ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ফোঁড়াটি এখন ক্যানসার

টুটুল রহমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:০৮, ১১ মার্চ ২০২৩   আপডেট: ১৮:১০, ৩১ মার্চ ২০২৩
ফোঁড়াটি এখন ক্যানসার

খুব সম্ভবত ২০১৭ সালে ফোঁড়াটি প্রথম উঠতে শুরু করে। আমরা তাকে চুলকে দেই, মিষ্টি ব্যথায় লালন করে মজা নিতে থাকি। কিন্তু হায় ফোঁড়াটি এখন ক্যানসার হয়ে গেছে। সমাজের পুরো শরীরে আস্তে আস্তে ছেয়ে ফেলছে। তবুও আমরা খেয়াল করছি না- উৎসাহ দিচ্ছি! 

হ্যাঁ, ফোঁড়াটি নামের আগে ‘হিরো’ বসিয়ে নিজেকে হিরো ভেবে, বানিয়ে নানা রকম ভেলকি, বাঁদর নাচ দেখিয়ে মোটামুটি টাকা-পয়সার মালিক হয়ে গেছে। দু‘চারজন সাঙ্গপাঙ্গ জুটিয়ে, দামি অথচ কিম্ভুতকিমাকার পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়। যে কোনো ইস্যুতে দৌড়ে যায়, লাইভে কথা বলে। এ সব কারণে তার গানের নামে যন্ত্রণা উৎপাদন, অভিনয়ের নামে অশ্লীলতা আর বাঁদরের ভেংচি, অশুদ্ধ উচ্চারণের শব্দদূষণ থেকে মানুষ কিছুটা হলেও মুক্তি পেয়েছে। কবিতার নামে তিনি যা শুরু করেছিলেন তা অব্যাহত থাকলে পৃথিবীর সকল কবি এতো দিনে আত্মহত্যা করতেন! 

যাক! এই জিনিস নিয়ে কথা বলতে চাইনি। তার অনেক ভক্তবৃন্দ তৈরি হয়েছে। মূলধারার গণমাধ্যম এখন তার পেছনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ওই যে, কারণ একটাই ভাইরাল হওয়া এবং ডলার আয়। এ কারণে প্রথমে কুৎসিত যন্ত্রণাদায়ক ফোঁড়াকে আমরা আমাদের শরীরে লালন করলাম এখন ক্যানসার হওয়ার পরেও সেটাকে সারানোর বা কেটে ফেলার কোনো লক্ষন দেখছি না। বরং আরো বিস্তৃত লাভ করছে বলেই মনে হচ্ছে। 

গত সপ্তাহে এক প্রগতিশীল লেখিকা হিরোকে নিয়ে একটা লম্বা স্ট্যাটাস দিলেন এবং বললেন, পৃথিবীর তাবৎ মহান মানব ও সৃষ্টিশীলদের সঙ্গে এই হিরোর মিল আছে। আমি পড়ে বিমূঢ় হয়ে গেছি! এই মহিলা বলে কি? মাক্সিম গোর্কির জীবনের সঙ্গেও নাকি এর মিল আছে। আমি অসহিষ্ণু হয়ে তার বিবৃতিতে মতামত দিলাম, আপা স্ট্রাগলের নামে লাজ-লজ্জাহীনতা, বেহায়াপনাকে স্যালুট জানালেন ঠিক আছে, কিন্তু মাক্সিম গোর্কির সাহিত্যকৃতি আর হিরোর শিল্পকৃতি কি এক জিনিস হলো? তিনি  আমাকে রেসিস্ট বলে গাল দিলেন! 

ডিকশনারী ঘেঁটে দেখলাম রেসিস্ট অর্থ বর্ণবাদী। এই গালির উদ্দেশ্য, আমি খেটে খাওয়া, মানুষের অবহেলা পাওয়া, কালো কুৎসিত, মানবতাবাদী ও নিম্নশ্রেণীর প্রতিনিধি হিরোকে অবহেলা করছি। 

হায়রে মহিলা, আপনি কেন বুঝতে পারছেন না এই লোকের কর্মকে আমি সমালোচনা করছি। তার লেগে থাকা নয়। তার অবয়ব নয়। 

যাই হোক, তাকে নিয়ে এখন কথা বলা যায় না। দেশের বড় বড় দলের লোক, বুদ্ধিজীবী, টকশোতে কথা হচ্ছে তার পক্ষে। তিনি লাইভে এসে হুমকিও দেন। ‘হামি কি হছি সেটা টকশোগুলন দেখলেই দেইকপার পাবেন। হামা লিয়্যা কত বড় বড় মানুষ কতা কইচ্ছে।’ 
হয় বাপু তোক লিয়া বড় বড় মানুষ কথা কইচ্চে।

দুটো ভিডিও ক্লিপস আর খবর দেখে ‘তবদা খেয়ে’ এই লেখা লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছি। একটি সংবাদ হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ভাস্কর্য স্থাপিত হলো। আরে বলে কি? কোথায় কোন জায়গায় স্থাপিত হলো তার ভাস্কর্য? পরে জানতে পারলাম, চারুকলার এক ছাত্র কেসস্টাডি হিসেবে তার মুখমণ্ডল তৈরি করে ওখানে রেখে দিয়েছে। তার সাথে সেলফি তুলে হিরো পুরো নেট দুনিয়াকে অস্থির করে তুলেছে। যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ভাঙ্গানো হয়েছে। এতো বড় একটা মিথ্যাচার নিয়ে কেউ কোনো কথা বললো না! দেশের বড় বড় মানুষের ভাস্কর্য যেখানে স্থান পায়নি আর সেখানে হিরোর ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে- এই খবরটাও মিডিয়া যাচাই করলো না! চালিয়ে দিলো! হায়রে মিডিয়ার দৈন্যদশা। একটা পঁচা বাসি খাবার প্যাকেট করে তারা বেচতে লাগলো কয়েক দিন ধরে। 

আরেকটা ভিডিও দেখলাম, এক ব্যক্তিকে হিরো সহায়তা করতে চেয়ে করেনি। সেই লোক ব্যাপক কান্নাকাটি করছে। তার সঙ্গে প্রতারণার গল্প বলছে। যা খেয়াল করলাম ভাইরাল হওয়ার জন্য যেখানে যেমন যা করা দরকার হিরো তাই করছেন। আর ইউটিউবাররা এটা নিয়ে হাজার ধরনের কনটেন্ট তৈরি করলেন। লাভের লাভ উপরি কামাই ওই ডলার। 

যা দেখছি, এই হিরো এখন অনেক গল্প জন্ম দিচ্ছেন। অনেক বিভ্রান্তি ছড়িয়ে আমাদের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। পরে যা ঘটছে তার উল্টোটাই বেরিয়ে আসছে। কিছুদিন আগে চার চাকা উপহার পেলেন তিনি। পরে দেখা গেলো সেটির কাগজপত্র ঠিক নেই দশ বছর ধরে। মালিক ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচার মতো করে এটা সপে দিয়ে ভার মুক্ত হয়েছেন। এক প্রবাসী তাকে দেড় লাখ টাকা দামের সোনার চেইন দিলেন। পরে দেখা গেলো এটা সোনার নয়। প্রতারণা করা হয়েছে। আবার নিজের নামে একটা ফাউন্ডেশন তৈরির চেষ্টা করছেন। একটা ফাউন্ডেশনের গঠন প্রক্রিয়া কি, সরকারের অনুমোদন নিয়েছেন কি না, জয়েনস্টকে নিবন্ধন হলো কি না তার খোঁজ কেউ নিচ্ছে না!  

তার উচ্চশ্রেণিতে ওঠার নানা গল্প এখন নেট দুনিয়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। তার মিউজিক ভিডিও আপনার দেখেছেন, গান শুনেছেন, কবিতা আবৃত্তি শুনেছেন, সিনেমা দেখেছেন এগুলো কোন পর্যায়ের শিল্প তা বিচার বিবেচনাবোধ থাকলে নিজেরাই বলতে পারবেন। তার জন্য বোদ্ধা সমালোচক হওয়ার প্রয়োজন নেই। এই ‘হিরো’ দেশে বিদেশে বাংলাদেশের একজন ‘হিরো’ হিসেবে সে সংকেত পৌঁছে দিচ্ছেন তাতে আমরা ছোট হচ্ছি না বড় হচ্ছি আপনারাই ভেবে দেখুন? 

সর্বশেষ বলতে চাই, সংস্কৃতি আর স্ট্রাগলের নামে এই অপসংস্কৃতির জীবাণু এখন ফোঁড়া থেকে ক্যানসারে পরিণত হয়েছে। একে সারাতে হবে। না হলে আমাদের সংস্কৃতির শরীর খেয়ে আমাদের অসাড় করে চলে যাবে। 

লেখক: সম্পাদক, অপরূপ বাংলা  

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়