ঢাকা     মঙ্গলবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

শিশুর জন্য প্রয়োজন সাংগঠনিক পরিবেশ 

এস এম জাহিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৯:১৭, ২৯ নভেম্বর ২০২৩  
শিশুর জন্য প্রয়োজন সাংগঠনিক পরিবেশ 

আমার শৈশব কেটেছে সাংগঠনিক পরিবেশে। বাবা শিক্ষক ছিলেন। আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে শিক্ষকরা ছিলেন সোসাইটি চেঞ্জার বা সমাজ পরিবর্তক। তিনি আমার সামনে যে আদর্শ তুলে ধরতেন সেটা হলো মানবিকতা। বাবা বলতেন, তোমার দায়িত্ব তুমি পালন করবে। কারও কাজে যদি পারো যথাসম্ভব সহযোগিতা করবে। 

আমাদের সময় অনেক শিশু সংগঠন ছিল। বাবা চেয়েছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার বাইরেও বাস্তব জ্ঞান চর্চার সঙ্গে যেন যুক্ত থাকি। তাঁর ইচ্ছায়, আমি ছোটবেলা থেকেই ‘খেলাঘর’ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হই। এ ছাড়া ‘কচিকাঁচার আসর’, ‘মুকুল ফৌজ’, ‘নজরুল সেনা’, ‘শাপলা কুঁড়ির আসর’-এর মতো জাতীয় শিশু সংগঠন ছিল। 

খেলাঘরের কথা বলতে পারি, এই সংগঠনটি একটি শিশুকে পূর্ণাঙ্গভাবে গড়ে তুলতো। আমরা যেসব বড় ভাইদের পেয়েছিলাম তারা আমাদের রীতিমত ক্লাস নিতেন। বিষয়টিকে ইনফরমাল এডুকেশন বলা যেতে পারে। আমাদের শেখানো হতো, সমাজটাকে কীভাবে দেখতে হবে, সামাজিক বৈষম্যগুলো কোথায়, সামাজিক বৈষম্যগুলো দূর করার জন্য সাম্যবাদ কেন জরুরি; এক কথায় সমাজতন্ত্রের বিষয়গুলো আমাদের শেখানো হতো। বিশ্বের মনীষীদের সমাজ-ভাবনা আমাদের জানানো হতো। এ ছাড়াও জানানো হতো আমাদের দেশের মনীষীদের সমাজ-ভাবনাও। বিভিন্ন সময়ে এসব মনীষীদের আমরা কাছেও পেয়েছি। ‘সংবাদ’ পত্রিকার খেলাঘর পাতার সম্পাদক সাংবাদিক বজলুর রহমান, কামাল লোহানী, লায়লা হাসান, ঝর্ণা দাশ পুরকায়স্থ, দ্বিজেন শর্মাসহ অনেককেই কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম ওই সংগঠন থেকে।  তাদের কথা আমাদের অনুপ্রাণীত করেছে। খেলাঘরের অনুষ্ঠানে গেলে দেখতাম আলী যাকের, সারা যাকের, তারিক আনাম খান, আসাদুজ্জামান নূর, পান্না কায়সার, আনিসুজ্জামানের মতো সমাজ সচেতন মানুষদের। তাদের কথা শুনতাম যা আমাদের কাছে রীতিমত বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল।

সংগঠন থেকে আমাদের শেখানো হতো মানুষের প্রতি দায়িত্ব, সমাজের প্রতি দায়িত্ব। আমরা নিজেরা মাটি কাটার কাজ করেছি, সেই টাকা দিয়ে সংগঠনের জন্য জায়গা কিনেছি, ঘর করেছি। আমরা পুকুরের পানা পরিষ্কার করেছি। এখনকার শিশুরা এগুলো চিন্তাও করতে পারবে না। এই যে সাংগঠনিক আবহে বড় হয়েছি পরবর্তী সময়ে সেই অভিজ্ঞতা আমি আমার বর্তমান অবস্থানে কাজে লাগাতে পেরেছি। ছোটবেলা থেকেই শিখে এসেছি কীভাবে সংগঠিত হতে হয় এবং একটি সংগঠন কীভাবে পরিচালনা করতে হয়।

যদি এই প্রশ্ন আসে- শিশুদের কী শেখাবেন? তাহলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত, পরিবার ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি তাদের একেবারে পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য একটি শিশুর মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো ব্যবহার উপযোগী করার পরিবেশ প্রয়োজন। দেখা যায়, যারা সাংগঠনিকভাবে বড় হয় নাই তারা অনেক ক্ষেত্রে অমানবিক আচরণ করে ফেলে। সমস্যা সমাধানে যেখানে নেতৃত্ব প্রয়োজন পড়ে সেখানে দেখা যায় যে তারা ব্যর্থ হয়।

পরিবার থেকে যে শিক্ষাটা জরুরি তা হলো, শিশুর চাওয়া এবং পাওয়ার মধ্যে একটা সীমারেখা তৈরি করতে হবে। পিতা মাতাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে একটি শিশুকে আসলে কতটুকু দেবেন। তার যতটুকু প্রয়োজন, যেটুকু না হলে তার দৈনন্দিন কাজ চলবে না বা তার শিক্ষা কার্ক্রম ব্যাহত হবে কিংবা তার স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কোনো সমস্যা তৈরি হবে বা পুষ্টির অভাব হবে; এ ধরনের কোনো কিছুতে আমি অভাবে রাখতে বলছি না। আমি বলছি যে, তার বিলাসিতার লাগাম টানার কথা।

ধরুন ক্লাস সিক্সের শিশুকে যদি আইফোন কিনে দেন, তাহলে সে যখন ক্লাস ইলেভেনে যাবে তখন তাকে কি দেবেন? তখন কিন্তু সে আরও উচ্চতর সুবিধা না-পাওয়ায় হতাশ হবে। সাধারণত দেখা যায়, ঢাকা শহরে যারা আছে তাদের সফলতার হার কম। তার চেয়ে মফস্বলের ছেলেমেয়েরা এগিয়ে। কারণ তারা তাদের বিস্ময় হারিয়ে ফেলে না। এবং তারা অনেক কিছু কাছ থেকে দেখে গা-সওয়া হয়ে যায়। আর মফস্বলের একটা ছেলে এখনও একটি হেলিকপ্টার দেখলে অনেক উল্লসিত হয়। ফলে তার নতুন নতুন সৃষ্টি ও বিস্ময় দেখার আগ্রহ থাকে। আগ্রহ থেকেই তারা প্রতিযোগিতামূলক কাজে অংশ নেয় এবং জয়ী হয়। 

ভালো করে খোঁজ নিলে দেখা যাবে সরকারি-বেসরকারি চাকরির ঊর্ধ্বতন পদগুলোতে মফস্বল পর্যায়ের মানুষে পৌঁছে যান। সুতরাং আপনার আমার শিশুদের মধ্যে তার অবস্থান অনুযায়ী অবাক হওয়ার উপকরণ অবশিষ্ট রাখতে হবে। 

সহমর্মী হওয়ার অনুপ্রেরণা না পাওয়া শিশুরাই একদিন কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। যা প্রমাণ করে আমরা তাদের সঠিক পরিবেশ দিতে পারছি না। জাতীয় পর্যায়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ শিশু-কিশোর সংগঠন থাকলে সমাজের এমন চিত্র তৈরি হতো না।

সহনশীল, সহমর্মী, সকল কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে একটি শিশুকে বড় করতে হলে প্রয়োজন শিশু সংগঠন। যেন তারা সেখানে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার সকল ধরনের চর্চা করতে পারে। তবেই দেশ পাবে সংগঠিত সুনাগরিক।

তারা//

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ