ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শারদ উৎসবের সর্বজনীন হয়ে ওঠার গল্প

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১০, ৪ অক্টোবর ২০২২   আপডেট: ০৯:১১, ৪ অক্টোবর ২০২২
শারদ উৎসবের সর্বজনীন হয়ে ওঠার গল্প

দুর্গাপূজার শারদীয় উৎসব হয়ে ওঠার গল্পটা চমৎকার। শুরু করবো আমাদের ছেলেবেলা দিয়ে। আমরা তখন পরাধীন দেশের নাগরিক। রাষ্ট্র নিজেই ভাগ হয়েছিল ধর্মের নামে। তাতে কি? দেশভাগ, জমির সীমানা ভাগ বা পতাকা বদলালেই কি মানুষের সবকিছু বদলে যায়? বাঙালির নদীর নাম যুমনা গঙ্গা সরস্বতী কিংবা কর্ণফুলি সুরমা। তার পাখির নাম শ্যামা দোয়েল কোকিল বা মাছরাঙ্গা। তার পোশাক শাড়ি পায়জামা পান্জাবী ধুতি বা লুঙ্গি কি করে রাতারতি সে এসব বদলে ফেলবে ? বদলায়নি কিছুই তখন। এখন কি এখনকার চাইতেও বাঙালি অনেক বেশি বাঙালি  ছিল তখন। ধর্ম ছিল মানুষের মনে বা আচারে। আচরণে পোশাকে খাদ্যে ছিল না অতটা। সে সময় শীতটা শরৎকালেই আসি আসি করতো।

আমি জন্মেছি চট্টগ্রাম শহরে। এনায়েত বাজার নামটা শুনেই বুঝতে পারছেন মহল্লার চারিত্র কি হতে পারে। সে মহল্লার একপ্রান্তে তখনকার ছায়াঘন গোয়ালটুলি। যার শেষপ্রান্তে রাজপথে পড়ার আগে ছিল দুটি দেয়াল ঘেরা বনেদী বাড়ি। একটির নাম কেদারনাথ তেওয়ারীর বাড়ি। অন্যটি হরিধন তেওয়ারীর বাড়ি। মাঝে মধ্যে ধুতি পরিহিত তেওয়ারীদের দেখলেও বেশীরভাগ সময় তাদের বিশাল বাড়ির ফটক থাকতো বন্ধ। শুধু দুর্গাপূজার পাঁচদিন বা আরও দু-একদিন খুলে দেওয়া হতো সদর দরজা। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে পূজা দেখতে আসতেন দূরদূরান্তের মানুষ।ফেরা পথে একখানা ঘিয়ে ভাজা কচুরী বা নিমকি মিহিদানা নামে পরিচিত বুন্দিয়ার লাড্ডু  একটা নারকেলের নাড়ু।সেই ছিল অমৃততুল্য। চট্টগ্রাম শহরের বা আশপাশের এলাকার বড় বৈশিষ্ট্য ছিল দাঙ্গা না  হওয়া। নানা রাজনৈতিক উসকানির পর ও পরাধীন দেশের এই নগরীতে কেউ দাঙ্গা হতে দিতো না। ফলে হিন্দু জনগোষ্ঠী ও ছিল প্রচুর। সবচেয়ে বিলাসবহুল পূজার একটি ছিল কানাইলাল মাড়োয়ারীর বহুতল দালানের পূজা।লোকে লোকারণ্য সে পূজায় নারী পুরুষ নির্বিশেষে রাতভর আনানগোনা হলেও কচিৎ কদাচিৎ কোনো দুর্ঘটনার খবর পেতাম আমরা। সে কানাইলাল মাড়োয়ারি র ভবনের রাজগরিয়ারা কিন্তু স্বাধীন দেশে চেতনাধারীদের কারণেই দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন বলে শোনা যায়।সে যাক। কিন্তু পূজা যায়নি।পূজা এখনো মহাউৎসাহে চলছে।

আমাদের বড় হয়ে ওঠার সময়কালে দেশটা মধ্যবিত্তে ভরা এক সমাজের দেশ ছিল।মধ্যবিত্ত নামের বাঙালি কি করে ? গান শোনে, কবিতা পাঠ করে, পূজা ঈদে বাজার খাবার পোশাক এসব কেনার ফাঁকে দু-চারটা পত্রপত্রিকা ঢাউস সাইজের সাময়িকী ও কিনে ফেলে বৈকি। তখন যারা মিডিয়া চালাতেন বিশেষত প্রিন্ট মিডিয়া তারা এটা জানতেন । টিভি তখন বাড়ি বাড়ি ঢোকেনি। একটা মাত্র চ্যানেল। ফলে তার অনুষ্ঠান মালা জনপ্রিয় হওয়া বা লোকের ভেতর পৌঁছানো ছিল স্বাভাবিক বিষয়।কিন্তু মানুষ তাতে খুব একটা মজতো না। যেমন ধরেন এরশাদ আমলে, প্রতি বছর টিভিতে এমন একটা অনুষ্ঠান ছিল ধরা বাঁধা। আপনি দেখতে বসলেই জেনে যেতেন এরপর কি হবে। দুর্গা বদলে গেলেও অসুর বদলাতো না বলেই গুণী অভিনেতা কিংবদন্তীতুল্য যাত্রা শিল্পী প্রয়াত: অমল বোসের নাম হয়ে গিয়েছিল ‘জাতীয় অসুর’। মানুষের ভেতর যে শিল্পবোধ আর পড়ার আগ্রহ তার বাণিজ্যিক ফায়দা নেওয়া আর লুট করা এক বিষয় না।তখনকার সময় ওপার বাংলার দেশ আর আনন্দবাজারের সম্পাদকদের নাম শুনলেই আপনি বুঝে যাবেন তাঁরা কি করতে পারতেন ?

সাহিত্যিক সন্তোষকুমার ঘোষ পরে তাঁর ভ্রাতা অনুজ সাগরময় ঘোষ দেশ পত্রিকার মান এতটাই শীর্ষে নিয়ে গেছিলেন যে সেখান থেকে নেমে আসা ব্যতীত বাকি সম্পাদকদের হাতে বিকল্প কিছুই ছিল না। এই দেশ পত্রিকা, আনন্দবাজার পত্রিকা অমৃতবাজার পত্রিকা পরে সন্দেশ, সানন্দা, উল্টোরথ, এমন কি কিশোর ভারতী র মতো শিশু কিশোর পত্রিকাও দুর্গাপূজার সময়কালে শারদীয় সংখ্যা প্রকাশ করে তাক লাগিয়ে দিতো আমাদের। বাংলা সাহিত্যের বহু নামজাদা লেখক কবি বা সমালোচকের পাশাপাশি এই সংখ্যাগুলো কালজয়ী সব সৃষ্টি  উপহার দিয়েছে। যা এখন কেবল ই ইতিহাস।

আমাদের সময়ে আর একটা বিষয় প্রবেশ করেছিল অন্তরে। এটা এমনিতেই সুরের কারণে হৃদয় মথিত। তার ওপরে ছিল স্বনামধন্য সব গীতিকবিদের লেখা গান। সলিল চৌধুরী থেকে গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, পুলক বন্দোপাধ্যায় হয়ে হেমন্ত, মান্না, লতা, আশা, আরতি মিলিয়ে এক জমজমাট গানের জগত।পূজা মানেই তখন ক্যাসেটে রেকর্ডে ভেসে আসা আনকোরা টাটকা সব বাংলা গান। যার বেশীরভাগ এখন ও রয়ে গেছে মান্নাদের সেই গানের মতো। মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে যুগের পর যুগ বাঙালির পূজাকে করে তুলছে সর্বজনীন।

পদ্মার তীরে ও সে  ঢেউ আছড়ে পড়তে সময় লাগেনি। দেশ স্বাধীন হবার পর রাজনীতি ব্যতীত আর কিছুই আঘাত করেনি পূজা উৎসবে। যতবার চেয়েছে ততবার রাজনীতি তার দাবার চালে কুপোকাৎ করেছে সম্প্রীতি। তবে এটা বলব আস্তে আস্তে বদলে যাওয়া মন মানসিকতায় এখন রাজনীতির পাশাপাশি সমাজের একটা বড় অংশ ও উৎসব বিরোধী।কিন্তু তারা এটা বুঝে গেছে পূজা হিন্দুর হতে পারে শারদ উৎসব হয়ে গেছে বাঙালির উৎসব। এটাই তার বড় গৌরব। আর এই হয়ে ওঠার মূল কারণগুলোর একটি হচ্ছে সংস্কৃতি। হিন্দুদের পূজা বা ধর্মীয় উৎসবে তিন অনুষঙ্গ অনিবার্য। খেয়াল করবেন মন্ত্র উচ্চারণের আগেই শঙ্খধ্বনি, উলু দেওয়া, বাদ্য বাজনা বেজে ওঠে। শ্লোকগুলো উচ্চারিত হয় সুরে সুরে। সবশেষে আনন্দের বহিঃপ্রকাশ শেষ হয় নাচে। যার অর্থ সঙ্গীত নৃত্য ও বাদ্য তার ধর্মের সহায়ক।বলাবাহুল্য সংস্কৃতিই পারে জাতি ধর্ম বর্ণ বা সীমানা নির্বিশেষে মানুষকে একাত্ম করতে। তার দ্বারাই সম্ভব যেকোনো মানুষের মগজ ও হৃদয়ে জায়গা করে নেওয়া। 
বাঙালির মতো আবেগ প্রবণ জাতির মননে দুর্গাপূজা শিল্প সাহিত্য আর সঙ্গীত নৃত্যকলার ভেতর দিয়েই হয়ে উঠেছে শারদ উৎসব। এখন যাকে বলছি, ধর্ম যার যার উৎসব সবার।

একটু যদি পূজার দিকে মুখ ফেরাই , আমার তো মনে হয় দেবীর পাশাপাশি অসুর বন্দনার রীতিটাও সাংঘাতিক। যাকে দুর্গা লড়াই করে বধ করলেন সেই মহিযাসুর ও প্রতিমার অবিচ্ছেদ্য অংশ। বরং সে না থাকলে দেবীর শৌর্য , সাহস বা মহিমা কিছুই থাকে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি তো তাকে দেখি প্রচণ্ড সাহসী রূপে। দশভূজা দুর্গাকে মা বলা হয়। যিনি পরম শক্তির অধিকারী। তাঁর দশহাতে দশ রকমের অস্ত্র। সাথে সিংহের মতো ভয়ঙ্কর পশুরাজ। এদের সাথে লড়ছে খড়্গহাতে এক অসুর। সাহসী না? জানবেন পশ্চিমবঙ্গের একপ্রান্তে বিহার ঝাড়খণ্ডের নানা অঞলে মহিষাসুরের ও পূজা হয়।

বিদ্যা জ্ঞান ধন সাধনা সাহসের সন্তান আর দেবাদি দেবকে নিয়ে একসাথে বাপের বাড়িতে আসা দুর্গাকে মনেই হয় না কৈলাসের কেউ।মনে হয় না তিনি হিমালয় কন্যা। কবেই বাঙালি তাকে আপন করে নিয়েছে।নিয়েছে বলেই জাতিসংঘ ও এই পূজাকে স্বীকৃতি দিয়েছে কালচারাল হেরিটেজ বলে। কালচারাল মানে ঐ যে সংস্কৃতি তার কারণেই হিন্দুদের দুর্গাপূজা বাংলাদেশসহ নানা দেশে শারদীয় উৎসব হয়ে গেছে। যার স্রোত অনাদিকাল চলবে। আমার সৌভাগ্য আমি এনালগ মোবাইলহীন যুগের সাদামাটা অথচ প্রাণের উৎসব দেখেছি এখন দেখছি ডিজিটাল যুগের আনন্দ উত্তেজনার আরেক অধ্যায়। বিবর্তন মানব সভ্যতার ধর্ম।সে ধারায় যেখানেই যাক আর যতটাই যাক বাঙালির শারদ উৎসব মানেই কুয়াশা মাখানো শিশির ঝরা ভোরবেলা ঢাকের শব্দে কানে ও হৃদয়ে বাজতে থাকা, দুর্গা এলো, দুর্গা এলো।

শুভ শারদীয়া
সিডনি

/সাইফ/

সম্পর্কিত বিষয়:

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়