ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

করোনার উৎস বিতর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীনের অবস্থান  

অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৫:২৫, ১ জুন ২০২১  
করোনার উৎস বিতর্ক এবং যুক্তরাষ্ট্র-চীনের অবস্থান  

করোনায় নাজেহাল পৃথিবী। এই দুর্যোগ শুরু হওয়ার আনুমানিক সময় নির্ধারিত থাকলেও কবে শেষ হবে তার কোনো নির্ধারিত দিন-ক্ষণ নেই। মহামারির এই সময়ে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজনীতি। পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো খুঁজতে শুরু করেছে এর উৎস স্থান।

অন্যদিকে চীন চাইছে না বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করতে। এমনকি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি দলকে তারা তাদের দেশে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। ধারণা করা হচ্ছে করোনার সূচনা এই চীন দেশ থেকেই। কেননা সংক্রমণের শুরু চীনের উহান থেকেই হয়েছিল। প্রাণী দেহ থেকে করোনাভাইরাস মানুষের দেহে সংক্রমিত হয়েছে এমন ধারণাও প্রচলিত। কেননা পৃথিবীর পূর্ববর্তী অনেক মহামারির উৎস ইঁদুর।

এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যেকার দ্বন্দ্ব নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার। সেই আধিপত্য অথবা সোজা কথায় প্রভাব বিস্তারের নতুন অস্ত্র এখন করোনাভাইরাস। ভারতও বিভিন্ন সময় চীনের দিকেই আঙুল তুলেছে। চীনের সঙ্গে ভারতের দ্বন্দ্বও নতুন কোনো ঘটনা নয়। অর্থাৎ করোনাভাইরাস এখন রাজনৈতিকভাবে শত্রুকে ঘায়েল করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। করোনার উৎপত্তি নিয়ে একে অপরের প্রতি দোষারোপ দেখে তাই মনে হয়।

বাইডেনের বিজয়ের পর চীনের সঙ্গে পররাষ্ট্রনীতি কেমন হবে তা নিয়ে পূর্ব ধারণা যাই থাকুক ধীরে ধীরে তা স্পষ্ট হচ্ছে। করোনা অতিমারির শুরু থেকেই দুই দেশের মধ্যে নতুন করে একটি ইস্যু তৈরি হয়। যার নাম দেওয়া যায় করোনা ইস্যু। করোনাকে ‘চীনা ভাইরাস’ও বলা হয়েছে। সেই উত্তেজনা নতুন করে সামনে এসেছে বাইডেনের সাম্প্রতিক একটি ঘোষণায়। করোনাভাইরাসের উৎপত্তি চীনের উহান থেকেই হয়েছিল কিনা তদন্ত করতে গোয়েন্দাদের দ্বিগুণ গতিতে কাজের নির্দেশ দিয়েছেন নতুন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।

আর এতে প্রমাণিত হয়েছে যে, ট্রাম্প -বাইডেন করোনার উৎস ইস্যুতে এক অবস্থায় আছেন। চীন জবাবে বিষয়টিকে ‘রাজনৈতিক কারসাজি’ ও দোষারোপের খেলা’ বলে নিন্দা জানিয়েছে। বিশ্ব রাজনীতিতে এটা নতুন কিছু না। বিশ্ব মোড়ল হওয়ার দৌড়ে যখন পরাশক্তিগুলো ছুটতে থাকে তখন এ ধরনের পরিস্থিতি আগেও দেখা গেছে। অথচ করোনাসৃষ্ট মহামারির এই সময়ে বিশ্বের একত্রিত হওয়া খুবই প্রয়োজন ছিল। তা সত্ত্বেও যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, আধিপত্য বিস্তারের কৌশল, জোট পরিকল্পনা প্রভৃতি সবকিছুই সমানতালে চলেছে। দুই দেশের এই প্রতিযোগিতা মূলত স্নায়ুযুদ্ধ শব্দটির দিকে ইঙ্গিত বহন করে।

যুক্তরাষ্ট্র-চীনের সম্পর্কের অবনতি ২০১৮ সালে। ট্রাম্প-জামানায় বাণিজ্য যুদ্ধ দিয়ে দুই দেশের মধ্যে  টানাপোড়েনের সূচনা। ট্রাম্প প্রশাসন চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। এর জবাবে চীনও যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করে। আর এতেই শুরু হয়ে যায় দু’দেশের বাণিজ্য যুদ্ধ। তৈরি হয় উত্তেজনা। সেই উত্তেজনার রেশ আজও রয়েছে। বাণিজ্য যুদ্ধ ছাপিয়ে এখন করোনা নিয়ে তৈরি হয়েছে নতুন দোষারোপ।

এটা স্বীকার করতেই হবে যে, প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন দুই পরাশক্তি। বিশ্বকে এগিয়ে নিতে দুই দেশেরই প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু দুই দেশই অগ্রসর হচ্ছে আলাদা মিত্রশক্তি সঙ্গে নিয়ে। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের মধ্যে সবসময় উত্তেজনা বিরাজ করে। বাণিজ্য যুদ্ধের আড়ালেও ছিল আধিপত্যের দ্বন্দ্ব। করোনা পরিস্থিতির কারণে বাণিজ্য যুদ্ধ এখন চাপা পড়ে গেছে। সব দেশই এখন নিজেদের করোনাসৃষ্ট পরিস্থিতি সামলাতে ব্যস্ত। ঠিক এই সময় করোনার উৎস নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগের তীর ছুড়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। করোনা ভাইরাসকে ‘চাইনিজ ভাইরাস’ বলেও আখ্যা দিয়েছিলেন তিনি। করোনাভাইরাস যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনেও শেষ পর্যন্ত প্রভাব রেখেছিল। চীন পরিস্থিতি সামলে নিলেও যুক্তরাষ্ট্রে করোনায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রে চীনের সমালোচকরা বলছেন, চীন এই ভাইরাসের ভয়াবহতা নিয়ে সঠিক তথ্য দেয়নি। আর যেসব তথ্য দিয়েছে তাও অনেক দেরীতে। যদিও চীন তা বরাবরই অস্বীকার করে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে ক্রমাগত জল ঘোলা হয়েছে।

মাঝখানে বিষয়টি একটু আড়ালেই ছিল। হঠাৎ বিষয়টি সামনে চলে আসার কারণ কি? সম্প্রতি মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির কয়েকজন গবেষক ২০১৯ সালের নভেম্বরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। তাদের হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়। এই তথ্য ধারণা দিচ্ছে যে চীনের ল্যাব থেকেই করোনা ছড়িয়েছে। প্রতিক্রিয়ায় চীনও পাল্টা দাবি তুলেছে যে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ল্যাব থেকেই করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে কিনা সেটিও তদন্ত করে দেখা হোক। গত ফেব্রুয়ারিতেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ল্যাব থেকে করোনাভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা কম। আর মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিল্যান্ডের সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল এ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের একজন সিনিয়র রিচার্স ফেলো বায়োকেমিস্ট মিল্টন লিটেনবার্গ বলেছেন, তিনি আশঙ্কা করছেন চীন আরেকটি মহামারি সৃষ্টি করতে পারে। কারণ চলমান মহামারি সম্পর্কে চীন বিশ্বের কাছে সততার পরিচয় দেয়নি। আসলে করোনাভাইরাসের উৎস কোথায় এর একেবারে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। করোনার উৎপত্তির সঠিক ও বিশ্বাসযোগ্য কারণ জানতে না পারলে এমন বিতর্ক চলতেই থাকবে। 
 

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক
 

ঢাকা/তারা

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়