ঢাকা     শনিবার   ২৭ জুলাই ২০২৪ ||  শ্রাবণ ১২ ১৪৩১

‘জনগণ’ শব্দ ব‍্যবহারের রাজনীতি

জোবাইদা নাসরীন  || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৩, ২৫ নভেম্বর ২০২৩   আপডেট: ১৪:২৪, ২৫ নভেম্বর ২০২৩
‘জনগণ’ শব্দ ব‍্যবহারের রাজনীতি

বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আর বেশি দেরী নেই। তফসিল ঘোষণা হয়েছে। যদিও নির্বাচনের তফসিলের বিরুদ্ধে হরতাল, অবরোধ জারি রেখেছে বিএনপি এবং আরও কয়কেটি সমমনা দল। তবে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে থাকা মহাজোটের সকল দলই নির্বাচনে আগ্রহী। ইতোমধ্যে জোটের শরীক দল জাসদ ১৮১টি আসনে তাদের প্রার্থীদের মনোনয়ন নিশ্চিত করেছে। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্র অনুযায়ী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সরাসরি ৩০০টি সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হতে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন ৩ হাজার ৩৬২ জন।  তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে  (২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত) ৪ হাজার ২৩ জন দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন। সে হিসাবে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম ৬৬১টি কম বিক্রি হয়েছে। এবার প্রতি আসনে গড়ে প্রায় ১১ জন ফরম কিনেছেন। এমনকি যেখানে বাঘা বাঘা নেতা রয়েছেন এবং যাদের মনোনয়ন অনেকটাই নিশ্চিত সেখানেও ফরম তুলেছেন অনেকে।  কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়কেদিন আগেই বলেছেন, বর্তমান সংসদ সদস্যদের অনেকই এবার মনোনয়ন পাবেন না। শেখ হাসিনার এই বক্তব্য অনেককে উৎসাহিত করছে নতুনভাবে। কারণ সকলের কাজই তিনি মূল্যায়ন করেছেন। 

গণমাধ্যম সূত্রে আরও জানা যায়, ঢাকা-২০ আসনে মনোনয়ন ফরম কিনেছেন ৬৪ জন। সেখানে অন্তত ৬ জন প্রভাবশালী নেতা রয়েছেন। আছেন আওয়ামী লীগের শরীক দলের প্রর্থীও। এর আগে একজন ক্রিকেটারের তিন আসন থেকে মনোনয়ন ফরম কেনা নিয়েও গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা শুরু হয়। 

বাংলাদেশের প্রধান দুটো রাজনৈতিক দল যেমন দাবি করে এবং অনেকটা মনে করে, দেশের সাধারণ জনগণ তাদের সঙ্গেই আছে। যদিও কোনো দলই জনগণের মতামত তোয়াক্কা করে না। কিন্তু এই ‘জনগণ’ শব্দটাই রাজনীতিতে তারা ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি। যারা মনোনয়ন ফরম কিনেছেন এবং বিভিন্ন নেতাদের কাছে ধর্না দিচ্ছেন তাদেরও এক যুক্তি- জনগণ তাকে চাচ্ছে এবং অন্য প্রার্থীকে চাচ্ছে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে কেউই নির্বাচনে প্রার্থী হতে চাচ্ছে না কিন্তু জনগণ চাচ্ছে বলে তাকে হতে হবে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি স্থানে প্রার্থীরা প্রচার শুরু করেছেন নিজেদের মতো। এবং সেই প্রার্থীদের পক্ষে প্রচারক হিসেবেও নাম দেয়া হচ্ছে- ‘এলাকাবাসী’, ‘নগরবাসী’।

এটি ভাবনায় আনার সুযোগ নেই যে, যারা নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান না তাদের জনগণ পছন্দ করে না। আসলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত শব্দই হলো জনগণ। যদিও হতভাগা জনগণ তা জানেও না, তাদের কীভাবে ব্যবহার করছে রাজনীতিকরা। তারা সব সময় বলছে, তারা জনগণের জন্যই রাজনীতি করছে। কিন্তু তাদের সাথে যে জনগণের সম্পর্ক খুবই কম তা ইতোমধ্যেই একবারে সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। জনগণ আসলে কোন ধরনের নির্বাচন চায়, তাদের ভোট নির্ভয়ে দিতে পারবে কি না, জনগণ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আস্থা রাকে কি না- এসব বিষয়ে আগ্রহ নেই রাজনৈতিক দলগুলোর। দুই দলের মনোযোগ অন্যত্র। তারা হন্যে হয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের চেষ্টা করছে। তারা অন্য দেশগুলোকে গুরুত্ব দিচ্ছে, তাদের মতামতের তোয়াক্কা করছে, বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে দিল্লীতে বৈঠক হচ্ছে, দিল্লী-ওয়াশিংটন আলাপ হচ্ছে, কিন্তু কারো আলাপ নেই জনগণের সঙ্গে। কিন্তু হওয়ার কথা ছিল তাই। 

নির্বাচনে জনগণ মূল। নির্বাচন আসলেই সবাই বুঝে যায় এখানে রাষ্ট্রপতি আর ভিখারীর ভোটের কোনো পার্থক্য নেই। সকলেই সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন বাংলাদেশের নির্বাচনে সেই মনস্কতা নেই। আগের দুটো নির্বাচন অন্তত সেই সাক্ষী দেবে। জনগণ মেনে নেবে না, কিংবা জনগণ এটা চায়- এ সবই জনগণের নামে রাজনৈতিক বাহাস। জনগণ কি তবে হরতাল, অবরোধ, সহিংসতা চায়? না চাইলে কেন এগুলো হচ্ছে? জনগন কি একতরফা নির্বাচন চায়? নির্বাচন নিয়ে আসলে মাথা ব্যথা কাদের? যদি দেশের মানুষ ভোটের অধিকারটুকু প্রয়োগ করতে পারতো তাহলে তাদের কাছে নির্বাচন আসতো আনন্দ নিয়ে, নিজের মত প্রকাশের অধিকার নিয়ে। কিন্তু সেই চিন্তা এখন খুব কম জনগণই করতে পারে। 

নির্বাচনী আলোচনায় অবহেলিত হঠাৎ করে দামি হয়ে ওঠে মনোনয়ন তদবিরে, পোষ্টারে এবং শ্লোগানে। এই বেচাবিক্রির দুনিয়ায় জনগণই সবচেয়ে বেশি  বিক্রিত হয়, প্রতারিত হয়। জনগণ জানে না তাদের কীভাবে ব্যবহার করে রাজনীতিকরা তাদের শক্তি বজায় রাখে। যারা বলছেন তারা নির্বাচন করতে চান এ জন্য যে জনগণ তাদের সাংসদ হিসেবে দেখতে চান। তাদের অনেকেই হয়তো দলের বাইরে এলাকার সত্যিকারের ভোটাররা চিনেও না। 

এখন যদি প্রত্যেক প্রার্থীকে প্রশ্ন করেন, কেন তারা সংসদে যেতে চান? আমি নিশ্চিত সকলেই বলবেন, জনগণের খেদমত করতে। জনগণের সেবা করাই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। কেউ কেউ আরেকটু এগিয়ে বলবেন, কাজের লোক হতে চাই। অর্থাৎ জনগণের জন্য কাজ করতে চাই। কিন্তু দেখা যায় যে, অনেকের ক্ষেত্রেই নির্বাচনে জেতার পর সেই জনগণের সঙ্গে খুব বেশি সম্পর্ক থাকে না। 

এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন পাড়া দরকার বলে মনে করি। জনগণের খেদমত করতে হলে কেন আপনাকে সংসদ সদস্য হয়েই করতে হবে? বর্তমান প্রেক্ষাপটে কেন কোটি কোটি টাকা খরচ করে আপনাকে সংসদ সদস্য হয়েই জনগণের সেবা করতে হবে। যদি আপনার কোটি কোটি টাকা থাকে তাহলে তো আপনি সেই টাকা দিয়েই আপনার এলাকার লোকজনের নানা ধরনের সেবা দিতে পারেন। আপনাকে কেন সংসদ সদস্যই হতে হবে?

সব জায়গাতেই জনগণকে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু সেই জনগণ আসলে কোথাও নেই, কারো চিন্তায় নেই, চেতনায় নেই। কিন্তু জনগণ কি তাহলে এভাবে শুধু ব্যবহৃতই হবে?

লেখক : শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ‍্যালয়

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়