শরিকানা কোরবানি: অংশীদাররা সাবধান!
প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইসমাইল হোসেন || রাইজিংবিডি.কম
![শরিকানা কোরবানি: অংশীদাররা সাবধান! শরিকানা কোরবানি: অংশীদাররা সাবধান!](https://cdn.risingbd.com/media/imgAll/2021July/67-2104140242-2107210439.jpg)
ঈদুল আজহা উপলক্ষে, যাদের উপর কোরবানি ওয়াজিব হয়, তারা কোরবানি দেন। কোরবানি ওয়াজিব হলে একটি ছাগল, একটি ভেড়া অথবা একটি দুম্বা দিয়ে কোরবানি দেয়া যায়। সে ক্ষেত্রে একজন কোরবানি আদায়কারীর পক্ষ থেকে উল্লেখিত যে কোনো একটি পশুর মাধ্যমে কোরবানি আদায় হয়ে যাবে। আবার গরু, মহিষ এবং উটের বেলায় এদের প্রত্যেকটির সাত ভাগে সাতজন কোরবানি আদায়কারীর পক্ষ থেকেও কোরবানি করা যাবে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সাতজন অংশীদারের বৈশিষ্ট্য কী এবং কেমন?
তাদের মধ্যে যদি বেনামাজি হয়, হালাল রুজি ভক্ষণকারী হয় কিংবা মদখোর, সুদখোর, ঘুষখোর, মিথ্যুক ইত্যাদি যে কোনো একটি বৈশিষ্ট্যে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়, তাহলে তাদের সঙ্গে শরিকানা কোরবানি দিলে কোরবানি আদায় হওয়া নিয়ে সন্দেহ থাকে। একজন নামাজি ব্যক্তি যখন বেনামাজি ব্যক্তির সঙ্গে কোরবানি দেন, তখন মনের দিক থেকে তাদের এমনিতেই দূরত্ব থাকে। আবার কেউ যদি মদপানে অভ্যস্ত হন, যা অবশ্যই হারাম, এ জাতীয় একজন লোকের সঙ্গে শরীকানায় কোরবানি দিতে গেলে কখনোই শরিকদের মধ্যে যে সুন্দর বৈশিষ্ট্যের সমতা থাকা উচিত, তা হয় না।
একইভাবে যারা সুদখোর, সুদের কারবারের সঙ্গে জড়িত, সুদের ব্যবসায় নিমগ্ন, এমন একজন ব্যক্তির সঙ্গে নামাজি, পরহেজগার কিংবা সুদের কারবার থেকে মুক্ত কোনো আল্লাহর বান্দা এক হয়ে কোরবানি দিতে গেলে সমস্যা হবেই। যিনি সরকারি বা বেসরকারি চাকরি করছেন এবং পদে পদে ঘুষ খাচ্ছেন, তার রুজি-রোজগার কখনোই হালাল নয়। এমন ব্যক্তির সঙ্গে ঘুষমুক্ত, পরহেজগার ব্যক্তি শরীকানায় কোরবানি দিতে গেলে অবশ্যই সেই কোরবানিতে সমস্যার সৃষ্টি হবে।
কোনো একটি সমাজে একজন ব্যক্তি মিথ্যুক বলে পরিচিতি লাভ করেছে, এমন ব্যক্তির সঙ্গে সত্যবাদী অথবা পরহেজগার ব্যক্তির কোরবানি দিতে গেলে সমস্যা হবে।সর্বোপরী হালাল রুজি ভক্ষণ না করলে সেই ব্যক্তির অর্থে কোরবানি দিতে গেলে সেই কোরবানির গরু ও মহিষের শরিক যদি কোনো নামাজি, পরহেজগার ও সত্যবাদী ব্যক্তি হয়, তখন সত্যবাদী ব্যক্তির কোরবানি সঠিক হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
হালাল রুজি ভক্ষণকারী নয় এমন ব্যক্তি, বেনামাজি, মদখোর, সুদখোর, ঘুষখোর বা মিথ্যুক ব্যক্তিদের কোরবানি হলো কি না-হলো তা নিয়ে মাথা ঘামানোর কিছু নেই। কারণ একজন মদখোর সার্বক্ষণিক কবীরা গুনাহে লিপ্ত, কোরবানি কবুল হলো কি না-হলো সেই মাথাব্যথা তার থাকার কথা নয়। একজন ব্যক্তি সুদখোর বা ঘুষখোর সে তার সুদ-ঘুষ নিয়েই ব্যস্ত, সে আরো কিছু সম্পদ কীভাবে বাড়াবে সেই নিয়ে চিন্তায় মগ্ন; অথবা মিথ্যা কথা বলে তার ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে সবকিছু পরিচালনা করছে, এমতাবস্থায় সে তার প্রতিটি দিনই কবীরা গুনাহে লিপ্ত, অতএব তার কোরবানি হলো কি হলো না, সে বিষয়ে মাথা ঘামানোর সময় তার নেই।
এ জাতীয় লোকদের কোরবানি হচ্ছে বেশির ভাগ সমাজ রক্ষা করার জন্য, অথবা লোক দেখানোর জন্য, অথবা গোশত খাওয়ার জন্য ইত্যাদি। তাহলে এমন ব্যক্তির সঙ্গে নিরেট আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য, আল্লাহর ওয়াস্তে যিনি কোরবানি আদায় করছেন, তার নিয়তের সঙ্গে কখনোই ঐকমত্য হবে না। যেমন পশু কেনার পর বা পশু কেনার আগে আচরণগত দিক থেকে একজন পরহেজগার ব্যক্তি তার হালাল উপার্জন দিয়ে সীমিত টাকায় একটি পশু কেনার চেষ্টা করবে, কিন্তু সুদখোর-ঘুষখোর ব্যক্তি কখনোই তার টাকার অভাব নেই বলে, সে একটু বড় গরু কেনার চেষ্টা করবে, বেশি দামি গরু কেনার চেষ্টা করবে, যা কিনা অনেক ক্ষেত্রে লোক দেখানোর জন্যে হয়ে থাকে। ফলে একটি গরু কোরবানির যদি সাতজন শরিক হয়, যারা এক হয়ে কোরবানি আদায় করতে সম্মত হয়েছেন, তাদের মন-মানসিকতা, মনের ইচ্ছা এবং নিয়ত, গরুটি ভালো হলো কি মন্দ হলো, গোশত বেশি হলো কি কম হলো, মানুষ কি বললো কি বললো না, হাসিলে ফাঁকি দেয়া হলো কি হলো না, কসাইকে ফাঁকি দেয়া হলো কি হলো না ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই জাতীয় চিন্তাভাবনার লোকদের কোরবানি কখনোই পূর্ণতা পায় না। ফলে এর সঙ্গে অংশগ্রহণকারী পরহেজগার ব্যক্তির কোরবানি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
চার মাযহাবের ইমামদের ঐকমত্য রয়েছে, যদি বিভিন্ন অবস্থার লোকেরা একসঙ্গে কোরবানি দেয়, তাহলে কোরবানি আদায় হয়ে যাবে; তবে কোনো পরহেজগার, হালাল রুজি ভক্ষণকারী, নামাজি ব্যক্তি জেনেশুনে এই জাতীয় শরিকদের নিয়ে কোরবানি আদায় করলে তা সঠিকভাবে পূর্ণতার সঙ্গে আদায় হবে না।
অর্থাৎ একজন নামাজি, পরহেজগার, হালাল রুজি ভক্ষণকারী, সত্যবাদী ব্যক্তি এই জাতীয় খারাপ বৈশিষ্ট্যের লোকদের সঙ্গে একই পশুতে শরীকানায় কোরবানি দিলে, ভালো লোকটির কোরবানি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা শতভাগ। আর তাই কোরবানি দিতে যারা সম্মত হন, কোনো একটি সাত ভাগের পশুর শরিক যারা হচ্ছেন, যাদেরকে তারা শরিক নিচ্ছেন, তাদের সম্পর্কে না জেনে, না বুঝে শরিক নিয়ে কোরবানি আদায় করা ঝুঁকিপূর্ণ।
অতএব আমাদের নিজেদের ইবাদতটুকু আল্লাহ যাতে কবুল করেন, সেজন্য বিষয়গুলো খুবই গভীরভাবে ভাবতে হবে। আর যারা শরীকানায় কোরবানি আদায় করছি, সময় থাকতে আমাদের সাবধান হতে হবে। প্রয়োজনে একটি ছাগল দিয়ে কোরবানি দেব, তবুও কোরবানি নিয়ে ঝুঁকির মধ্যে পড়া উচিত নয়। আল্লাহ আমাদের সকল ভালো কাজ কবুল করুন। আমীন।
লেখক: গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক ও মাসিক পত্রিকা সম্পাদক
ঢাকা/তারা
আরো পড়ুন