারে আমাদের ভাষা। এমন সুললিত মধুর ভাষায় জন্ম নেওয়া সৌভাগ্যের। তারুণ্যকে মনে করিয়ে দিতে চাই- দুনিয়ার খুব কম ভাষায় এতো গুণী, এতো মেধাবী মানুষ জন্মেছেন। মেধায় থৈ থৈ করা বাংলা, বাঙালির একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের আজীবনের অহঙ্কার। বাঙালি বলিয়া লজ্জা নাই বরং তা গৌরবের।

ঢাকা/আমিনুল/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়