ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

সহিংসতার সংস্কৃতি কি তবে বাংলাদেশের রাজনীতির ভূষণ?

জোবাইদা নাসরীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৫৪, ৩১ অক্টোবর ২০২৩  
সহিংসতার সংস্কৃতি কি তবে বাংলাদেশের রাজনীতির ভূষণ?

বাংলাদেশে চলছে বিএনপির ডাকা অবরোধ। এই অবরোধের প্রতি প্রকাশ‍্যে সমথর্ন জানিয়েছে কয়েক বছর আড়ালে থাকা জামায়াতে ইসলামি। পাল্টাপাল্টি সমাবেশ, একে অপরকে দোষারোপ, সহিংসতা, হরতাল, অবরোধ, সংঘর্ষের আশঙ্কায় মোড়া গোটা বাংলাদেশ।

খুব কাছেই নির্বাচন। যারা এ বছর প্রথম ভোট দেবেন বলে অনেক আশা নিয়ে অপেক্ষা করছেন নির্বাচনের দিনটির জন‍্য, তারা হয়তো অনেকটাই উচ্ছ্বাস হারিয়ে ফেলেছেন কিংবা ফেলবেন। নিজের ভোটের মধ‍্য দিয়ে একজন প্রতিনিধি নির্বাচন করার আনন্দ অনেক। এর পাশাপাশি দেশের নাগরিক হিসেবে একটি অধিকারের স্বীকৃতি অর্জন ভোট দেওয়ার মধ‍্য দিয়ে তৈরি হয়। কিন্তু অন্তত ২৮ অক্টোবরের মধ্যে দিয়ে যে সহিংসতার শুরু হয়েছে তা থেকে এটি মনে করা অন‍্যায় হবে না যে, বাংলাদেশের রাজনীতিতে ‘সহিংসতাবিহীন নির্বাচন’ আদৌ সম্ভব হবে কি না? এর আগ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক চাপ বিশেষ করে আমেরিকার ভিসা-নীতির প্রয়োগের ঘোষণা   প্রধান দুটো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে বেশ কিছুটা সময় রয়েসয়ে কমর্সূচি দেওয়ার দিকে ঝোঁক তৈরি করেছিল। কিন্তু ২৮ তারিখে আর শেষ রক্ষা হলো না। সহিংসতা হয়েছে, একে অপরের সঙ্গে জড়িয়েছে। সেই রেশ এখনও রয়েছে। এর পরদিনও বাসে আগুন দেয়া হয়েছে। সাধারণ জনগণ বাস্তবিক অর্থেই ভীত হয়ে পড়েছেন। 

এখন প্রশ্ন হলো- এই সহিংসতা কি এড়ানো যেত না? বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় কি সহিংসতা এবং সংঘর্ষ অনিবার্য? এর কি বিকল্প নেই? নাকি প্রধান দুটো রাজনৈতিক দল ধরেই নিয়েছে সহিংসতা ছাড়া তারা কেউই ক্ষমতায় যেতে পারবে না? ধারণা করা হচ্ছে নির্বাচনের আগ পযর্ন্ত দুই দলেই সহিংসতার মেজাজে থাকবে। 

বিএনপির একদফা দাবি অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ‍্যুত করেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন। কিন্তু আওয়ামী লীগ অনঢ় তাদের অবস্থানে। ২৮ অক্টোবরের সহিংসতার পর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছেন যে, শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন হবে এবং সংলাপ বিষয়ে আওয়ামী লীগ নিজ থেকে উদ‍্যোগ গ্রহণ করবে না। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ২৮ অক্টোবরের সহিংসতার পর যখন আন্তর্জাতিকভাবে দু’দলই সমালোচনার শিকার হয়েছেন তখন একে অপরকে দোষারোপ করে দূতাবাসগুলোর কাছে তারা হাজির হচ্ছে।

ইতোমধ‍্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ কূটনীতিকদের ডেকে তাদের কাছে ২৮ তারিখের ঘটনার ব‍্যাখ‍্যা দিয়েছে এবং স্পষ্টতই বিএনপিকে দায়ী করেছে। তবে কূটনীতিকরা সরকারী দলকে কোনো ধরনের প্রশ্ন করেনি। অন‍্যদিকে বিরোধীদল বিএনপিও সেদিনের সহিংসতার জন‍্য ক্ষমতাসীন দলকে দায়ী করে বিভিন্ন দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে। এখানে প্রশ্ন হলো সহিংসতার জন‍্য একে অপরকে দায়ী করানোর চেয়ে কোনো দল কি সেদিন সত্যিকার অর্থেই সহিংসতা এড়াতে চেয়েছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখা।
সহিংসতা যে হবে সেটি বোঝা গিয়েছিল ২৭ অক্টোবর থেকেই। দুই দলই মাঠে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিএনপির মহাসমাবেশ ঠেকানোর ডাক আগেই দিয়েছিল ক্ষমতাসীনরা। তবে এর মধ‍্যে জামায়াতের সমাবেশ করার অনুমতি না মিললেও তারা প্রতিরোধহীনভাবেই সমাবেশ শেষ করেছে। তাদের প্রতি কারো প্রতিরোধের তাড়া না থাকলেও প্রচ্ছন্ন আস্কারা যে ছিল তা বোঝা যাচ্ছে। 

ইতোমধ‍্যেই ২৮ অক্টোবরকে ঘিরে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন তিনজন। নির্বাচনের বাকী আরও দুই মাস। আকাঙ্খিত না হলেও এটি সত‍্যি যে, এই দুই মাসে আরও নানা ধরনের সহিংসতা ঘটবে। এমনকি বহুল কাঙ্খিত নির্বাচনের দিন এই সহিংসতার মাত্রা আরও বাড়বে এটা ধরে নেয়া যায়। গণমাধ‍্যমে প্রকাশিত তথ‍্য অনুযাযায়ী গত নির্বাচনের দিন সংঘটিত সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১৫ জন। শুধু জাতীয় নির্বাচনে নয়, বাংলাদেশ স্থানীয় নির্বাচনেও সহিংসতা একটি চিরস্থায়ী প্রত‍্যয় হিসেবে হাজির হচ্ছে। গত ইউপি নির্বাচনেও বিভিন্ন ধাপে সহিংসতায় নিহতের সংখ‍্যা প্রায় একশোর কাছাকাছি। 

তবে কি নির্বাচন এখন এ দেশের মানুষের কাছে আতঙ্ক? নির্বাচন মানেই একে-ওকে মেরে ক্ষমতায় যাওয়া? নির্বাচন মানেই তবে এ দেশে এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ঠেকানোর সর্বশক্তি প্রদর্শন? এই শক্তিসবর্স্ব নির্বাচনের দিকেই আমরা চেয়ে থাকি? এই সহিংসতা এড়ানোর পথ বা অবস্থা কি প্রধান দুটো দলের ছিল বা আছে? তারা কি চাইলেই এই সহিংসতা এড়াতে পারতো?

কেন দলগুলকো সহিংসতার দিকে যেতে হয়? যেখানে জনগণকে সাথে নিয়েই তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার কথা; তার পরিবর্তে কেন তারা সহিংসতা করেই ক্ষমতায় যেতে চায়? সহিংসতাই কেন বাংলাদেশে নির্বাচনী রাজনীতির প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে দেখা যাবে সবচেয়ে যে বিষয়টি সেটি হলো দেশে গণতন্ত্রের সংকট। ‘ঠেকাও আন্দোলন’ এই মন্ত্রে দীক্ষিত রাজনৈতিক দলগুলো। তাদের মধ্যে কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনা কিংবা সংলাপের বিষয়ে তারা আগ্রহী নয়। যদিও এর আগের নির্বাচনগুলোর আগে আন্তর্জাতিক চাপে তারা সংলাপে বসেছিল। কিন্তু সেই সংলাপ থেকে কোনো ধরনের স্বস্তির জায়গা বের হয়ে আসেনি। তবুও সংলাপ গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা বলাই যায় যে, সহিংসতা এড়াতে সংলাপের বিকল্প নেই। তবে সংলাপ হলেও সহিংসতা এড়ানো যায়, যেতো এটিও হয়তো তেমনভাবে বলা যাবে না। 

এখানে আরেকটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, আমরা যেভাবে সহিংসতার সংস্কৃতিকে অনুমোদন দিচ্ছি, সেক্ষেত্রে গণতন্ত্রের মধ‍্যমণি হিসেবে জনগণ অনেকটাই দূরে সরে যাচ্ছে। কারণ এই সহিংসতা জনগণ চায় না। কিন্তু তাদের চাওয়া-পাওয়ার ওপর ভিত্তি করে এখন আর রাজনীতি হচ্ছে না। এখনকার রাজনীতি শুধুই ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নিজে ক্ষমতায় যাওয়ার জন‍্য। এই জায়গা থেকে যদি আমরা রাজনীতিকে বের করে নিয়ে আসতে না পারি তাহলে আমাদের সহিংসতার কাছেই সমর্পিত হতে হবে। কিন্তু এটি থেকে বরে হওয়া বর্তমান সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। 

আমি স্পষ্টভাবেই জানান দিতে চাই যে, আমাদের এই সহিংসতার সংস্কৃতি আমাদের জারী থাকা রাজনৈতিক সংস্কৃতির পাঠ। তাই আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পিরবতর্ন না হলে এই সহিংসতার সংস্কৃতি থেকে বের হওয়া কঠিন। রাজনীতিকরা যদি এটিকেই রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিবেচনা করে রাজনীতি জারী রাখতে চায় তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে এর বাইরে যাওয়ার পথ কি আদৌ থাকবে?

লেখক : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাবি

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়